রাষ্ট্র কী কাউকে জামিনদার রেখে গড়ার কাজ


রাষ্ট্র কী কাউকে জামিনদার রেখে গড়ার কাজ

ভারতকে জামিনদার রেখে নেপালি রাষ্ট্র গড়ার খায়েস
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬,বুধবার

গৌতম দাস
http://wp.me/p1sCvy-Fa

গত প্রায় চার মাস ধরে ল্যান্ড লকড নেপালে পণ্য প্রবেশ ও যাতায়াত রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এটা মূলত ভারতের আরোপ করে অবরোধ। জ্বালানি তেল, রান্নার গ্যাসসহ ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামাল সব কিছুর সরবরাহ এতে ব্যাহত হচ্ছে। এক কথায় বললে ভারত থেকে নেপালে যাওয়া সব পণ্যের চালানের উপর অবরোধ চলছে। নেপাল ল্যান্ড লকড ভূখণ্ড বলে সে ভারতের মধ্য দিয়ে পণ্য আনা-নেয়ায় নির্ভরশীল।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ নেপাল তার নতুন রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন ও রচনার সমাপ্তিতে তা কার্যকর-চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। প্রত্যেক রাষ্ট্রের জন্য এটা এক গুরুত্বপুর্ণ প্রক্লেমেশন। এই প্রক্লেমশনে ভিন-রাষ্ট্রের খুশি বা দুঃখ পাবার কো বিষয় নয়। কিন্তু সেই থেকে অখুশি অসন্তুষ্ট ভারত পণ্য অবরোধের রাস্তা ধরেছিল। ভারতের ব্যাখ্যা অনুসারে, দেশটি স্বীকার করে না যে- ভূমি আবদ্ধ নেপালে পণ্য সরবরাহের একমাত্র পথ ভারত অবরুদ্ধ করেছে। যদিও এটা প্রমাণিত যে ভারতীয় কাস্টম এবং বর্ডার গার্ড বিএসএফ স্পষ্ট বলছে যে ‘ওপরের নির্দেশে’ তারা এটা বন্ধ রেখেছে। তবু ভারতের ব্যাখ্যা হলো, নেপাল-ভারত সীমান্তের অধিবাসী যারা সমতলীয় ‘ত্বরাই’ অঞ্চলের বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এদেরই বড় অংশ হলো মাধেসি জনগোষ্ঠী। যারা মনে করে নতুন কনস্টিটিউশনে তাদের প্রতিনিধিত্ব সঠিক ভাবে হয় নাই, কম করে রাখা হয়েছে। এজন্য তারা অসন্তুষ্ট হয়ে নেপাল-ভারত সীমান্ত অবরোধ করে রেখেছে। ভারত থেকে পণ্য আসা বন্ধ করেছে। ব্যাখ্যা যার যাই হোক, বাস্তবতা হল এটা কার্যত নেপালের জন্য সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অবরোধ। আর সেই সূত্রে তা নেপালের রাজনীতিতে রাজনৈতিক স্থবিরতা তৈরি করেছিল। সম্প্রতি এই স্থবিরতা কাটার লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
নেপালের জনগোষ্ঠী গঠনের মধ্যে এমনিতেই সমতল-পাহাড়ি এমন ভূবৈশিষ্ট্যগত বিভেদ আগে থেকে ছিল। কিন্তু একালে নেপাল-ভারত সীমান্তের জনগোষ্ঠী সমতলী অঞ্চলের মাধেসি নেতারা তাদের স্বার্থ নেপালে ভারতের স্বার্থের সাথে মাখিয়ে গাঁটছড়া বেঁধে তুলে ধরাতে নিজ নেপালিদের জনগোষ্ঠীগত স্বাভাবিক বিভেদকে অস্বাভাবিক ও বড় করে ফেলা হয়েছে।

নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০৮ সালে ঐতিহাসিক পাশ ফেরার মতো প্রধান ঘটনা হল গত ২৪০ বছরের নেপালের শাসক ‘শাহ’ রাজবংশের শাসনের পরিসমাপ্তি। যেটাকে আমরা রাজনৈতিকভাবে নতুন এক বিপ্লবী গণরাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থানের ফলে রাজতন্ত্রের শাসনের অবসান ও রাজতন্ত্র ব্যবস্থার সমূলে উচ্ছেদের ঘটনা হিসেবে দেখতে পারি। ব্যাপারটাকে প্রতীকী দিক থেকে বললে এতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে একটা রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে, এর বদলে এক প্রজাতান্ত্রিক বা রিপাবলিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া এসব ঘটনাবলির ভেতর দিয়ে প্রকাশিত আরেক ঐতিহাসিক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্য হল, নেপালের রাজতন্ত্র ব্যবস্থা উচ্ছেদের লড়াইয়ে ভারতের ভূমিকা ছিল আমেরিকার সহায়তায় কেবল ইতিবাচক সহযোগী বা সমর্থকের নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারকের। রাজতন্ত্র উচ্ছেদের লড়াই – শুরু করার দিক থেকে এতে একক নির্ধারক ভূমিকা রেখেছিল নেপালের নতুন মাওবাদী রাজনৈতিক ধারার দল ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী) বা ইউসিপিএন (মাওবাদী)। যারা এ লড়াইকে কেবল নিজ মাওবাদীদের নয়, সারা নেপালি জনগোষ্ঠীর লড়াই এবং এটা নেপালিদের সাধারণ ও প্রধান স্বার্থ হিসেবে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর নেপালের সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে এর পক্ষে সমর্থক হিসেবে সংগঠিত করা- কাজের এই শেষের অংশে আরো দুই প্রচলিত রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল। এরা হলো আমাদের সিপিবির মতো কনস্টিটিউশনাল কমিউনিস্ট দল- কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফায়েড এমএল ) এবং নেপালি কংগ্রেস। নেপালের রাজনীতিতে মাওবাদীরাসহ এ তিনটি দলই সেই থেকে ৮০-৮৫ শতাংশ নেপালি জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। বলা যায়, রাজতন্ত্র-উত্তর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শক্তির নিয়ন্ত্রক হল এই তিনটি দল, যাদের মধ্যে তা ভাগাভাগি হয়ে আছে। আর এ তিনটি দলের জোটের পেছনেই ভারত পূর্ণ সমর্থন জুগিয়ে নেপালের রাজতন্ত্রে সমাপ্তিতে ইতিবাচক ও নির্ধারক ভূমিকা রেখেছিল।
কিন্তু রাজতন্ত্র উৎখাত হলেও নেপালে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করা যায়নি। নেপালের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা এখানেই। প্রধান কারণ, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে উত্থিত ক্ষমতায় ভারতের কোনো ভাগ বা স্টেক নেই। নেপালি রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারতের স্বার্থের প্রতিনিধি কেউ নয়, নেই। কারণ রাজতন্ত্র উৎখাতে নির্ধারক পর্যায়ের ভূমিকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে ভারত এটা নিজগুণে বিষাক্ত করে ফেলেছে। ভারতের ট্র্যাজেডি হল সে ঠিক কী চায়, কিভাবে চায় এ ব্যাপারে হোমওয়ার্ক করা সুনির্দিষ্ট ও উপযুক্ত – নেপালের স্বার্থের ভেতর দিয়ে তা ভারতেরও স্বার্থ এভাবে এমন কোনো নীতি-পলিসি পেশ করা ও এর পক্ষে সমর্থন আদায় করতে না পারার কারণে সে নেপালের ক্ষমতার স্টেক থেকে বিচ্ছিন্ন। মনে রাখা যেতে পারে, মাওবাদীদের ১৯৯৬ সালে ৪০ দফার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলনের শুরুর সময় তারা নেপাল-ভারত কলোনিয়াল চুক্তির (১৯৫০ সালের চুক্তি) বিরুদ্ধে আঙুল তুলে এবং ভারতকে নেপালের প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করে ওই আন্দোলন শুরু করেছিল। ফলে খুব সম্ভবত ঐ চুক্তি ও ভারত সম্পর্কে এই মূল্যায়ন প্রসঙ্গে এ তিন দলের কিছু অভিন্ন মূল্যায়ন, অলিখিত সমঝোতা আছে। তৈরি হয়েছে। ফলে এই তিন দল যাদের নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও নেপালের বর্তমান নতুন শক্তি ক্ষমতা তাদের হাতে ও নিয়ন্ত্রণে। সব ক্ষমতা এ তিন দলের হাতে ভাগাভাগি হয়ে আছে। আর এরই প্রতীকী প্রকাশ তারা ঘটিয়েছে নেপালের নতুন কনস্টিটিউশন চালুর ঘোষণা দিয়ে ও পরবর্তীকালে সরকার গঠন করে। নতুন কনস্টিটিউশন চালুর ঘোষণা দেয়ার পর থেকে মাওবাদী দলের সমর্থনে অপর কমিউনিস্ট দল সিপিএন (ইউএমএল) এখন সরকার গঠন করে ক্ষমতায়, যার প্রধানমন্ত্রী খার্গা প্রসাদ শর্মা অলি। আর এই সরকার গঠনের আগে সংসদের ভোটাভুটিতে নেপালি কংগ্রেস এ’দুই কমিউনিস্ট দলের জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে হেরে গিয়ে বিরোধী দলে আসন নিয়ে আছে।
আর এটাই ভারতের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ব্যর্থতা-অযোগ্যতাকে রেজিস্টার্ডভাবে প্রমাণিত করেছে যে, এ তিন দলের হাতে ভারতের স্বার্থ উপেক্ষিত। এ তিন দল ভারতকে দায় মনে করে, ব্যাগেজ হিসাবে দেখে। ভারতের ব্যাগেজ বইতে এরা কেউ এখনো রাজি নয়। ফলে নেপালের তৈরি হওয়া নতুন ক্ষমতায় ভারতের কোনো স্টেক নেই। উপায়ান্তর না দেখে ভারতকে এখন ভরসা করতে হচ্ছে নেপালের অ-প্রধান ধারার জনগোষ্ঠী, সমতলীয় ত্বরাই অঞ্চলসহ অন্যান্য অধিবাসী মূলত মাধেসিদের রাজনীতির ওপর।
এককথায় বললে এই রাজনৈতিক উপস্থাপন সেকটারিয়ান, বাংলায় আমরা যেটা সাম্প্রদায়িক বিভক্তির রাজনীতি বলে চিনি। যদিও ভারতে – এরা ভারতের সব মিডিয়া এই রাজনীতিকে হাজির করছে, যেন নেপালি সংখ্যালঘুদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর জন্য ভারত এটা করছে। অথচ সত্যিকার ঘটনা হলো ২০০৬-২০০৯ সাল, যেটা নেপালের রাজনীতির মৌলিক বদলের দিক থেকে টার্নিং পয়েন্ট- এটাই আনুষ্ঠানিকভাবে নেপাল থেকে রাজতন্ত্র উঠে যাওয়ার তাৎক্ষণিক আগের ও পরের সময় – সে সময়ে নেপালের রাজনীতিতে মাধেসি বলে কোনো ইস্যু কোনো কিছু ছিল না।
নেপালের জনসংখ্যার বিন্যাসের দিক থেকে এটা বলা হয়, পাহাড়ি-সমতলি হিসেবে জনসংখ্যা প্রায় সমান দু’ভাগে বিভক্ত। আবার কেবল মাধেসিদের নিয়ে রাজনীতি করে নেপালে এমন আঞ্চলিক দলের প্রায় শেষ নেই। আর এমন আঞ্চলিক দল খোলার হিড়িক লেগেছিল ২০০৯ সালে, যখন ‘মাধেসি’ ইস্যু হতে শুরু করে। এর আগে মাধেসিরা সবাই প্রধান ধারার ওই তিন দলের কোনো একটা করত, বেছে নিত। আর এর মধ্য দিয়েই নিজেদের প্রতিনিধিত্ব পেত। অর্থাৎ ওই তিন প্রধান রাজনৈতিক দল দুই কমিউনিস্ট ও নেপালি কংগ্রেস এর আগে মাধেসিসহ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর পুরোটাকেই প্রতিনিধিত্ব করত। তবে মাধেসিদের নানান আঞ্চলিক দল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যারা প্রো-ইন্ডিয়ান অবস্থান নিয়েছে এরা ছাড়াও  মাধেসিসহ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর একটা বড় অংশকে এখনো ঐ তিন দলই প্রতিনিধিত্ব করে।
যেমন যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম অবরোধে আটকে থাকা নেপাল বা নেপাল-ভারত সম্পর্ক, এর জট খোলার আলামত দেখা যাচ্ছে। সংসদে নেপালের কনস্টিটিউশনে প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি তা পাস হয়েও গেছে। মোট ৬০১ মোট সদস্যের এই সংসদে প্রো-ইন্ডিয়ান অবস্থানের মাধেসি সদস্য যারা ভোটাভুটির সময়ের আগেই ওয়াকআউট করে গেছে, এরা হলো মাত্র ৩৫ জন। সংশোধনীটা পাস হয়েছে মোট ৬০১ সদস্যের মধ্যে ৪৬১ সদস্যের পক্ষ ভোটে। সাত সদস্যের বিপক্ষ ভোটে। আর ঐদিনের সভায় অনুপস্থিত সদস্য মোট ১২৮ জন, যার মধ্য মাধেসি  ঐ ৩৫ জনও অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যারা অবরোধের পক্ষে এমন মাধেসি সংসদ সদস্য মাত্র ৩৫ জন। ফলে ভারত প্রচার চালাবার সময় মাধেসিসহ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি গুলো জনসংখ্যার অর্ধেক বলে প্রপাগান্ডা করলেও ফ্যাক্টস হল, মাধেসি জনগোষ্ঠি আঞ্চলিক প্রো-ইন্ডিয়ান দলগুলোকে ভোট দেয় নাই। এজন্য তারা মোট ৬০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩৫ জন।
প্রো-ভারত মাধেসি দলগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক সবচেয়ে বড় জোট হলো ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক মাধেসি ফ্রন্ট। গত চার মাসের অবরোধে রাজনীতিতে তারা শুধু শাসক ক্ষমতাসীনদের থেকেই নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেনি ও বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি, বরং একই সাথে নেপালের সাধারণ মানুষ, প্রধান ধারার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকেও নিজেদের দূরে দাঁড় করিয়েছে। নিজেদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শত্রুর কাতারে দাঁড় করিয়েছে। একই ভূখণ্ড ও রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানান ধরনের স্বার্থবিরোধ থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বার্থবিরোধ থাকা এক জিনিস, আর সেই বিরোধকে শত্রুতায় রূপ দেয়া আরেক জিনিস। গত পাঁচ মাসে এই বিপজ্জনক শত্রুতার আগুন নিয়ে খেলার কাজটা ভারতের প্ররোচনায় মাধেসিরা করেছে।
নেপালের কনস্টিটিউশনে প্রথম সংশোধনী আনার পরের পরিস্থিতিকে ভারতের হিন্দুস্থান টাইমস বর্ণনা করছে এভাবে, বলছে “এর পরও ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক মাধেসি ফ্রন্ট এই সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে এটা তাদের কিছু দাবি মেনেছে, সব নয়। কিন্তু নেপালের এই নতুন অবস্থান নেপাল ও ভারতকে কাছাকাছি এনেছে”। হিন্দুস্থান টাইমসের এই মন্তব্যে অনেক কিছুর ইঙ্গিত আছে। যেমন- এখনকার এক নম্বর বাস্তবতা হলো পাঁচ মাস ধরে অবরোধ চালানোর পরে মাধেসিদের পক্ষে এই আন্দোলন আর চালানোর অবস্থায় নেই। এমন ধারণা ভারত দিতে চাইছে। গত ২৬ জানুয়ারি রয়টার্সের এক রিপোর্টে এ বিষয়ে এক ডিটেইল নিউজ এসেছে। ওদিকে নেপালি সংসদে সংশোধনী পাস হওয়ার পর ভারত একে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও আসলে ভারত ও প্রো-ভারত মাধেসিদের অবস্থান হল, তারা সম্ভবত অবরোধ একেবারে না তুলে ধীরেসুস্থে তুলতে চাচ্ছে। কারণ, এত দিন তারা আন্দোলন এমনভাবে পরিচালিত করেছে, যেন তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করছে, নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ফলে সে চিন্তায় বিচ্ছিন্নতার জায়গা থেকে ফেরত আসতে সময় লাগবে। এ ছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কথা চলছে। ওই সফর শেষে অবস্থা বুঝে এরপর পরিস্থিতি আস্তে ধীরে সহজ হতে পারে। যদিও লিখিতভাবে ভারতের স্বাগত জানানো বিবৃতিতে অবরোধ পরিস্থিতি এখন থেকে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সংবিধানে সংশোধনী আনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রো-ভারত ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক মাধেসি ফ্রন্টের নেতা রাজেন্দ্র মাহাতোর দাবি। তিনি দুটো অদ্ভুত দাবি করেছেন। যার ভেতর দিয়ে নেপালের নতুন ক্ষমতায় স্টেক হারানো ভারতের করুণ দুর্গতিই প্রকাশ করে। আবার এই দাবির ভেতর দিয়ে একই সাথে মাধেসি সেক্টরিয়ান বা বিভক্তির রাজনীতির আগুন নিয়ে খেলার বিপজ্জনক দিকটি উদোম হয়েছে। যে আগুন ভারতের জন্যও সমান বিপদের হতে পারে। মাহাতোর দাবি, ভারতকে তিনি নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িত হোক বা হস্তক্ষেপ করুক দেখতে চান। আর দ্বিতীয়ত, নেপাল সরকার যেসব আইনি সংশোধনী যা আনছেন তা বাস্তবায়নে তিনি ভারতকে জামিনদার বা গ্যারান্টার হিসেবে দেখতে চান।

সত্যিই এমন তামাশা সহজে খুব একটা দেখা মেলে না। ভারতের সেক্টরিয়ান রাজনীতির মহিমা এমনই যে, মাধেসি নেতারা এখন বলছেন নেপাল সরকারকে বিশ্বাস নেই, ভারতকে জামিনদার হিসেবে চাই! খবরটা ১৮ জানুয়ারির ভারতের দি হিন্দু পত্রিকার বরাতে একই দিন ১৮ জানুয়ারি আমাদের দৈনিক বণিক বার্তা ছেপেছে। অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে, মাধেসি নেতাদের কী বলা উচিত আর কী নয়, এসব শিখিয়ে-পড়িয়ে আনার ব্যাপারেও ভারত একেবারেই নাদান। মাহাতোর এই কথা প্রমাণ করেছে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে মৌলিক ধারণাও রাখেন না। তিনি রাষ্ট্র কী তা-ই বোঝেননি। ফলে তার এমন দাবি। অথচ রাষ্ট্র গঠন করা ভিনরাষ্ট্রকে জামিনদার রেখে করার জিনিস নয়। আবার রাষ্ট্র গঠনের কাজ নিজে করার কাজ; বাইরের কাউকে হস্তক্ষেপ করতে ডেকে করার কাজও নয়। নিজ জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভিন্ন নাগরিক ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হয়। আর ঐ ভিত্তির গাঠনিক দলিল হল কনস্টিটিউশন। বাইরের জামিনদার নয়। তাই রাজেন্দ্র মাহাতো তিনি আসলেই বড়জোর নেপাল রাষ্ট্রে ভারতের স্বার্থের এজেন্ট হয়েই থাকতে চান। এতটুকুর জন্যই তিনি যোগ্য। এটা যেন বাবাকে জামিনদার রেখে কেউ বিয়ে করতে চাওয়ার শখ প্রকাশ করছে। অথচ যেখানে জামিনদার রাখার কথা ভাবতে হয় সেটা কি বিয়ে!
goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা এর আগে ৩১ জানুয়ারি দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ এর প্রিন্ট পত্রিকায় এবং পরের দিন ০১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক নয়া দিগন্ত প্রিন্ট পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। খানে তা আবার পরিমার্জন সংযোজন এবং এডিট করে ছাপা হল।]

Leave a comment