নতুন মেরুকরণ, ভারতের কী কোয়াড ত্যাগ!


নতুন মেরুকরণ, ভারতের কী কোয়াড ত্যাগ!

গৌতম দাস

০২ এপ্রিল ২০২১, ০০ঃ০৬
https://wp.me/p1sCvy-3uj

বাংলাদেশের ৫০ বছরপুর্তির ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পার করেছে। আর এ’বছরেরই ২০ জানুয়ারি মানে মাত্র দুমাস আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতাসীন হবার শপথ নিয়েছেন। আমরা অনেকেই দেখার জন্য উদ্গ্রীব ও আগ্রহি ছিলাম যে ট্রাম্পের পাগলামি-উত্তর বাইডেন নতুন কী রাজনীতি নিয়ে আসেন। বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পরে ইত্যাদি। অপেক্ষার পালা একটু দীর্ঘ হয়ে যাওয়াতে আমাদের মন-সংযোগ একটু ঢিলা পড়ে গিয়েছিল হয়ত আর এই ফাঁকে বেশকিছু গুরুত্বপুর্ণ ইঙ্গিত বা ঘটনার প্রকাশ ঘটে গিয়েছে। এই বিচারে গত ২৬ মার্চ মোদীর মত আরএসএসের ক্যাডার তিনি বাংলাদেশের ৫০ বছরপুর্তির প্রধান অতিথি হয়েছেন বলে নয়, এর চেয়েও বড় তাতপর্যপুর্ণ ছিল মোদীর এই সফর। যেটা বাইডেনের ২০ জানুয়ারিতে শপথের সময় কেন ২০ ফেব্রুয়ারিতেও আগাম বুঝা যায় নাই যে পরের মাসে ২৬ মার্চ এত তাতপর্যপুর্ণ হয়ে যাবে। যেমন এখন হয়ত আমাদের মনে পড়বে,  আমরা মনে করতে পারি, এবার ২৬ মার্চের প্রধান অতিথি কে হবেন ভারতের কসাই মোদী না তুরস্কের এরদোয়ান, এই আলাপ উঠতেও আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু বরং মার্চ মাস শুরু হবার পর ক্রমশই মোদীরই প্রধান অতিথি হওয়া ক্রমশ এক বিরাট গুরুত্ব নিয়ে হাজির হতে শুরু করেছিল। কেন?

নতুন করে গ্লোবাল পোলারাইজেশনঃ আমাদের অনুমানের চেয়েও দ্রুতগতিতে এটা আগাচ্ছে। আর বলাই বাহুল্য ট্রাম্পের আমল পর্যন্ত আমরা কোয়াড (চীনবিরোধী চার রাষ্ট্রীয় জোট- আমেরিকা-ইন্ডিয়া-অষ্ট্রেলিয়া-জাপান) আর  সাউথ চায়না সি কেন্দ্রিক ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাটেজি (উদ্যোগ) – এদুটার কথা জোরেশোরে শুনে আসছিলাম। ফলে “কোয়াড” ও “ইন্দো-প্যাসিফিক” কেন্দ্রিক পোলারাইজেশনই আগামিতে প্রধান হবে ও বাড়বে এমনটা ধরে নিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু না, তা আর হচ্ছে না। এই ইঙ্গিত এখন পরিস্কার। বাইডেনের শপথ নেয়ার দুমাসের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে বহু উলট-পালট হতে শুরু করেছে। আর এরই মাঝে বাইডেনের নিজের ফরেন পলিসির প্রায়োরিটি এর নিজের নতুন বৈশিষ্টগুলো নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসা মাত্র পালটা প্রতিক্রিয়াও শুরু এবং তা থেকেই নতুন করে নতুন পোলারাইজেশন এবং তা ব্যাপকভাবে ঘটতে শুরু করেছে। এছাড়া আবার  এককথায় মেরুকরণ যা ভাবা হয়েছিল বাইডেলের আমলে পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই বাইডেনের ইচ্ছা আকাঙ্খার বাইরে চলে যাচ্ছে। যেমন, কোয়াড থেকে ভারতকে বেরিয়ে যেতে হবে – এটা ধরে নিয়ে ভারত ইতোমধ্যেই আগানো শুরু করে দিয়েছে।

 এবার পোলারাইজেশনের রঙ্গমঞ্চ বঙ্গোপসাগরঃ আগের অনুমিত সাউথ চায়না সি,যেটা সমুদ্রপথে চীনে প্রবেশমুখ, ঠিক সেটা এখানে আর মূল রঙ্গমঞ্চ বা থিয়েটার থাকছে না। নতুন কেন্দ্র হতে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। এর উপর আবার এতে ভারত, বাংলাদেশ বা মায়ানমারের – এভাবে বঙ্গোপসাগর এই তিনদেশের  মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরই হচ্ছে ফোকাস।  অন্তত আমেরিকান ফোকাস। কেন এমনটা ঘুরে গেল?

দুটা কারণে এই পরিবর্তন। পরপর বলে যাব। তবে পাঠক চাইলে নিজের মত আগেপিছে করেও পড়তে ও বুঝতে পারেন।

প্রথমটাঃ  এখানে পরপর দুটা ট্রিগার টিপা হয়েছে। প্রথম ট্রিগার টানার ঘটনাটাই প্রথমে রেখে বলছি। এশিয়ায় আমেরিকা নতুন রূপে হাজির হয়েছে, এটাই ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের হানিমুনের সমাপ্তি ঘোষণার ট্রিগার হতে যাচ্ছে। চীনবিরোধী আমেরিকা-ভারত এই ঘনিষ্ঠতার ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক পুরানা, তৈরি শুরু ২০০৪ সালে। অবশ্য এরও আগেই বিজেপির বাজপেয়ির আমলে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের নৌকায় ভারত নিজ কিছু শর্ত দিয়েছিল যে তাদের আতঙ্কবাদের (মানে পাকিস্তানকে টেরর-কান্ট্রি ধরে নিয়ে সেই চোখে দেখতে হবে) উঠে গিয়েছিল। পরে ভারতের ২০০৪ সালের মে মাসে মনমোহন সিংয়ের প্রথম টার্মের প্রধানমন্ত্রীত্ব শুরু হয়েছিল। আর ২০০৬ সালের মার্চে বুশ প্রথম ভারত সফরে আসেন। আর তাতে যুগান্তকারি ঘটনা ছিল প্রথম আমেরিকান অস্ত্র এমনকি পারমানবিক কাঁচামালও ভারতকে বিক্রি এবং ভারতকে চীনবিরোধী করে (বয়ান মুখে তুলে দেয়াসহ) আকার-প্রকার দেয়া সবই এই সফর থেকে শুরু হয়েছিল। এরই ফরমা্ল নাম ছিল চায়না কনটেইনমেন্ট মানে চীন ঠেকানোর কাজটা ভারতকে ঠিকা দেওয়া।
আমেরিকার এতে মূল উদ্দেশ্য ছিল রাইজিং ভারতকেও চীনেরবিরুদ্ধে ব্যবহার। কিন্তু মুদ্রার এপিঠের উল্টোদিক মানে তাতে আমেরিকান উলটা আরেক ফরেন পলিসিও ছিল, যেটা তখন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সেটা হল, বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান সপ্তম নৌবহর স্থায়ীভাবে নোঙর করার ইচ্ছা। যেটাকে ভারত জেনে সবসময়ই দেখে এসেছে গরীবের একতলা বাডির পাশেই বড়লোকের সাততলা বাড়ি বানানো আর ভারতের ঘরের ভিতরে কী ঘটছে সেদিকে নজরদারির চোখ ফেলা। আমেরিকা তার এই লুকিয়ে ফেলে রাখা জিনিষটা এতদিন লুকিয়ে রেখেই চীনবিরোধী নানাকিসিমের “ভারত-আমেরিকান সহযোগিতা” বলে ভারতকে দিয়ে কাজ করিয়ে চলছিল। সেটাই এবার স্থগিত, একাবারেই শুকিয়ে যাবে।

কারণ, বাইডেনের আমলে তিনি এখন চায়না কনটেনমেন্টের চেয়েও বঙ্গোপসাগরে পড়শি সকলের ঘরে নজরদারি ফেলা – এটা আমেরিকার জন্য গুরুত্বপুর্ণ স্বার্থ মনে করে আগানো শুরু করেছে। মানে এতদিন এশিয়ায় ভারতের পড়শিদেশগুলোতে (বা ভারতের কথিত নিজ-প্রভাবাধীন অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর) সবখানে চীন ঢুকে পড়তেছে বলে অনবরত খামোখা ভারতের ন্যাগিং দেখছিলাম আমরা। যার ভিতর আমেরিকা ভারতকে আরো তাল দিত, আর বলত চীন ভারতকে নাকি মুক্তামালার মত ঘিরে ফেলছে। কিন্তু এখন? সেখানে এখন চীন-ভারতের কথিত প্রতিযোগিতার মধ্যেই বাইডেনের আমেরিকা নিজেও এক প্রার্থী হিসাবে মঞ্চে হাজির হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এনিয়ে হাতের কাছে ভাল ইঙ্গিত-প্রমাণ হল, আলী রীয়াজের প্রস্তাব বাংলাদেশ যেন আমেরিকার সাথে মিলে “বঙ্গোপসাগরকে হাব” বানায় অথবা “বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই উচিত নিজেদের স্বার্থ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া”……।

আমেরিকান এমন অবস্থান থেকেই আসলে ট্রিগার পয়েন্ট হল বাইডেনের আমেরিকার “বঙ্গোপসাগরের খায়েস” প্রকাশ হয়ে পড়া। কিন্ত এথেকে ভারতের প্রতিক্রিয়ায় তাতে এরচেয়েও বড় ট্রিগার টিপতে প্রস্তুত এখন ভারত। কি সেটা?

দ্বিতীয়টাঃ আগেই বলেছি আমেরিকার এতদিন লুকিয়ে রাখা এই খায়েস যেকোন সময়ের জন্যই ছিল ভারত-আমেরিকার মাঝে চরমতম শত্রুতা শুরু করার সুপ্ত পয়েন্ট। ভারত এতই কঠোরভাবে সবসময় আমেরিকান এই খায়েসের বিরুদ্ধে ছিল ও আছে। ভারতের এত শত্রুতা-জ্ঞানবোধ চীনের বিরুদ্ধেও সম্ভবত নাই। ভারতের সব সরকারই এবং ইল্টেলেক্টরাও মনে করে এসেছে এটা ভারতের জন্য এতই ক্ষতিকর যে আমেরিকা এতে ভারতের সব উত্থান সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিবে। তাই বাইডেন যতটা না ট্রিগার টেনেছেন এর চেয়েও প্রকাশ্যে ট্রিগার ইতোমধ্যেই ছোড়া শুরু করে দিয়েছে ভারত। এরই একটা পর্ব ছিল ২৬ মার্চ মোদীর বাংলাদেশ সফর। সেটা কী রকম?

কমন এনিমির বিরুদ্ধে এক হওয়াঃ  অর্থাৎ এবার আমরা জানতে পারছি যে  এতদিনের ভারত-আমেরিকার চীনবিরোধী যে গভীর আত্মীয়তা চলেছিল এর দিন শেষ হয়েছে। আমেরিকাই এখন ভারতের প্রধান এনিমি। এদিকে আমরাও অনেকবার দেখেছি ও বলে এসেছি যে, আমাদের সরকার গত চৌদ্দবছরের চড়াই-উত্রাইয়ে  সবচেয়ে কম আস্থা রেখে এসেছে আমেরিকার উপর; তা সে ওবামা,  ট্রাম্প বা বাইডেন যারই আমেরিকা হোক। এমনকি সরকারের আয়ু বাড়ানো প্রস্তাব বা আলী রীয়াজের প্রস্তাব যতই লোভনীয়ভাবে হাজির করা হোক না কেন এথেকে দূরে থাকলেই তা সরকারের আয়ুর স্বার্থে যাবে বলে আমাদের সরকার মনে করে এসেছে।  এই সুত্রেই  এবার মাঠে ভারত-বাংলাদেশ দুই সরকারের এক কমন এনিমির আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থানের প্রশ্নে ঘনিষ্ট হওয়া ও পরস্পরকে রক্ষায় সহায়তা করার এক বাস্তবতা হাজির হয়েছে, মনে হচ্ছে। প্রায় ঠিক যেমনটা এর আগে সুজাতা সিংয়ের সফর থেকে ২০১৪ সালের শুরুতে যে নির্বাচন ওর প্রাক্কালে যেটা হয়েছিল। অনুমান করা যায় গত ২৬ মার্চ ছিল এই গুরুত্বপুর্ণ প্রসঙ্গে তাদের সিরিয়াস আলোচনার এক ভাল সময়। এটাই স্বাভাবিক।

তাহলে বাইডেন কী বোকা মানুষ, তিনি কেন বঙ্গোপসাগর সেভেন্থ-ফ্লিট মোতায়েনের আকাঙ্খার ইঙ্গিত এসময় হাজির করতে এলেন? না; অবশ্যই তিনি বোকা নন। মূল কারণ ইতোমধ্যেই  আমেরিকা ভারতকে কোয়াড থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে এর সম্ভাবনা শুরু হয়েছে। যেমন ব্যাপারটা দেখছে রাশিয়া। রাশিয়ান ভাষ্য হল, US Will ‘Expel’ India From Quad।   আবার ভারত নিজেই নিজেকে কোয়াড থেকে বের করে নিতে যাচ্ছে তা আসন্ন  – এটা ভারত-আমেরিকা দুপক্ষের কাছেই পরিস্কার হয়ে উঠেছে। কিভাবে?

দুই ইস্যু এস-৪০০ আর হিউম্যান রাইটঃ
এস-৪০০ এটা রাশিয়ার তৈরি এক এন্টি এয়ারক্রাফট সিস্টেম যা আমেরিকার এফ-৩৫ এর মত যত বোমারু বিমান আছে সেসবের ‘যম’ মনে করা হয়। যেমন আমেরিকার ভাষায়, “এস-৪০০ এর কাছাকাছি স্থানে এফ-৩৫ চালানো অনুচিত”। কারণ, তা ঐ বোমারু বিমানকে নামিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এনিয়ে আমেরিকার মূল নীতি অবস্থানটা হল আরো কঠিন। তা হল, একই দেশের হাতে একসঙ্গে এস-৪০০ আর এফ-৩৫ এর মত কোন বোমারু বিমান থাকতে পারবে না। তাই সোজা সিদ্ধান্ত যে দেশ এস-৪০০ কিনবে আমেরিকা তার উপর বাছবিচার ছাড়াই অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করবে। অনেকেই ভেবেছিল এটা বোধহয় কেবল পাগলা ট্রাম্পের কথা। কিন্তু এখন সবাই পরিস্কার যে এটা বাইপার্টিজান – খোদ পেন্টাগনের অবস্থান। তাই যে এস-৪০০  কেনাটা শুরু হয়েছিল তুরস্ককে দিয়ে তা এখন পাকিস্তান, ভারতসহ যারা যারা এমন যে কেউ কিনবে ভেবেছে, তারা সবাই আবার সাথে ভেবেছিল যে কেবল তার বেলায় অনুরোধ করলে আমেরিকান প্রশাসন বিশেষ ছাড় দিবে – কিন্তু এখন সবাই বুঝে গেছে, এটা সবার ক্ষেত্রেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
শুধু তাই না, ব্যাপারটা আরো এগিয়ে কঠিন হয়েছে ভারতের বেলায়। এপ্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান অনেক শক্ত ও আগাম নির্ধারিত। এতদিন  ভারত মনে করে এসেছিল ভারতকে আমেরিকারই নিজ স্বার্থে দরকার আর ভারতও রাইজিং। ফলে আমেরিকা যদি বিশেষ ছাড় না দেয় তবে ভারত আমেরিকাকেই ত্যাগ করে হলেও এস-৪০০ কিনে নিজের সামরিক বহর সাজাবেই। এই প্রসঙ্গে সর্বশেষে দেনদরবার হয়ে গেল গত ১৯ মার্চ থেকে তিনদিনের বাইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের ভারত সফরে [Russian Arms Sale Clouds U.S.-India Ties]। এতে দুপক্ষই কড়া শেষকথা শুনে বুঝে যায় কোন পক্ষই সরতে পারছে না।
ওদিকে ইতোমধ্যে বহু আগে মানে নির্বাচনে প্রচারণার সময় থেকেই বাইডেন পরিস্কার করে উল্লেখ করে আসছেন কাশ্মীর ইস্যু ও মুসলমানদের উপর হিউম্যান রাইট ভায়োলেশনের ইস্যুতে তিনি ক্ষমতাসীন হলে সরব অবস্থান নিবেন।  কিন্তু এদুটাই মোদীর ভারতের নির্বাচনে হিন্দু মেরুকরণ করে তাদের ভোট বিজেপি-বাক্সে তোলার গুরুত্বপুর্ণ কৌশল যা তিনি কোনভাবেই ত্যাগ করতে চান না বা পারবেন না। অতএব এস-৪০০ আর হিউম্যান রাইট – এদুই বড় সংঘাতের ইস্যুতে আমেরিকা-ভারত বিচ্ছেদের ঘোষণা এখন  যেকোন সময়ের ব্যাপার।

ইতোমধ্যেই প্রথম প্রকাশঃ বার্মা
গত শনিবার ২৭ মার্চ ছিল বার্মার সামরিক বাহিনী দিবস। মায়ানমার যা কার্যত সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন এক রাষ্ট্র সেখানে এই দিবসের তাতপর্য আমরা অনুমান করতে পারি। এক রিপোর্ট বলছে, বার্মায় ৪২ বিদেশি মিশন আছে যাদের এমবেসিতে “মিলিটারি এটাসে” পদ আছে আর তাতে কেউ আসীন হয়ে বার্মায়  উপস্থিত  আছেন। এদের মধ্যে আটজন এটাসে [attaché] ঐ প্যারেড অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।  জাপানি নিক্কি পত্রিকা বলছে ঐ দেশগুলো হল, Russia, China, India, Pakistan, Bangladesh, Vietnam, Laos and Thailand ।  মানে ঐ আট রাষ্ট্রের মধ্যে ভারত গুরুত্বপুর্ণ এক রাষ্ট্র। এর মানে  যে ভারত  তার কোয়াডের সব বন্ধুদের  ত্যাগ করেছে যা পক্ষ বদল করেছে বলা যায়, আর এভাবে প্রকাশ্যে তার মিলিটারি এটাচে হিসাবে একজন ঐ প্যারেডে যোগ দিয়েছিল। এমনকি  বাংলাদেশও রোহিঙ্গা ইস্যু বর্তমান তাসত্বেও “ব্যবহারিক কারণে”, [pragmatic attitude]ভারত-চীন-রাশিয়াকে অনুসরণ করেছে। তার চেয়েও বড় কথা এতে সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী অতিথি ছিলেন রাশিয়ার ডেপুটে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্দার ফোমিন।
মূলকথা,বাইডেন তার নিজের পলিসি-স্বার্থগুলো খুলে বসাতে এবার নতুন করে এক ব্যাপক গ্লোবাল পোলারাইজেশন এর বাস্তবতা হয়ে গেছে। শুধু তাই না এই আট দেশের মিলিটারি এটাসে দের একসাথে অংশগ্রহণ এটা যেন বাইডেনের বিপরীতে চীন-রাশিয়া পক্ষ দেখাতে চেয়েছে যে তাদের পক্ষে কে কে আছে। আসলে ভারত পক্ষ বদলিয়েছে এটাই পুরা প্রদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। আর যেন বাইডেনকে দেখানো যে তোমার পক্ষের ভারত আর তোমার সাথে নাই।

কে কোন পক্ষে থাকছেঃ
জিনজিয়াং-উইঘুরে মানবাধিকার ভায়োলেশন ইস্যুতে বাইডেন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সাথে পেয়েছিল। একসাথে তারা এই ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান দেখিয়েছিল। কিন্তু তাতে আবার বড় ক্ষত ও বাইডেনের দুর্বলতার দিকটা সব সময় আছে যে, উইঘুরে মানবাধিকার নিশ্চিত করার চেয়ে চীনবরোধী জোট পাকায়ে চীনের থেকে বৈষয়িক সুবিধা হাসিল করা এতদিন পশ্চিমের মূল উদ্দেশ্য  হয়ে এসেছে।  সোজা কথায়,  পশ্চিম এখন পর্যন্ত সবসময় এভাবে মানবাধিকার ইস্যু তুলেছে কিন্তু শেষে তা বিক্রি করেই খেয়েছে। কাজেই পশ্চিম এই নৈতিকতার সংকট খুবই মারাত্মক থেকেছে। যেমন বার্মার ২০০৮ সালের গঠিত কনস্টিটিউশনে  আর্মি রাজনীতিতে অংশ নিবে সহ সব নির্বাহী ক্ষমতার ভাগীদার থাকবে  – সেকথা লেখাই আছে। আর সেসব কথা থাকা সত্বেও কি আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম জেনারেলদের প্রশংসা করে গো এহেড অনুমোদন দেয় নাই, জেনারেলেরা গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু কল বলে সার্টিফিকেট দেয় নাই? তাহলে আজ প্রতিদিন বার্মায় প্রতিবাদকারিরা হত্যার শিকার হলে এখন সহানুভুতির নাকিকান্নার উদ্দেশ্য কী? ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা খেদানো যখন চলছিল তখন আমেরিকা চীন-ভারতের সাথেও গলা মিলিয়ে কথিত আরসা আক্রমনের গল্প ফেঁদেছিল যেটা ছিল বার্মার জেনারেলদের হল্প আর সেটাই আমেরিকানেরা আমাদের কাছে সাফাই দিয়েছিল যে আরসার কথিত আক্রমণের কারণেই নাকি পাল্টা রোহিঙ্গা খেদানোর শুরু।
সোজা কথায় মানবাধিকারের ইস্যু বিক্রি করে চীনের কাছ থেকে সুবিধা আদায় – এদিকটাই প্রধান পশ্চিমা স্বার্থ, সেটাই অনেকদিন থেকেই এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে।  ফলে বাইডেনের যে মেরুকরণ দাড়াচ্ছে চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে – এই বাইডেন জোট এখনও বড় বড়  নৈতিকতা সংকটে আছে এবং থাকবে।

ফলে বাইডেনের জোট -কোন নৈতিক বা নীতি-পলিসিগত ভিত্তির সমস্যায় আছে  ও এমন ইমেজ সংকটে হাজির হয়েছে। আর এমন মিস-ফায়ার হওয়াতে এর সুযোগ নিয়ে পালটা চীন-রাশিয়ার জোটে আর তাতে (কোয়াড ভেঙ্গে) ভারতের যোগ দেয়া আর তাতে হবু বাংলাদেশ বা বার্মার যোগদান – এটাই বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক নতুন রঙ্গমঞ্চ।

সবমিলিয়ে বাইডেন যা করলেন তাতে তার পক্ষীয় জোটের নৈতিক বা গ্লোবাল কমন পলিসিগত শক্ত ভিত্তির উপর দাড়ানোর প্রশ্নে তিনি মারাত্মক খাটো হয়ে হাজির হলেন। শুধু তাই না, আবার একই সাথে তারা দুপক্ষজোটের সামরিক ঝোঁকগুলোকে তিনি জেনে অথবা না-জেনে উসকিয়ে দিলেন যা খুবই অবিবেচক অবশ্যই!

সর্বশেষ জন কেরিঃ
জন কেরি ক্লাইমেট ইস্যুতে বাইডেনের বিশেষ দুত। তিনি আগামি ৯ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন। সম্ভবত আগামি ২২ এপ্রিলে ওয়াশিংটনে যে ৪০ দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে এর দাওয়াত দিতে। আর সেখানে কী সাইড লাইনে আলী রীয়াজ যেভাবে বলেছিলেন “বঙ্গোপসাগরকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা  আর অর্থনৈতিক করিডরের একটি ‘হাবে’ পরিণত করার আলাপ প্রস্তাব – সেটাই কী সেরে নেয়া হবে? মনে হচ্ছে সেটাই এজেন্ডা। যদি তাই হয় তাহলে একদিকে বাংলাদেশ নিয়ে মানবাধিকার অবণতির রিপোর্ট আর এদিকে এমন বঙ্গোপসাগর এজেন্ডা – ঠিক এটাই বাইডেনের জোটের সংকট, এই চরম নৈতিক সংকটের কারণের তার জোট ও তিনি ঠুঠো আর ধান্দাবাজ বলেই মানুষ দেখবে!
বাইডেনকে একটা বেছে নিতে হবে – বঙ্গোপসাগর না হলে মানবাধিকার!

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s