বাংলাদেশে চাপ বাড়ার সম্ভাবনা
ইউক্রেনের পরে বাইডেন পাকিস্তানেও হেরে গেল
গৌতম দাস
৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫ঃ১৯ সোমবার
_ Another failure for Biden, Messing up, Biden-style
এলেখার প্রসঙ্গ পাকিস্তান লেটেস্ট পরিস্থিতি। কিন্তু শুরুতে এর বৃহত্তর বা গ্লোবাল দিক যার মধ্যে -পাকিস্তান একটা রঙ্গমঞ্চ- সেই বৃহত্তর দিকটা একটু আগে ঘুরে আসব।
ইউক্রেনের পর এবার পাকিস্তানেও বাইডেন হারলেন। ইউক্রেনের কথা কেন? ফরেন এফেয়ার্স (ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের কথা বলছি না) [Foreign Affairs Magazine] মূলত আমেরিকান পাওয়ার এলিট তাদের সার্কেলকে ইনফর্ম রাখার এক ত্রৈমাসিক। যেমন ধরেন যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় হিলারি ক্লিনটনের আর্টিকেল ছাপা হয়। কিন্তু আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স [DNI, Office of the Director of National Intelligence] ] এর সার্ভে রিপোর্ট যা চার বছর পর পর নিয়মিত বের হয় – তাতে বলা হয়েছে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের গ্লোবাল ট্রেন্ড হল ক্যাপিটাল মুভমেন্ট পশ্চিম থেকে নিরন্তর পুবে প্রবাহিত হওয়া শুরু করেছে। এবং এই প্রবাহ ই-রিভার্সিবল [irreverseble]। মানে বাংলায়, তা আর কখন উলটা বাইবে না, আগামি কোন একদিন আবার পুব থেকে পশ্চিমা দেশে ফিরবে না। অতএব উপায়ন্ত না দেখে এমন সব পশ্চিমা পত্রিকায় নয়া দুটা অভিমুখ তৈরি হয়েছে। এক হল তাঁরা সাপ্তাহিক-ত্রৈমাসিক রেখেও পাশাপাশি একটা ওয়েব ডেইলি ভার্সানও চালু করেছে। আর দ্বিতীয়ত তাঁদের ফোকাস আর আগের মত পশ্চিমের পাঠকই নয়। বরং পুবের পাঠক-লেখক যারা পুবের (এশিয়ার) জনমত তৈরি ও প্রভাবিত করে থাকে তাদেরকে টার্গেট করে পরিচালিত করা শুরু করেছে।
সম্ভবত সেকারণেই ফরেন এফেয়ার্স এর ৩০ মার্চ এই রিপোর্টের মুল্যায়ন বাইডেনের আমেরিকা ইউক্রেনে মস্কোকে “ঠেকাতে গিয়ে পরিস্কারভাবে ফেল করেছে” [… deterrence clearly failed] । গ্লোবাল নেতৃত্ব পর্যায়ে কী ফাঁপা হামবড়ার কোন জায়গা আছে, না থাকতে পারে? বাইডেনের দুই অস্ত্র অবরোধ আরোপ আর মানবাধিকারের অভিযোগ এদুটা দ্যেই তিনি বিনা অস্ত্রে আর বিনা পোয়সায় সবখানে চীন (সাথে রাশিয়া)কে ঠেকায় দিয়ে আসতে পারবেন। এটাই নাকি ট্রাম্পের উপর বাইডেনের শ্রেষ্ঠত্ব। এরই প্রথম পরীক্ষার মাঠ ছিল ইউক্রেন। এখন ফরেন এফেয়ার্স বলছে বাইডেন, ক্লিয়ারলি ফেইলড। তাই এই ম্যাগাজিনের সাজেশন আমেরিকার উচিত রাশিয়ার সাথে আপোষ করে নেওয়া [Compromising With Putin May Be America’s Best Option]।
তা না হয় হল, কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হবে না। কারণ আমেরিকান রাজনীতিতে এবারের মিড টার্ম বিশেষ তাতপর্যপুর্ণ। মিড টার্ম মানে এখানে ঠিক গত ২০২০ সালের এই নভেম্বরেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত বাইডেন জিতেছিলেন। আর এবার প্রসিডেন্টের চার বছর ট্রার্মের মাঝে দুবছরের মাথায় আমেরিকান সসদ ও সেনেটের নির্বাচন হবে। তবে সব আসনে না, এক-তৃতীয়াংশ আসনে। তাই এটা প্রেসিডেন্টের মিড টার্ম হলেও তার কোন নির্বাচন হবে না, হবে তার দলের প্রতিনিধিদের। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের দলকে পাবলিকের মুখোমুখি হতে হবে। আর সেখানেই প্রেসিডেন্টের পারফরমেন্স মানেই তা দলের পারফরমেন্স হিশাবে বিচার-পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট তার শাসনের দুরবছর সমাপ্তিতে এক পরোক্ষ মুল্যায়নের মুখোমুখি হবেন, সামনের নভেম্বরে।
আর এখানেই টাম্প ও রিপাবলিকান দল বাইডেনকে তুলাধুনা করবেন – বিশেষত ইউক্রেন নিয়ে তার অবরোধ আর মানবাধিকার অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে।
অতএব এর আগেই বাইডেনকে তার এদুই অস্ত্র অন্য এক-দুইটা দেশেও প্রয়োগ করে তাতে ফল পেতে হবে। তাহলে হয়ত আগামি নভেম্বরে তার ইজ্জত কিছুটা ফিরতে পারে। এই বিচারে পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা মায়ানমার এরা হয়ে উঠতে পারে সেই “অন্য দেশ” যেখানে বাইডেন তাঁর দুই অস্ত্র প্রয়োগে মরিয়া হয়ে উঠার সম্ভাবনা এখন প্রবল হল।
পাকিস্তানে দাড়ালোটা কী?
ইউক্রেনের মত আপাতত পাকিস্তানেও বাইডেন হেরে গেলেন। কিভাবে?
মোটা দাগে পাকিস্তানে স্বার্থ বা পক্ষ চারটা। বাইরে থেকে তা যদিও দুইটা – ইমরান ও তার বিপক্ষ মনে হবে। কিন্তু না; কার্যত এখানে সক্রিয় পক্ষ হল চারটা; – ইমরান, বিরোধীজোট, সেনাপ্রধান বাজওয়া আর বাইডেনের আমেরিকা। আর প্রকাশ্যে যে দ্বন্দ্ব বা ইস্যুকে সামনে রেখে এই লড়াই তা হল সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষ-বিপক্ষে ভোটাভুটি।
এবার বল গড়ানো শুরু হয়েছিল বিরোধী জোটের সেকেন্ড টাইম ইমরানের সরকার ফেলানোর উদ্যোগ থেকে। বিরোধী জোট মানে নওয়াজ পরিবার, ভুট্টো পরিবার আর মাওলানা ফজলুর। ইনিওই এখন পাখতন প্রদেশ ইমরানের কাছে হেরে এককথায় বললে মোস্ট এন্ড ডেসপারেট করাপ্ট কিছু লোক যারা হল গত বিশবছরে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের ফ্যান্টাসি আর তারাই একক পরাশক্তি এটা দেখাতে গিয়ে যেভাবে আজ দেউলিয়া অবস্থায় এই সময়কালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তি বলে যেসব প্রডাক্ট মানে “আবর্জনা” তৈরি করেছিল তারাই। যাদের কাজই ছিল আমেরিকার জন্য সমর্থন তৈরি করে হাতিয়ার হওয়া আর বিনিময়ে দুইহাতে পয়সা লুটে নেওয়া। যাদের স্টেক হল বিলিয়ন ডলারের। যাদের মধ্যে নওয়াজ সবচেয়ে উচ্চমার্গের ফলে তিনি পানামা ফাইলসে নাম লেখানোর গৌরবান্বিত এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে সাজাপ্রাপ্ত, জরিমানা আর রাজনীতি নিষিদ্ধ ব্যক্তিত্ব।
বাইডেন এদের ঘাড়ে চড়েই ইমরান স্বাঢীন পররাষ্ট্রনীতি বলে রশিয়ায় ডানা মেলে উড়ান দেওয়ার ডানা ছাটতে নেমে পরেছিল। যদিও এই জোট আর বাইডেনের এবারের লক্ষ্য চাওয়া-পাওয়ায় ভিন্নতা ছিল। জোট চেয়েছিল ক্ষমতা যাতে তাদের চোর ইমেজ কাটে, শাস্তি ফাইন বা নিষেধাজ্ঞা মুছে যায়, ইমরানকে যেকোন ভাবে শাস্তি দিয়ে দেখাতে পারে তাঁরা ততটা চোর না, এটা ইমরানের কারসাজি ইত্যাদি। ভুট্টো পরিবারের ১০% ইমেজ লঘু হয়, মাওলানার অনৈতিক ইমেজ মুছে যায় ইত্যাদি। কিন্তু বাইডেনের লখ্য ছিল ওয়ার অন টেররের ক্ষত ও ক্ষতি কমানো। সুনির্দিষ্ট করে পাকিস্তানে সামরিক ঘাটী করে আফগানিস্তানে নতুন করে প্রভাব তৈরি করে যেটা ইমরান সরাসরি প্রত্যাখান করে দিয়েছে আগে। এককথায় চীনকে চ্ছাপিয়ে যতটা সম্ভব নিজের পুরানা প্রভাব ফিরিয়ে আনে। সেকারণে সেনাবাহিনী ও ইমরানসহ সব রাজনৈতিক শক্তিকেই নিজ অধীনস্ততার বলয়ে আনা। যাতে চীনের জন্য কোন পা রাখার জায়গা না থাকে। এখানেই বিরোধী জোটের সাথে বাইডেনের লক্ষ্যের ফারাক।
একারণেই সংসদে আনাস্থা ভোটাভুটিতে ইমরান যেন পরাস্ত হয়ে যায় এর আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে মনে করার পরে আমেরিকা বাজওয়াকে দিয়ে ইমরানের কাছে সংসদ ভেঙ্গে দেবার প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। পায় প্রকাশ্যেই সবাই দেখেছিল ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় বাজওয়া ইমরানের সাথে দেখা করতে গেছেন। মজার দিকটা হল, বিরোধী জোট অখুশি হয়েছে কিন্তু প্রকাশ করে নাই। ইমরানও বুদ্ধিমান হয়েছে – হা-না কিছু না বলে ধৈর্য ধরে শুনেছে। তবে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল জেনারেল বাজওয়া।
কারণ এই প্রথম তার আলাদা স্বার্থ আলাদা প্লেয়ার যে তিনি আরেক টার্ম প্রধান থাকার খায়েস – স্পষ্ট হয়েছিল। একারণে তিনি ঐ সভায় নিজেকে ইমরান সরকারের সেনাপ্রধান নয় বরং বাইডেনের পক্ষের দুত যেন – এভাবে হাজির করেছিলেন। যেন অনেকটা বাইডেন-ইমরান দ্বন্দ্বে মধ্যস্ততাকারিও – তবে এই শর্তে যে তার টার্ম বাড়ানোতে উভয়ে তাঁরা সম্মতি দিবে। এতে তিনি এতই বেপরোয়া ও আদব-লেহাজ বিহীন এক ব্যক্তি হিশাবে উপস্থাপন করেন যে এই লোক কোন সেনাপ্রধান দূরে থাক বাসার দাড়োয়ানও যতটা নিজ মর্যাদা রাখতে সচেতন চেষ্টা করে উনার সেটুকুও যে নাই, উনি সেই হুশ হারায় ফেলেছেন।
তিনি পরের দুইদিন ধরে লাগাতর বলা শুরু করেন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া রাশিয়ান ‘আগ্রাসন ক্ষমার অযোগ্য’। মানে যে কথা বাইডেন বলেও প্রতিষ্ঠা করতে হিমসিম উনি সেকথা বলছেন এক তাও আবার নেহায়তই এক সেনাপ্রধান। সারা দুনিয়ার আর কোন সেনাপ্রধান এমন কথা বলে নাই। ইইউ এর ২৭ দেশে নিশ্চয় ২৭ সেনাপ্রধান জীবিত আছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে তাদের স্বার্থ তো প্রত্যক্ষ। অথচ মিডিয়ায় তাঁরা রাজনৈতিক বক্তব্যে হাজির নন। কারণ বাজওয়াকে আরেক টার্ম চাকরি পেতে হবে, এতই দুখি আর গরিব তিনি…যে চাইতেও জানেন না।
তিনি এটুকুও বুঝেন নাই তার এই সমর্থন বাইডেনেরও কাজে আসবে না। কারণ, ইমরানের বিজয় ডঙ্কা ঘোষিত হয়ে গেছে যখন তিনি পাকিস্তানের জাতীট নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি) সভায় উপস্থিত থেকেছেন। এবং বাজওয়াসহ সিভিল-মিলিটারি প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানে আমেরিকার হস্তক্ষেপের জন্য কথিত সেই চিঠি বা পাকিস্তানী রাষ্টদুতকে দেয়া হুমকির নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তান সরকার সেই সভা থেকেই পালটা আমেরিকাকে প্রতিবাদী নোট পাঠিয়ে দিয়েছে। যে জেনারেল আমেরিকাকে প্রতিবাদী নোট পাঠানোর পক্ষ হয়ে যায় সে এর পরে আর কীভাবে আমেরিকাকে খেদ্মত করবে!!!
এককথায় এদিন ইমরানের কাছে বাকী তিন পক্ষই (বিরোধীজোট, সেনাপ্রধান বাজওয়া আর বাইডেনের আমেরিকা) পরাজিত হয়ে গেছে।
এখন ইমরান তার শেষ ট্রার্ম কার্ড শো করে দিয়েছেন। তিনি সংসদ ভেঙ্গে এখন নতুন নির্বাচনের দিকে পরিস্থিতি ঠেলে দিয়েছেন। এটাকে অনেকে মনে করতে পারে যে ইমরান আমেরিকান প্রস্তাব-ই গ্রহণ করেছে। না, এটা ভুল অনুমান হবে। দুটাই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হলেও দুটার অর্থ ও তাতপর্য আলাদা। এক হলে আমরা দেখতাম আমেরিকা ও বাজওয়ার মুখ্য ভুমিকা। আর সবচেয়ে বড় কথা আমরা বিরোধী জোটের এখন আদালতে দৌড়াদৌড়ি ্দেখতাম না।
এতে পাকিস্তানে আমেরিকান অবস্থান আবার বিরোধী জোটের পিছনে বা নিচে। যার অর্থ আমেরিকা পাকিস্তানেও হেরে গেছে।
এখান থেকে অন্য এক ইঙ্গিতঃ
যার সোজা অর্থ বাংলাদেশে বাইডেন এখন আরো সক্রিয় হবেন। তাকে তাঁর দুই অস্ত্র – অবরোধ আর মানবাধিকার – যে খুবই কার্যকর অস্ত্র এটা তাকে দেখাতে, প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। অতএব বাংলাদেশ হয়ে উঠল সম্ভাব্য বাইডেন সবচেয়ে সক্রিয়তা আর চাপের মুখে থাকা দেশ!!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com