ব্রিকস বুঝাবুঝিতে পিছিয়ে – আমার কেন আদার বেপারী 


ব্রিকস বুঝাবুঝিতে পিছিয়ে – আমার কেন আদার বেপারী
গৌতম দাস

২৫ জুন ২০২৩  সকাল ০৮ঃ ০৪

https://wp.me/p1sCvy-4EQ

 

          BRICS

আবার ব্রিকস [BRICS]! বাংলাদেশে এনিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে! তাতে এর সবটা না হোক মূল বিষয়টা কী তা বুঝি -না-বুঝি, অনেকেই এতে মেতে উঠেছে এই মনে করে যেন এটা বাইডেনের আমেরিকার বিরুদ্ধে চীনের এক কড়া সিদ্ধান্ত-পদক্ষেপ।  আর হাসিনা বাংলাদেশকে ব্রিকসে নিয়ে উঠালে মানে সদস্য  করে ফেললে তা বাইডেনের আমেরিকাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। অথবা বাইডেনকে যেন এক কড়া জবাব দেয়া হবে। এই ভুল অনুমানের উপর মিডিয়া গরম!  কারণ ব্রিকস মানে যেন একটা অর্থনৈতিক পক্ষ-জোট!  এই এজাম্পশন বা ধরে নেওয়া অনুমান একেবারেই ভিত্তিহীন! এক ভুল অনুমান!  দাঁড়ানো এক ভুল বুঝাবুঝি! 

কথা আরো আছে তাহলে ব্রিকস যদি নেহায়তই এক আমেরিকাবিরোধী অর্থনৈতিক জোট হয় আর এর জন্ম মাত্র ২০০৯ সালে – সেটা কী ২০০৯ এর জায়গায় গত শতকে ধরা যাক ১৯৯০ এর দশকে হত তবে কী এটা আমেরিকাকে আরো আগে বধ করে ক্ষতিগ্রস্থ করে দিতে পারত না? ব্যাপারটা কী তাই?  তাহলে তো এই প্রশ্নেরও জবাব পেতে হবে যে ব্রিকস উদ্যোক্তারা সেটা করে নাই কেন?  সারকথায় ব্রিকস কখন কার্যকর হবে – খুলবে  সেই সময় নির্ধারণ – সেটা কী উদ্যোক্তাদের ইচ্ছাধীন? নাকি অন্য কোন শর্ত (অবজেকটিভ) বা কিছু পুর্ব-প্রস্তুতি পূরণ  আগে হতে হবেই যেটা চীনের ইচ্ছাধীন নয়?  এই জবাবটা এখনই দিয়ে নেই। এটা চীন বা আমেরিকাবিরোধী কারও ইচ্ছাধীন নয়। বরং বেশকিছু বিষয়কে বাস্তবে যোগ্য হয়ে উঠতেই হবে, পেকে উঠতে বা যোগ্য- ম্যাচিউরিটি -তে পৌছাতে হবেই! যা এখনও হয় নাই। তবে হওয়ার দিকে হাঁটছে! এছাড়া আগেই বলেছি এটা কোন অর্থনৈতিক জোট একেবারেই নয়। কোন আশিয়ান [ASEAN] অথবা RCEP [Regional Comprehensive Economic Partnership ] ধরণের বিশেষ অর্থনৈতিক জোট একেবারেই নয়! তাই এটা ঠিক কে অ্যামেরিকান আর কে চীনের পক্ষ নিয়ে কথা বলব আর এই ভিত্তিতে কাকে সঠিক বলব ব্যাপারটা মোটেও তা নয়!  

অতএব, এমনই অনেকগুলো ভুল বুঝাবুঝির মধ্যে প্রথম এক সমস্যা হল ব্রিকস নিয়ে রিপোর্টিংয়ের। যেমন বাংলাদেশে বেশির ভাগ মিডিয়ায় শিরোনাম – বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগ দিতে যাচ্ছে – ধরণের। একথার মানে কী? বাংলাদেশ চাইলেই কী ব্রিকসে যোগ দিতে পারবে? নাকি আগে দাওয়াত আসতে হবে? মানে তারও আগে ব্রিকস নিজেরা কোন নয়া সদস্য নিতে চায় এমন এক তাদের আভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত হতে হবে। মানে ব্রিকস এর পক্ষে এটা এমন পরিপক্ক হয়েছে বসে সিদ্ধান্তে আসতে হবে! কিন্তু এসব প্রশ্ন এখনও এখানে সবটা পরিস্কার ঠিক তা নয়।

তবে তুলনায় আপাতত এখানে ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনেক স্বচ্ছ ও সাবধানী। মানে যা জানে না, তা নিয়ে আগায় নাই; অনুমান করে ইচ্ছামত লিখে নাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে কোট করে তারা লিখেছে, “We will surely join once they invite us. We have yet to receive any formal letter…. । বাংলা করলে হয়, “আমাদের একবার দাওয়াত করলেই আমরা নিশ্চয় সেখানে যোগ দিব। (এর আগে) আমাদেরকে এখনও তাদের আনুষ্ঠানিক (দাওয়াতের) চিঠি পেতে হবে”।  মানে আশা করা হচ্ছে যে আগামি আগষ্টে তাদের এবারের ব্রিকস সম্মেলনের আগে তারা নয়া সদস্য হতে আগ্রহী বা যাদেরকে তারা সদস্য হিশাবে নিতে আগ্রহী তারা দাওয়াত পত্র পেতে পারে। এরপরেই যোগ দেয়া না দেয়া নিয়ে নড়াচড়া শুরু হবে।

ব্রিকস নিয়ে বিভ্রান্তিই বিভ্রান্তিঃ
ব্রিকস নিয়ে যেকোন কিছুতেই বিভ্রান্তির শেষ নাই। এর এক অন্যতম কারণ, ব্রিকস যাদের লেখার বিষয় হয়েই যায় যেমন, মিডিয়া রিপোর্টার বা যারা কলাম লিখেন কমবেশি এদের সকলের মধ্যেই বিভ্রান্তি ঢুকে আছে, তা বর্তমান। যেমন ধরণ হিশাবে ব্রিকস কেমন সংগঠন – এই প্রশ্ন কে কিভাবে নাড়াচাড়া করছে কি লিখছে তাতেই বুঝা যায় যে তারা প্রায় সকলেই বিভ্রান্ত; মানে নিশ্চিত জানা নাই। প্রথমত, মিডিয়ায় অনেকেই “ব্রিকস-কে অর্থনৈতিক জোট” ভেবেছে।  যেমন প্রথম আলোর এক ‘বিশেষ প্রতিনিধি’ লিখছে,  “ব্রিকস হচ্ছে পাঁচ দেশের একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট”  অর্থাৎ এই বিশেষ প্রতিনিধি ব্রিকস-কে শুধু অর্থনৈতিক জোট-ই না একে এক আঞ্চলিক জোটও বানিয়েছে। কিন্তু ব্রিকস আর যাই হোক কোন আঞ্চলিক বা ভৌগলিক জোট একেবারেই নয়। কোথায় দক্ষিণ আফ্রিকা আর কোথায় রাশিয়া আর কোথায় ভারত বা চীন – এসব একটা অঞ্চল বা একটা মহাদেশেই সব সদস্য তা তো নয়; কাজেই একটু কল্পনা করে দেখলেই তো এমন ভুল করার কথা না!
আবার দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ড এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক এর বরাতে জানাচ্ছে,  তিনি বলছেন – আমাদের স্মরণে রাখতে হবে এটা কোনো বাণিজ্য জোট নয়, তাই যোগ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে না।’  আবার ঐ একই রিপোর্ট,  এবার আরেক বরাতে জানাচ্ছে, – “যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির ব্রিকসকে একটি ‘শিথিল ধরনের অর্থনৈতিক জোট’ বলে অভিহিত করেন, যেখানে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে”।  এটাও এক শতভাগই ভুল অনুমান।
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বিডিনিউজও লিখেছেন, –  ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক জোট ব্রিক এর প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে। এটা তো এক ভিত্তিহীন ভুল অনুমান যে ব্রিকস এক অর্থনৈতিক জোট!
আবার এক কলাম লেখক ব্রিকসকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জোট মনে করে – ধরে নিয়েই লিখেছে “বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্যঘাটতি, যেখানে আমদানি রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি, সেখানে ব্রিকসের সুবিধা আদায়ে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে”;  তিনি আরও একই লেখায় অন্যখানে লিখেছেন, “…… ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বিষয়ে উদারতার অভাব আছে
অর্থাৎ সবার ভিতরেই দেখা যাচ্ছে একটা বিভ্রান্তি কাজ করছে যে ব্রিকস [BRICS] কী ধরণের জোট – এই প্রসঙ্গে। অনেকের লেখার রেফারেন্স আনলাম এবং অবশ্যই এসব কাউকে খাটো করার জন্য না। বরং একধরণের সার্ভের মত করে কয়েকজনের লেখা এনে দেখলাম যে সমাজে বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় ভুল কোথায় হচ্ছে। সমস্যাটা কোথায়! আর এখন এই বিভ্রান্তি কাটাতে আমার বক্তব্য কী সেটাই নিচে বলব।

ব্রিকস কোন অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যের জোট একেবারেই নয়ঃ
হ্যা একথা সত্য যে ব্রিকস কোন অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যের জোট একেবারেই নয়। এই বুঝাবুঝি ভিত্তিহীন ও ভুল।  কথাটা যদি এভাবে বলি যে আইএমএফ [IMF] বা বিশ্বব্যাংক [ WB or IBRD] বা এডিবি [ADB] বা আইডিবি [Islami DB] এআইআইবি [AIIB] বা এনডিবি [NDB] ইত্যাদি – এরা হল কোন অর্থনৈতিক জোট অথবা কোন বাণিজ্য জোট তাহলে বুঝাবুঝিতে যে কঠিন সমস্যা সৃষ্ঠি হবে – এটা সেধরণের ভুল। দুনিয়ার প্রায় ১৯২+ রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য। আর এদের মধ্যে প্রায় সকল রাষ্ট্র-ই  আবার IMF ও WB এদুই প্রতিষ্ঠানের সদস্য। কিন্তু তবু কোন যুক্তি বা বাস্তবতাতে IMF ও WB কোন  অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যের জোট একেবারেই নয়।

বরং সোজাসাপ্টা বললে,   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পরিস্থিতিতে ১৯৪৪ সালে Bretton Woods সংগঠন বলে এক গ্লোবাল কনফারেন্সে IMF-WB এদুই গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়া হয়েছিল। আবার এদেরকে ঠিক কোন জোট বা সমিতি বলা হয় না। বলা হয় মাল্টি ল্যাটারাল [multi-lateral] বা বহু-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।  আর এসব বহু-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মূল উদ্দেশ্য হল, একটা আন্তরাষ্ট্রীয় ও গ্লোবাল অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সিস্টেম গড়ে তোলা। অনেক সময় যেটাকে Global Econimic order  – এক শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মের ব্যবস্থা বলা হয়। আর তা গড়তে Bretton Woods সেই সভায় তাতে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মত দেশের প্রতিনিধি সহ অন্য আমেরিকাসহ লিডার দেশ এবং আমাদের মত ছোট দেশের প্রতিনিধিরাও সেখানে উপস্থিত ছিল। এটা নিউ হ্যাম্পশায়ারের  Bretton Woods এলাকায় Bretton Woods নামে হোটেলে জন্ম নেয়া এক ঘটনা।  উদ্দেশ্য ছিল  – জাতিসংঘকে যদি বলি এক গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেম কায়েম ও নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠান ঠিক সেই রকম IMF-WB হল এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেম কায়েম ও নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠান কায়েম করা যাতে একটা গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থা বা সিস্টেম চালু করা যায়।

তাহলে ব্রিকস কীঃ
ব্রিকস হল সেকালের জায়গায় একালে আরেকটা উদ্যোগের নাম যাদের লক্ষ্য একাল এখন গ্লোবাল নেতৃত্বে এক পালাবদলের যুগ – সেই পালাবদলে মূলত চীনের নেতৃত্বে সেকালে  IMF-WB এর মতই তবে একালে এবং  আগামিতে বিকল্প এক গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থা বা সিস্টেম কায়েমের লক্ষ্যে কাজ শুরু করা। আর সেকাজের উদ্যোক্তা সংগঠন হল ব্রিকস [BRICS] যার জন্ম ২০০৯ সালে।  তবে পরিস্কার থাকতে হবে ব্রিকস  নিজেই কোন বিকল্প  IMF অথবা WB সমতুল্য প্রতিষ্ঠান তা একেবারেই নয়বিকল্প  IMF ও WB ধরণের প্রতিষ্ঠান হাজির করা একাজে অবশ্যই লম্বা প্রস্তুতি ও সময় লাগবে; আর তা করার জন্য উদ্যোক্তা তাও আবার একেবারে প্রাথমিক উদ্যোক্তা সংগঠন হল ব্রিকস। যেটা ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা – এই পাঁচদেশের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি এক প্রাথমিক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মাত্র।  আর এই মাত্র পাঁচদেশ সদস্য থাকা অবস্থাতেই বিকল্প  IMF-WB গড়ার আগ্রহ থাকলেও কেবল বিকল্প WB গড়ার লক্ষ্যের এক ভ্রুণ প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে ইতোমধ্যেই তারা চালু করেছে গত ২০১৫ সালে। এর নাম নিউ ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক [NDB  বা এনডিবি], যেটাকে বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করতে পারি। আর এই প্রথম ব্রিকসের সদস্য দেশ সম্প্রসারণের কালে ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এর সদস্য হয়ে গেছে। প্রথম আলো লিখেছে, ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্রিকস-ব্যাংকের সদস্য হয়। যদিও আমার ধারণা এভাবে  ব্রিকস-ব্যাংকের সদস্য লিখাটাও এক ভুল বুঝাবুঝির উৎস বা ভুল হবে। বরং যদি বলা যেত ব্রিকস উদ্যোগের বিশ্বব্যাংক অথবা আরেকটু পরিস্কার করে ব্রিকস উদ্যোগের বিশ্বব্যাংক সমতুল্য প্রতিষ্ঠান – তাহলে এসব কথা নয়া ভুল বুঝাবুঝি তৈরি করত না। মূলকথা ব্রিকস-কে কখনই  অর্থনৈতিক জোট অথবা কোন বাণিজ্য জোট হিশাবে তো নয়ই এমনকি ব্রিকস নিজেই এক আইএমএফ অথবা বিশ্বব্যাংক হতে যাচ্ছে এভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে না। তা ভুল হবে।

মূলকথা ব্রিকস-কে কখনই  অর্থনৈতিক জোট অথবা কোন বাণিজ্য জোট হিশাবে তো নয়ই;
এমনকি ব্রিকস নিজেই এক বিকল্প আইএমএফ [IMF] অথবা বিশ্বব্যাংক [WB] হতে
যাচ্ছে এভাবেও পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে না। কারণ সেটাও ভুল। 

বরং ব্রিকস হল স্রেফ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান যার ইচ্ছা আছে আগামি দিনের দুনিয়াতে
বিকল্প  IMF এবং WB প্রতিষ্ঠান গড়ে নিয়ে এক
নয়া  গ্লোবাল  সিস্টেমের জন্ম দেয়া।
আর ‘ব্রিকস উদ্যোগ’ যেন জন্ম নিয়ে নেয়, গড়ে উঠে – আমেরিকা নিজেই পরোক্ষে ইস্যুটাকে এদিকে ঠেলে দিয়েছে।    

 

আমাদের বুঝাবুঝি পরিস্কার না থাকার পিছনের অন্তত দুই সমস্যাঃ
যতদুর লিখেছি তাতে অন্তত এতটুকু পরিস্কার যে আমাদের সমাজে বুঝাবুঝিতে ব্যাপক সমস্যা আছে। এদিকে, আমরা চাই বা না-চাই আমাদের পরিচিত দুনিয়াটাতে ব্যাপক বদল ঘটে যাচ্ছে এটা অন্তত আমাদের টের পাবার কথা। এব্যাপারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেবারেই অপ্রস্তুত। পাবলিক বা সরকারি হলে সেখানকার মূল ইস্যু লীগ বা বিএনপি কোনটা ভাল!!!!! কে কোনদিকে!!
অথচ হওয়া উচিত ছিল ১৯৪৫ সালের পরের দুনিয়াকে বুঝব কী করে এবং গ্লোবাল সিস্টেম প্রতিষ্ঠান যেগুলো সেই ১৯৪৫ সালে যাত্রা শুরু করেছে এদের ততপরতায় যে দুনিয়ায় নয়া ব্যবস্থা চালু হয়েছিল একে বুঝবার উপায় কী? সেগুলোর ভাল-মন্দ দিক নিয়েও আলোচনা হতে পারত। আর সেকাজে তরুণদের যোগ্য করে  গড়ে তোলা এটাই হতে হত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার মূল লক্ষ্য। কিন্তু তা হয় নাই। আমরা এর বদলে কেন কমিউনিজম বা কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদিতায় ঈমান আনতেও হবে এবং এটাই নাকি সবচেয়ে “অগ্রসর জ্ঞান” তা মনে করে আমরা বাস্তবতা বা বাস্তব জীবনের বাইরে থাকতে চেয়েছি।  যেটা এখন পরিস্কার যে আমাদের এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদিতাই আসলে এক হিন্দুত্ববাদী মাত্র। আর এটাই আমাদেরকে ১৯৪৫ সালের পরের দুনিয়ায় যে নয়া ধারা একটা গ্লোবাল সিস্টেম-ব্যবস্থা খাড়া হয়ে গেছে তা বুঝতেই দেয়নি।

বরং ব্যাপারটা হয়েছে এমন যেন, একটা জিনিষ বাঘ না বিড়াল সেটা বুঝব শিখে ফেলব কী করে সেই বুঝাবুঝির ক্ষমতা শানানো বা চর্চা করা নয়; এর চেয়ে আমরা ভাগ হয়ে গেছি এভাবে যে আমাদের মধ্যে কে কে এটাকে বাঘ বলার পক্ষে আর কে কে বিড়াল বলার পক্ষে। ফলে এরই নিট ফলাফল হল আমরা কোন পক্ষই আজ দুনিয়াকে এসব ফেনোমেনাগুলোকে বুঝতে আমরা কেউ-ই সক্ষম নই, হই নাই।
তাই, আমাদের বোকা বোকা প্রশ্ন হল জাতিসংঘ কেন “গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান” নয়। কেন কেউ কেউ ভেটো সদস্যধারী? এই খায়েস শুনলে মনে হবে প্রশ্নকর্তা খুবই বোদ্ধা! কিন্তু আসলে সে একটা পড়ালেখা না করা চটকদার তার্কিক! আবার অগ্রসরতার দাবিদার কমিউনিস্ট তাদেরও জাতিসংঘ  মানে, এই গ্লোবাল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোন ধারণা নাই।  আর  IMF-WB  সম্পর্কে ধারণা সেটা আরো করুণ অবস্থা। কমিউনিস্টদের চোখে এগুলো হলো “নিপাত যাক প্রতিষ্ঠান”।   মানে যেকথা বলছিলাম বাঘ না বিড়াল এর বুঝাবুঝি ও ফারাক করতে শিখা ও জানা – এসব জানার পদ্ধতি শিখার কাজ যেখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল সেসব ফেলে আমরা হয়ে গেলাম কে বাঘকে বিড়াল বলে বা কে বিড়ালকে বাঘ বলবে এনিয়ে দুপক্ষের লড়াইয়ে বিভক্ত। IMF-WB “নিপাত যাক প্রতিষ্ঠান” -এধরণের হতেও পারে! কিন্তু এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানকে চিনব কী করে, কী করে চিনতে হয় এর জানার পদ্ধতি-উপায় কী আমরা জানলাম না। এর ম্যান্ডেট কী, এটা কী করে, কী করার উদ্দেশ্যে জন্ম আমরা কমিউনিস্টেরা তা জানি না। প্রথমে তাদের বলতে দেখলাম এরা নাকি সুদ খেতে আসছে এমন লগ্নি প্রতিষ্ঠান!!!!!  এর সোজা মানে হল IMF-WB এদের সুদহার কত তাই কোন খবর কমিউনিস্টেরা জানেই না।  আবার আচ্ছা  IMF-WB “নিপাত যাক প্রতিষ্ঠান” মানে হল বাংলাদেশ যদি এদুই প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ ত্যাগ করে তাহলে কী বাংলাদেশ মানে ধরা যাক বাংলাদেশের অর্থনীতি কী টিকে থাকতে পারবে? কেন পারবে অথবা পারবে না তা আমাদের কমিউনিস্টেরা বলতে পারবে, মনে হয় না।  তাহলে?

আবার দ্বিতীয় সমস্যাটা হল, একালে বিশেষ করে হাসিনার ১৫ বছরে অনেকেই আমেরিকায় বসবাসের রেসিডেন্ট পারমিট পেয়েছে। কিন্তু তাতে আবার এরা একটা কমপ্লেক্সে মানসিক জটিলতায় পড়েছে।  তারা চীন ভাল না আমেরিকা ভাল এই তর্কে অংশ নিতে চায়। তা খুবই ভাল কথা কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু তাদের যে দ্বিধা তা হল, তাদের কী আমেরিকা ভাল – একথার পক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বলা উচিত নয়!!!!  অর্থাৎ জাতিবাদের সমস্যায় পড়েছেন তারা; যেটা অবশ্য একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা। আর আমেরিকা তো  হাসিনার বাংলাদেশ নয়।  তবুও কেউ কেউ আরেক ধাপ উপরে। তারা মনে করে তারা যদি অ্যামেরিকান প্রশাসনের অবস্থানের পক্ষ নিয়ে কথা না বলি তাহলে কী এটা পরে কখনও তাদের রেসিডেন্ট পারমিট বাতিলের পক্ষে যুক্তি হয়ে হাজির হয়ে যাবে? এসব!! “এক্ষেত্রে কে কী পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তা নিয়ে আমার বলার নাই। কিন্তু যেটা গুরুত্বপুর্ণ তা হল, যেমন ব্রিকস বুঝাবুঝির ক্ষমতা বাড়ানো বা বুঝাবুঝির পদ্ধতিটাই জানা এদিকে কারও আগ্রহ নাই।   বরং বাঘকে বিড়াল বলে বা কে বিড়ালকে বাঘ বলে চালিয়ে দিবে কিনা – কোনটা করবে এটা হল তাদের তর্ক। যা খুবই হতাশজনক!
তাহলে কথা ছোট করি এখন। তাহলে যারা ১৯৪৫ সালের পরের গ্লোবাল সিস্টেমটা কেন এমন হয়ে খাড়া হয়েছিল তা বুঝতেই অক্ষম – বরং কেবল পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে থাকতে চায় বা এসেছে তারা কীভাবে ব্রিকসকে ব্যাখা করতে পারবে বুঝাবুঝি শানাতে পারবে!
আবার  কমিউনিস্টরা মনে করেন ক্যাপিটালিজম করা অথবা মুনাফা কামানো খারাপ কাজ। কিন্তু বাস্তবতা হল সেই রাম বা অযোধ্যা কোনটাই নাই, টিকে নাই। পুরানা চীনও নাই। সোভিয়েতেরও আগে সেই ১৯৫৮ সালের পর থেকে পুরান চীন নাই।   কাজেই সোভিয়েত বুঝ দিয়ে সোভিয়েতের বাইরের দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া কেন? তাতে তো বাইরের সবাইকেই পাপী মনে হবে। কারণ ‘বাইরের দুনিয়া” যেটা সেটাই এখন বাস্তব দুনিয়া। কাজেই সোভিয়েতের টুলস দিয়ে ব্রিকসকে বুঝবার চেষ্টা অর্থহীন!  তাইতারা তো ব্রিকস আলোচনায় ঢুকতেই সক্ষম হবেন না; তাদের অপ্রয়োজনীয় এবং নিপাত যাক অবস্থানের কারণে! তাই ব্রিকস বুঝাবুঝি তাদের জন্য নয়!

এজন্যই বলছিলাম, যারা বুঝতে চান তাদের জন্য তাহলে সারকথায় এর মানে আমরা এখন আরেক সমস্যায় পড়লাম যে তাহলে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক কেমন ধরণের সংগঠন যারা সেই ১৯৪৪ সালে একই [ Bretton Woods] বৈঠকে জন্ম নিয়েছিল, তা বুঝতে হবে আগে। আবার, তারা একই বৈঠকে জন্ম নেয়া হলে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক নামে আলাদা দুইটা হবার দরকার হল কেন? এসব দিকগুলো আমাদের জানতে হবে নইলে ব্রিকস উদ্যোগের কিছুই স্পষ্ট বুঝা যাবে না।  আরেকভাবে বললে, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক এদের ম্যান্ডেট বা কী দরকারে জন্ম দেয়া হয়েছিল সেসব কাহিনী ঘাটতে হবে। হ্যা কিছু করার নাই। কারণ, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক তাহলে কী ধরণের প্রতিষ্ঠান – কোন অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যের জোট কী? না অবশ্যই না।  তাহলে কেমন প্রতিষ্ঠান এরা? এই হল মুখ্য জানবার প্রশ্ন!

একটা ক্লু দিয়ে শুরু করা যাক!
লক্ষ্য করলে দেখব এক আইএমএফ ছাড়া বাকি বিশ্বব্যাংক, এডিবি,  এআইআইবি, আইডিবি বা এনডিবি – এসব প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ব্যাংক বা “ইংরাজিতে B” আছে। কাজেই নামের শেষে ব্যাংক আছে এমন প্রতিষ্ঠানকে  অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যের জোট মনে করা অবশ্যই অর্থহীন বা মিলল না – এটুক তো বুঝাই যায়! এরপর আরও ইতিবাচকভাবে বুঝতে চাইলে লক্ষ্য করব এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ইংরাজিতে B লেখা থাকার আগে বা পরে দেখেন D আছে,  যেখানে D  হল ডেভেলবমেন্ট শব্দের আদ্যক্ষর।  মানে হল বিশ্বব্যাংক, এডিবি,  এআইআইবি, আইডিবি বা এনডিবি ইত্যাদি এরা সবাই আসলে ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক ধরণের প্রতিষ্ঠান; মানে বিশ্বব্যাংক, এডিবি,  এআইআইবি, আইডিবি বা এনডিবি  এরা কোন অর্এথনৈতিক জোট নয়, একেবারেই নয়। তবে এরা ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক অবশ্যই।

আচ্ছা,  ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক বলতে ঠিক কী বুঝবঃ
এর জবাব হল, ব্যাংক বলছে যেহেতু ফলে ঋণ দেয় তা হয়ত অনুমান করা যায়। কিন্তু এই অনুমান কী সঠিক? হ্যা একেবারে সঠিক।  কিন্তু এটা অবশ্যই আমাদের দেশের  প্রাইভেট ন্যাশনাল ব্যাংক বা সরকারি সোনালি ব্যাংকের মত ব্যাংক নয়। এটা হল ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক যেখানে ডেভেলবমেন্ট এর মানে করতে হবে ইংরাজিতে যেটাকে ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলবমেন্ট [অবকাঠামো উন্নয়ন] বলে। আর সেখান থেকে ছোট করে নেয়া শব্দ শুধু ডেভেলবমেন্ট কথাটাই বাংলায় উন্নয়ন।

আর ইনফ্রাস্টাকচার বা অবকাঠামো শব্দের ব্যবহার অবকাঠামো ব্যাঙ্ক [DB] এভাবে এই শব্দের ব্যবহার ও ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। অনেকে মার্শাল প্ল্যান কথাটা শুনে থাকবেন। বিশ্বযুদ্ধে যেহেতু তাই সেখানে রাস্তাঘাট কারখানা বাড়িঘ্অর বা পানি-বিদ্যুতের উতপাদন অবকাঠামোর এসব দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জর্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের অবকাঠামোগুলো পুণঃর্গঠন ও উন্নয়ন [reconstruction & Development (RD)] জন্য নয়া উদ্যোগ পরিকল্পনার নামই মার্শাল প্ল্যান । এখানে আমেরিকা একাই মানে  অ্যামেরিকান প্রশাসনের দিক থেকে যে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল সেটাই মার্শাল প্ল্যান নামে পরিচিত।  সেসময়ে (RD) খুবই এক চালু শব্দ ছিল। যেকারণে আজকের বিশ্বব্যাংকের (WB) মূল পুরা নাম হল [IBRD – International Bank for Reconstruction & Development ]।  আর অবকাঠামো [Infrastructure] বলতে ঠিক কী বুঝব? কোন দেশের অর্থনীতি চালু ও সরগরম থাকার পুর্বশর্ত হচ্ছে ভাল অবকাঠামো থাকা। মানে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, পানির সাপ্লাই, নিস্কাষণ ব্যবস্থা, কারখানার বর্জ্য রিসাইক্লিং, নগর অবকাঠামো, শিল্পাঞ্চল অবকাঠামো, গ্রামীন রাস্তাঘাট ইত্যাদি গড়তে হয় আগেই। তবেই অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় শর্ত হচ্ছে এসব গড়তে হবে নামমাত্র বা কমসুদের (১% এরও কমে) ঋণে।  সেসব অবকাঠামো গড়তে নামমাত্র সুদে সরকারকে ঋণ দেয়াই  বিশ্বব্যাংক, এডিবি,  এআইআইবি, আইডিবি বা এনডিবি – এসব ডেভেলবমেন্ট ব্যাংকের ম্যান্ডেট বা মুখ্য কাজের লক্ষ্য। এককথায় এগুলো কর্মাশিয়াল বা বাণিজ্যিক ঋণ নয়, তাই সুদ নামমাত্র। এটা ডেভেলবমেন্ট ব্যাংকের মুখ্য বৈশিষ্ঠ। এটাই  যদিও অর্থনীতি উঠে দাড়ালে মাথাপিছু আয় বাড়তে শুরু করলে সরকারকে দেয়া এই ঋণের সুদ বেড়ে ৩% পর্যন্ত হতে পারে!
তাহলে আমাদের মূল আলোচ্য প্রসঙ্গ – বিশ্বব্যাংক, এডিবি,  এআইআইবি, আইডিবি বা এনডিবি এই ধরণের প্রতিষ্ঠান কোনভাবেই কোন  অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যের জোট নয়। এমন মনে করা ভুল, ভিত্তিহীন। এগুলো আসলে ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক ধরণের প্রতিষ্ঠান।

তাহলে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা যেটা এখন আছে আগে তা বুঝলে পরে, আগানো যাবে ব্রিকস কীঃ
নয়া প্রসঙ্গে যাবার আগে একটা সাবধানতাঃ
ঘরে ঢুকার আগে বাইরে জুতা খুলে ঢুকার মত পাঠকেরা দয়া করে আপনি কোন পন্থী – প্রো অ্যামেরিকান নাকি প্রো চীন অথবা ধরেন কোল্ডওয়ার কালের মত আপনি সোভিয়েত না অ্যামেরিকান পন্থী – ইত্যাদি এসব ভাগ ও আলাপ গুলো এই আলোচনা পাঠের আগে বাইরে রেখে আসেন। তাহলে এই আলোচনার কথাগুলো বুঝতে সুবিধা পাবেন।  কারণ এখানে কথাগুলো যে পন্থীরই হোন এমন সবার জন্য লেখা হয়েছে। বরং আপনি নিজেকে কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল বলে মনে রেখে পড়তে বসলেই বুঝতে ঝামেলা হতে পারে। পরে আরো বিস্তার করব সেসব কথা।

তাহলে ব্রিকস কী ? কেমন ধরণের প্রতিষ্ঠান?
এটা খুবই প্রতিষ্ঠত এক সত্য যে ১৯৪৫ সাল নাগাদ বিশ্বযুদ্ধে শেষে (কমিউনিস্ট নেতা স্তালিন সহ) সকলে মেনে নিয়েছিল যে আমেরিকাই গ্লোবাল নেতা। এর মূল কারণ হল বা তখনকার বাস্তবতা ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের সকলের প্রধান খরচ এককভাবে সকলকে  যুগিয়েছিল একনাগারে চারবারের (১৯৩২-১৯৪৪) নির্বাচিত অ্যামেরিকান  প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। অর্থাৎ মিত্রপক্ষ এই জোটের একমাত্র নেতা হয়ে দাড়িয়েছিলেন রুজভেল্ট। শুধু তাই নয় যুদ্ধে শেষে আবার ইউরোপের নানান দেশের ( এমনকি এবার কেবল মিত্রপক্ষের দেশগুলোকেই নয় সাথে হিটলারের পক্ষের দেশগুলোসহ) অবকাঠামোগুলো পুণঃর্গঠন ও উন্নয়ন এর খরচও যোগান  বা অবকাঠামো ঋণ হিশাবে দিয়েছিল ঐ আমেরিকা একাই। এজন্য আমেরিকা বাদে ইউরোপীয়-সহ প্রায় সকল দেশই পরে আমেরিকাকে ধরেছিল  একটা গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা দাঁড় করানোর জন্য উদ্যোগ নিতে। যত সহজে এই গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা কথাটা লিখলাম ততই কঠিন অনেকের জন্য এটা বুঝা বা ইমাজিন করে বুঝা কঠিন। বিশেষ করে কোন কমিউনিস্টের পক্ষে কমিউনিস্ট থেকে গিয়ে এটা বুঝা কঠিন হবে। এর অন্তত একটা কারণ হল, কমিউনিস্ট বুঝাবুঝিতে বাণিজ্য বিশেষ করে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য  (এবং গ্লোবাল বাণিজ্যও) একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়! কারণ যতই নিজেদের এরা কমিউনিস্ট বলে দাবি করুক এরা মূলত উগ্র জাতিবাদীদের মত গভীর অর্থনৈতিক জাতিবাদিও। মানে কোনকিছুই আমদানি করা যাবে না; পারলে অন্যদেশে কেবল রপ্তানি করেন – এমন চিন্তার। স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে আজ ১৫ টা আলাদা রাষ্ট্র হয়েছে – এটা এত বড়। তাই ভিতরে প্রায় সব ধরণের প্রয়োজনীয় পণ্য একই নিজ সোভিয়েত দেশেই উতপাদন সম্ভব ছিল। যেটা আমাদের মত দেশের বেলায় অসম্ভব।  এই সুযোগে কমিউনিস্টদের  (অবাস্তব বা আইডিয়েল) অনুমান আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য  (এবং গ্লোবাল বাণিজ্যও) অপ্রয়োজনীয়। এছাড়া, বাণিজ্য মানে তো মুনাফা কামানো যা তাদের চোখে হারাম কাজ!  অথচ খোদ কার্ল মার্কস এর কাছে এক্সচেঞ্জ [exchange] (বাংলায় বিনিময় যেমন পণ্য বিনিময় থেকে প্রেম বিনিময় বা সম্পর্ক) কেন এত গুরুত্বপুর্ণ ও প্রায় সর্বব্যাপী এক ধারণা কেন?
অথচ আবার খেয়াল করেন মোদি যে এক উগ্র অর্থনৈতিক জাতিবাদী এবং কট্টর চীনবিরোধী। অথচ ভারতে যে মোবাইল ব্যবহার হয় এর ৭৩% মার্কেট শেয়ার হল একা চীনের। আমি জানি না কমিউনিস্টেরা এই ফেনোমেনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন! কেন এটা ঠেকানো যাচ্ছে না?

তাই আরেক সাবধানতা -দুই বলে রাখি। গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা জিনিষটা কী তা নিয়ে আলাপেঃ
মূলত এটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাই তবে এরচেয়েও বড় এরই গ্লোবাল রূপ।  আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা মানে যেকোন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্য যাতে চলতে পারে এর একটা সিস্টেম গড়ে তোলা। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে এত জটিল সিরিয়াস ভাবা কেন? যদি এর মূল সমস্যাটা বুঝতে পারি তাহলে সবকিছু বুঝব।
যেমন আপনার দেশীয় মুদ্রায় কেনা-বেচা আপানার দেশের সীমানার ভিতরেই কেবল চলতে পারে। সীমানা পার হয়ে গেলে আপনার পকেটের আপনার দেশীয় মুদ্রা ভিনদেশে আর গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই কিছুই কিনতে পারবেন না।তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে ধারণা লাগবে, একটা সিস্টেম লাগবে। এর চেয়েও বড় কথা কোন প্রতিষ্ঠান লাগবে যার কাজ হবে যেকোন দেশের মুদ্রার প্রতিদিনের বিনিয়ময় হার কী হবে তা জানানো। আর একাজ সে টেকনিক্যাল ও ইম্পারশিয়াল নিউট্রাল কোন পদ্ধতি দাড় করিয়ে সে ভিত্তিতে প্রকাশ করবে। আর যে গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান এই কাজ করবে – সেই প্রতিষ্ঠানটারই নাম হল আইএমএফ।  এসব দিকের বিপরীতে কমিউনিস্টেরা মনে করে  আইএমএফ হল নাকি কেবল শর্ত দেওয়ার প্রতিষ্ঠান। না বুঝে কত কথাই না বলা যায়! কমিউনিস্টদের আরেক ভুয়া অনুমান হল, আইএমএফ এমন শর্ত দেয় বেশি মুনাফা কামানোর জন্য। এজন্য যে হাসিনা সরকার পরিণত হয়েছে বিদেশে অর্থপাচারের সরকারে ফলে হাতে ডলার শুণ্যতার সরকার, কমিউনিস্টেরা তাকে সাফাই যোগাতে চেয়ে বলছে ডলার সংকটের সব দোষ নাকি আইএমএফ এর।  কারণ নাকি আইএমএফ খালি শর্ত দেয়। আর এই ভুয়া আলাপের লেজ ধরে অর্থমন্ত্রীও সাফাই দিয়ে বলে সরকার  “আইএমএফ এর শর্তের কথা ভেবে” মানে আমল করে এবারের বাজেট দেয় নাই। মানে খুবই বিপ্লবী সরকার এটা! আর তা শুনে কমিউনিস্টেরা হাততালি দিয়ে উঠেছে।

যে আলাপ তুলি নাইঃ
প্রশ্ন হল ব্রিকস এক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বলছি যার লক্ষ্য আগামি দিনে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ব্যবস্থার বিকল্প সিস্টেম আনা। এই ব্রিকস তাহলে নিজ জন্মের ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে এখনও আইএমএফ নিয়ে কিছু করছে না কেন, অগ্রগতি ধীর কেন?  জবাবটা আপাতত এক বাক্যে শেষ করব। জবাব হল, চলতি গ্লোবাল অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থাটা অ্যামেরিকান ডলার কেন্দ্রিক। মানে এখন দুনিয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ৭০% এর বেশি পণ্য কেনাবেচা হয়, ইনভয়েস লিখা হয় অ্যামেরিকান ডলারে। সবার আগে এখানে বদল ঘটতে হবে; ঘটাতে হবে। অন্য মুদ্রা ইউয়ান অথবা  অন্যদেশের মুদ্রায় হতে হবে। এটাই সেই পুর্বশর্ত যা না হলে ব্রিকস উদ্যোগের সফলতা দেখাতে পারবে না। কিন্তু একালে আবার বাইডেন ডলারে বাণিজ্য করতে পারবে না এমন ডলার স্যাংশন যেকোন ব্যক্তি বা সরকারের উপর জারি করছে যথেচ্ছভাবে তা প্রয়োগ হচ্ছে। এটাই পরোক্ষে ব্রিকসকে আশা জাগানো হয়ে যাচ্ছে, বা সাহায্য করছে। যেটাকে আমেরিকার দিক থেকে দেখলে উপস্থিত লাভালাভ পেতে গিয়ে বাইডেন অপব্যবহার করে ফেলছেন – বলবেন অনেকে। এমন ডলারের সুবিধা অপব্যবহারের বিপদ বাড়ছে কথাটা সম্প্রতিকালে বাইডেনের  ট্রেজারি মন্ত্রী স্বীকারও করেছেন Yellen Says Sanctions May Risk Hegemony Of US Dollar

তাহলে আদার ব্যাপারী কথা তুললাম কেনঃ
কথাটা আমার না স্বয়ং শেখ হাসিনার। বিডিনিউজের রিপোর্টার লিখছেন, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক আরও জানতে চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক কোনো মুদ্রা চালু করার পরিকল্পনা বাংলাদেশের আছে কি নাউত্তর দিতে গিয়ে মুচকি হেসে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদার ব্যাপারি জাহাজের খবর নিতে বলছেন”।

এইকথাটাই প্রমাণ করে যে হাসিনা নিশ্চিত যে ব্রিকসের সদস্য হলে সেটা বাইডেনের আমেরিকাকে ছেড়ে যাওয়া বা বুড়া আঙুল দেখানো এসবের কোনটাই নয়। তিনি তো আদার ব্যাপারী, তাই এটা তিনি বুঝেন। এটা কেবল একটা ভাব ধরা যে ব্রিকসে যোগ দিয়ে হাসিনা বাইডেনের প্রভাবের বাইরে চলে যাবেন বা বাইডেনকে যেন একটা উচিত শিক্ষা দিলেন। তবে এসব কথা দলের কর্মীদের মনোবল বাড়াতে কাজে আসবে এতটুকুই মাত্র।

এছাড়া সকল পাঠককে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেষ করব। ব্রিকসের জন্মদাতারা সহ সকল রাষ্ট্র আজও আইওএমএফ ও বিশ্যাব্যাংকের সদস্য হয়েই আছে। ছাড়ে নাই। কোনদিন যদি চীন আমেরিকার জায়গায় গ্লোবাল নেতার প্রতিষ্ঠা পায় কেবল তখনও হয়ত অনেক বিশ্বব্যাংকের মত সমতুল্য প্রতিষ্ঠান থাকলেও দুনিয়ায় আইএমএফ হবে একটাই; তবে অবশ্যই সেটা হবে ঢেলে সাজিয়ে নেয়া এক নয়া আইএমএফ!

আপডেটঃ ২৫ জুন ২০২৩  সকাল ১০ঃ ১২
আপডেটঃ ২৫ জুন ২০২৩  বিকাল ০৫ঃ ৫৫

>>>>
গৌতম দাস

রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

Leave a comment