ব্রিকসে নয়া ছয় সদস্য, বাংলাদেশ বাদ; এর অর্থ তাতপর্য কী


ব্রিকসে নয়া ছয় সদস্য, বাংলাদেশ বাদ; এর অর্থ তাতপর্য কী
গৌতম দাস
২৭ আগষ্ট ২০২৩
https://wp.me/p1sCvy-4SM

 

              BRICS new six Members

ব্রিকস সম্মেলনের শেষদিনের সিদ্ধান্ত হল, নয়া ছয় দেশকে [সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনা], তারা এই প্রথম তাদের জোটকে সম্প্রসারিত করে নয়া সদস্য করতে চাইলো। কিন্তু বাংলাদেশ? এত ঢাকঢোল পিটানো বাংলাদেশ যে এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হাজির রেখেছিল সেই-ই  বাদ হয়ে গেছে; সে এই ছয় রাষ্ট্রের মধ্যে জায়গা পায় নাই! কিন্তু ঠিক কেন? ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত! আমার আগের লেখায় শিরোনাম ছিল “মোদির আনা শর্ত ও পরিণতিতে বাংলাদেশ ব্রিকসে নাই’। কিন্তু ঠিক কীভাবে তা কার্যকর হয়েছিল তা বুঝতে একটু গভীরে যেয়ে এবার কথা বলব।
ইতোমধ্যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করা সুবীর ভৌমিক, সেও গতকাল (২৫ আগষ্ট) আবার বাংলাদেশকে নিয়ে এক লেখা দিয়েছে; যার শিরোনাম India, US narrow differences over Bangladesh ahead of elections]। । কিন্তু সুবীরের এই অবস্থান চারদিন আগের আনন্দবাজারের অগ্নি রায় বা দেবদীপ এদের অবস্থান থেকে একেবারে উলটা দিকে। তা একেবারে ভুতের মুখে রামনামের মত!  সুবীর লিখেছে,  বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ইস্যুতে “সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে” দেখা আমেরিকান অবস্থান যে এদেশে একটা অবাধ ও সুস্থ নির্বাচনই হতে হবে – এই বিষয়ে অনেক আলাপ আলোচনার পরে ভারত আমেরিকার অবস্থানের পক্ষে সায় দিয়েছে […India has agreed to the US stand of putting “absolute priority” on a free and fair parliamentary election due in January 2024.] সত্যিকরে বললে, এটা আবার অগ্নি রায় বা দেবদীপ পুরোহিত-দের প্রপাগান্ডার উলটা আরেক প্রপাগান্ডা নিঃসন্দেহে। কিন্তু অগ্নিদের মতই সুবীরও কোন প্রমাণ বা কোন সোর্স উল্লেখ করা ছাড়াই আরেক চাপাবাজি বক্তব্য। ফলে এ’বক্তব্যের কোনই মুল্য নাই। তবে এটা নিঃসন্দেহে সত্যিকথা যে ভারতীয় কারও – সে মোদি-ই হোক বা যেই কেউ  – এদের কারও আর বাংলাদেশে কোন বিশ্বাসযোগ্যতা অবশিষ্ট নাই।  আমরা এখন বড় জোড় তাদের কথা শুনব – আর পাশে আবর্জনার ড্রামে তা ফেলে রাখব; কারণ আমরা তাদের কাউকেই বিশ্বাস করি না।

আমার আগের লেখায় বলেছিলাম রয়টার্সের বরাতে জানা গেছে যে ভারতের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বাদ পড়েছে।  গত ২৩ আগষ্ট রয়টার্সের সেই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ব্রিকসের সম্প্রসারণ শেষ মুহুর্ত এসে ব্রিকসের আভ্যন্তরীণ বিভক্তির মুখে আটকে গেছে; BRICS expansion faces eleventh hour hurdle as divisions persistএটা হল,  ব্রিকসের ভিতরের খবর বের করে এনে তাদের লিখা। বলেছে ভারতের মোদি-ই  নিজেই শেষ মুহুর্তে নয়া দুই শর্ত  শেষে হাজির করেছে ।

ঐ রিপোর্ট বলেছে ইলেভেন্থ আওয়ারে মানে শেষ মুহুর্তে ভারত নয়া সদস্য নেয়া হবে কী ভিত্তিতে মানে কী শর্তে এই বিষয়ে কিছু বক্তব্য পেশ করেছিল। শুধু তাই না একথাগুলো লেখা হয়েছিল “LAST-MINUTE SPOILER” এই নামের রয়টার্সের লেখার এক উপ-শিরোনামের নিচে। যার  অর্থ হল, শেষ মুহুর্তে যিনি সব ভন্ডুল [SPOILER] করে দেন। আর বলাই বাহুল্য সেই SPOILER হলেন ভারতে প্রধানমন্ত্রী মোদি।

ঐ রিপোর্ট লিখেছিলঃ
“but the source said it had been delayed after
Indian Prime Minister Narendra Modi
introduced new admission criteria.”

কিন্তু কী ছিল সেই নয়া দুই শর্ত?
“The BRICS country official said that admission criteria
India’s Modi proposed included requiring members
not be the target of international sanctions,
ruling out potential candidates Iran and Venezuela.
Modi was also pushing for a minimum per capital GDP requirement”

কথাগুলো সোজা করে বাংলায় বললে, হবু ব্রিকস সদস্য হতে হলে – এরা কেউ আমেরিকান স্যাংশনের খাওয়া দেশ হতে পারবে না। তিনি অবশ্য আমেরিকা শব্দটা লুকিয়ে সে জায়গায় আন্তর্জাতিক লিখেছিলেন। আর দ্বিতীয় শর্তটা হল, ঐ হবু সদস্য দেশের অর্থনীতিতে  ওর নুন্যতম অর্জিত জিডিপি থাকতে হবে

এখন আমরা দেখব ব্রিকসের সদস্যপদ লাভে মোদির প্রথম শর্ত প্রসঙ্গেঃ
মোদির একথার কোন মানেই হয় না যে হবু সদস্য দেশ আন্তর্জাতিক স্যাংশন খাওয়া দেশ হতে পারবে না। কারণ, স্যাংশন বা আন্তর্জাতিক স্যাংশন খাওয়া দেশ মানে কী? মানে আমেরিকার যথেচ্ছারে স্যাংশন চাপানো যেটা ঐ দেশের ডলারে বাণিজ্য এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। কিন্তু আমেরিকা এমন স্যাংশন দেয়ার কে? কী তার অথরিটি? এটা লুকাছাপার কিছু নাই যে এবারের বাইডেন প্রশাসন ইচ্ছামত যার উপরে আরোপের ইচ্ছা এভাবে স্যাংশন আরোপ করে গিয়েছেন। কারণ, আমেরিকান ডলার আমেরিকা রাষ্ট্রের নিজের মুদ্রা হওয়াতে যে পড়ে পাওয়া সুবিধা আমেরিকার হাতে তাতে যেকোন দেশ যেন ডলারে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কেনা-বেচা না করতে পারে এই বাধা দিবার সুযোগ আমেরিকার হাতে আছে। আর আমেরিকা তার এই সুযোগ এর অপব্যবহার করবে না – এটাই আশা করা হয়েছিল আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্ম-সভায়।  কিন্তু তা ছিল ভদ্রলোকি চুক্তির মত ঠিক আইনি বাধা নয়; আর সে অনুমানটাকেই আমেরিকা অমান্য করে চলেছে।  “পরে পাওয়া” সুবিধাটাই খেয়ে চলেছে।
আর ওদিকে, ব্রিকস তৈরি হয়েছে যেসব রাষ্ট্র নিয়ে বা হবু সদস্যদের নিয়ে হতে চাচ্ছে তারা আমেরিকার এই অত্যাচার, যথেচ্ছাচারে অতিষ্ট হয়েছে বলেই তো নয়া ব্রিকস এর সদস্য হতে এসেছে। কাজেই আমেরিকান স্যাংশন কারো উপর  আরোপিত হলে সেই দেশকে আবার সদস্যপদ না দেয়ার মানে হল যেন, আমেরিকান ইচ্ছায় ব্রিকসের সদস্যপদ দেয়া। মানে ব্রিকস চালাবে যেন আমেরিকা – এমন অবস্থা তৈরি করা!  মানে কার্যত ব্রিকস-কে আমেরিকার খামখেয়ালি ইচ্ছার অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান করে ফেলা।  আর এভাবেই ভারত যদি ব্রিকসের নয়া সদস্যপদ লাভের শর্ত করতে চায় তাহলে আর এদের ব্রিকস গড়ার দরকার কী?
অথবা আরেকটা দিক আছে! তাহলে, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ভিত্তিতে যদি ব্রিকস প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে তাহলে চীনও কী আমেরিকার মতই যেকোন ব্রিকস সদস্য দেশের উপর চীনা খামখেয়ালি রুস্তমি শুরু করতে পারবে?   আর ভারত সেটা মান্য করে চলবে? মোদি তার মানে এটাই চাইছেন???? তাই কি??? মোদি সাব কী বলেন!!! 

আর তামাসার কথা যে, ভারত কী নিশ্চিত যে ইউয়ান-ভিত্তিক ব্রিকস এরপর ভারতের উপরেই চীন সেই প্রথম  (ইউয়ান) স্যাংশনটা আরোপ করবে না? কাজেই “স্যাংশন খাওয়া দেশ সদস্যপদ পাবে না” এই শর্ত তো ভারতের জন্যই সবচেয়ে বড় আত্মঘাতি হয়ে উঠতে পারে!!!  তাহলে ভারতের এই  গদগদ হওয়া “আমেরিকা তোষণ” এর মানে কী? এমন আত্মভোলা ছাগলামির মানে কী?

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ভারত  আমেরিকান স্যাংশন খাওয়া দেশকে” – সদস্যপদ দিয়ে ঐ দেশের সাথে আমেরিকান  ক্যাচাল-সংঘাতের দায়গুলো ব্রিকসে আনতে চাচ্ছে না, এড়াতে চাইছে মানে এই প্রশ্নে আমেরিকার বিরাগভাজন হতে চাচ্ছে না। কিন্তু সেটা হলেও এভাবে আমেরিকার খামখেয়ালিপনা আমল করে এর ভিত্তিতে একটা  ব্রিকস খাড়া করা কী সম্ভব, নাকি এটা বাস্তব? বা এর কোন দরকার আছে? যেমন ধরেন এখনই সবচেয়ে বড় স্যাংশন খাওয়া দেশ হল খোদ পুতিনের রাশিয়া। তাহলে মোদির প্রস্তাবিত শর্ত অনুসারে তো রাশিয়াকেই ব্রিকসের সদস্যপদ থেকে বাদ দিতে হয়! অথবা ধরা যাক, কোন কারণে ভারতের উপরেই কোন আমেরিকান স্যংশন যদি আরোপিত হয় তাহলে কী ভারত সরল বালকের মত নিজেই ব্রিকসের বাইরে গিয়ে বসবে? তাতে রাজি থাকবে তো??? একথার মানে হল, যে আপনার বাসায়  আপনি নিজে ঢুকতে পারবেন কিনা সেটা আর কেউ না একেবারে কোন বাইরের লোক বা পড়শি তার খামখেয়ালি ইচ্ছার কথা আপনি মেনে চলবেন? আর তা মেনেই আপনি আপনার নিজের বাসায় ঢুকবেন, ঢুকতে হবে? অথচ সেটাই মোদির ভারত প্রস্তাব করছে? এটা এবসার্ড[absurd] অর্থহীন; আজীব ও অবাস্তব ঘটনা! ভারতের এটা এক আজীব আমেরিকা প্রীতি! যেটার কারণে ভারত খোদ নিজেই আমেরিকার কাছে নিজের অস্তিত্ব নিজেই বিলীন করতে হতে পারে তা জেনেও ভারত তা করতে এক পায়ে খাড়া!!!!  তাই কী?  এটা মানে হয় না এমনই এবসার্ড অবিশ্বাস্য ঘটনা!  যা বাস্তব পরিস্থিতিতে ভারত নিজেই অমান্য করবে!

মূল কথাটা খেয়াল রাখতে হবে। ব্রিকসের সকল রাষ্ট্র যদি নাও চায়, তাহলেও ডলারের পাশাপাশি ডলারের বিকল্প কারেন্সি-ভিত্তিক (ধরা যাক চীনা ইউয়ান) ব্রিকস নামের আরেক অর্থনৈতিক  গ্লোবাল অর্ডার খাড়া করার চেষ্টা করার অর্থ হল ডলারের একছত্র অধীপতি থাকাকে টেনে নিচে নামানো। তাই ব্রিকস খাড়া করব এই মজা লুটতে এলাম  অথচ আমেরিকা বা তার ডলারের সাথে প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না, এড়ায় চলতে পারব, চ্যালেঞ্জ করব না এই অনুমান ভিত্তিহীন এবং তা অর্থহীনও!! বোকার স্বর্গে বসবাস! মানে হল, মোদির ভারতের দশা হয়েছে সে  আমেরিকা ডাকলেই যদি তার বাসায় গিয়া ভারতকে পাশে  শুইতেই হয়, সঙ্গ দিতেই হয় –  তাহলে আর ঐ ভারতের আবার ব্রিকস নামের নয়া বিয়ে করতে যুক্ত হতে এসেছে কেন, দরকার কী?

আসলেই মোদি এক আজব লোক!!!  সত্যি মোদি সাব পারেও বটে!!!
[একটা ঘোষণাঃ উপরে যে গ্লোবাল অর্ডার কথা বা ধারণাটা  উল্লেখ করেছি – এটা খুবই ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্ট।  তাই এনিয়ে আলাদা করে একটা লেখা প্রায় রেডি আছে, ‘ফাইনাল টাচ’ দিয়ে একদিন পরেই পোস্ট করব।]

মোদির দ্বিতীয় শর্ত প্রসঙ্গেঃ
এছাড়া  দ্বিতীয় শর্তও প্রায় একই রকমের অর্থহীন! মূল কারণ হল, ব্রিকস যদি পুরানা আইএমএফের বিকল্প প্রতিষ্ঠান হয়ে গড়ে উঠতেই চায় তাহলে হবু সদস্যদেশের নুন্যতম জিডিপি থাকতে হবে এমন শর্ত এর অর্থ কী? আমার দেশের নুন্যতম জিডিপি কেন উল্লেখযোগ্য কোন জিডিপি নাই বলেই তো আমি সদস্য হতে এসেছি, নাকি তামসা করতে? আর মূলকথায়, আইএমএফের জন্মের সময় কী সে এমন শর্ত দিয়ে নয়া সদস্য নিয়েছিল? দেয় নাই তো? তাহলে এখনই বা কেন এটা মোদির প্রস্তাব??  মোদির কনসালটেন্টেরা কি তাহলে গাধা-গরু, পড়াশুনায় ফাঁকি দেয়া ছাত্র যে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক স্টাডি করে নাই? নাকি মাদী ব্রিকস-কে বড়লোক রাষ্ট্রগুলোর ক্লাব বানাতে চাইছে? কিন্তু তেমন ক্লাব হিশাবে জি৭ – গ্রুপ  প্রথম বড়লোক রাষ্ট্রের ক্লাব তো আছেই – মোদি সেখানে না গিয়ে ব্রিকসে এসেছে কেন?

ন্যায্যতার প্রশ্ন ফান্ডামেন্টাল, তাই সবার আগে এই প্রশ্ন তুলতেই হবেঃ
অর্থনীতিতে বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলোকে অন্তত সুযোগের দিক থেকে সাম্য – সবাই সমান সুযোগ পেয়েছে – এতটুকুই যদি না করতে পারে তাহলে নয়া ব্রিকস খাড়া করার দরকার কী? এর সাফাই ন্যায্যতা কী? আমেরিকা্র খামখেয়ালি মত একালে আর কাকে কোন কোন দেশকে এমন সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে দুনিয়া?  এমন সুবিধা ব্রিকসের চীন বা চীনের মত অন্য কোন ব্রিকস সদস্যের হাতে যেন না থাকে, না উঠে সেজন্যই তো ব্রিকস এর প্রয়োজনীয়তা! নাকি??  ব্রিকস তখনই তো কেবল নুন্যতম ইনসাফের প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করতে পারবে; নাকি? আর আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি মোদির ভারতের মত যারাই বে-ইনসাফিতে অন্যের জন্য গর্ত খুড়ে রাখলে সে অনেক সুবিধা খেতে পারবে মনে করছে – এরা নিজেরাই আগামিতে সেই গর্তে পড়বেই! এটাই ইনসাফের মহিমা! 

তাহলে কী দাঁড়ালো, এটাই কী আগামি ব্রিকসের মাতবর সদস্য হিশাবে মোদির ভারতেরআমেরিকার মত এক খামখেয়ালি ক্ষমতার হাতা হয়ে উঠার খায়েসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?  ্মানে বগলে ইট নিয়ে মুখে শেখ ফরিদ!!! আসলে এটাই তো বৃটিশ কলোলিদখলদারেরা চলে গেলে বা এর অবসান হলেও সেই বৃটিশ দখলদারের স্বভাব নিজে পেতে চাওয়া “নেহেরুর ভারত” হওয়ার পুরানা খায়েস!!!

বাহা রে নন্দ! বাহ রে মোদি! তোর খায়েসের বলিহারি!! মোদি আসলেই পারে! এই দুনিয়ায় অসাম্যের নিয়ম-আইন কানুন যেখানে সমান থেকে উন্মুক্ত করার দাবি উঠছে, এই মোদি সেখানে যে নিজেকে অবলীলায় এর ভায়োলেটর (violator) অমান্যকারি এক দানব হিসাবেই পরিচিত করতে চাচ্ছে!

যাহোক উপরে আমরা মোদির  হবু সদস্যদের সদস্যপদ লাভের শর্ত নিয়ে মোদির প্রস্তাবের পর্যালোচনা করলাম, দেখলাম। কিন্তু ফাইনালি ব্রিকস কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?  মানে কলোনিদখলদারি মনের মোদির ভারত নয়া শর্ত  জুড়ার যে প্রস্তাবই আনুক না কেন, শেষে ব্রিকসের এই সম্মেলন এবিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?  নয়া সদস্যপদ লাভের কীশর্ত ঠিক করেছিল?

ব্রিকসে নয়া সদস্যপদ লাভের শর্ত কী ঠিক হয়েছেঃ
সেটা ব্রিকস ঠিক খোলাখুলি আমাদের জানায় নাই। বলা ভাল ব্রিকস আসলে  তা খোলাখুলি না বলার পরোক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বে-ইজ্জতি হতে যায় না, তাই এতে বুঝা গেছে !

কিন্তু নয়া ছয় সদস্য কারা হবে আর তাতে বাংলাদেশ নাই – এই সিদ্ধান্তের তাতপর্য কী?
এই তাতপর্য ব্যাখ্যা করতে পারলেই বুঝা সহজ যে ব্রিকস এর সদস্য হবার ফাইনাল ক্রাইটেরিয়া বা শর্ত এখন কী দাঁড়িয়েছে।

সদস্য হতে শর্ত” শেষে কী দাঁড়ালো ও এর তাতপর্য কি; ঘটনা যখন ইরানঃ
ব্রিকসের  সদস্যপদ লাভের শর্ত কী তা তারা প্রকাশ্যে জানায় নাই। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ দেখে বুঝা সম্ভব যে তারা ঠিক কী চেয়েছে এবং হয়েছে বা হচ্ছে।  যেমন কারা এই ছয় রাষ্ট্র এর প্যাটার্ন যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখি ইরান এই রাষ্ট্র সদস্যপদ লাভ করেছে; যেটা একটা বিশেষ প্যাটার্ণ নির্দেশ করে। কী সেটা?  ইরানের অর্থনীতি সেই জন্মের সময় ১৯৭৯ সাল থেকেই আমেরিকার নিয়মিত ও অসংখ্য স্যাংশনে জর্জরিত। মানে ইমাম খোমিনীর বিপ্লবে স্বাধীন ইরান জন্ম থেকেই সে আমেরিকান খামখেয়ালিপনার শিকার হয়ে আছে। কিন্তু সেই ইরান এবার ব্রিকস এর সদস্যপদ পেয়েছে। যার সোজা মানে হল, এতদিন কেবল চীন বুক ফুলিয়ে ইরানের তেল কিনার ২৫ বছরের চুক্তি করেছিল। আজ ব্রিকস জানিয়ে দিল তারা ইরানের মুখের উপর যে অন্যায় লাগাম টেনে ধরার আমেরিকান খায়েস ছিল যা ইরানের অর্থনৈতিক সব সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করতে রেখেছিল – তা ব্রিকস অন্যায় মনে করছে।  ব্রিকস অন্তত (আমেরিকান স্যাংশন) যে মানতে চাচ্ছে না এটাই পরিস্কার হয়ে গেছে ব্রিকসের এই সিদ্ধান্ত থেকে। মনে রাখতে হবে  এক, খোদ ভারত ট্রাম্পের সময় থেকে ইরানের তেল যেন কেউ না কিনে তা বাস্তবায়নের বাধা হিশাবে যে স্যাংশন-শর্ত দিয়েছিল সেবারই প্রথম- মোদির ভারত তা মেনে নিয়েছিল। ট্রাম্পের জাতিসংঘ প্রতিনিধি Nikki Haley এর সেসময়ের এমন মন্তব্য নিয়ে রয়টার্সের রিপোর্ট দেখতে পারেন এখানে।  এমন অন্যায়-বেইনসাফি ভাবে সেকালে ভারতের বিক্রি হয়ে যাওয়াতে  ট্রাম্পের কাছ থেকে ভারত কী গোপন সুবিধা পেয়েছিল আমরা জানি না। তবে এরপর থেকে ভারত আর ইরানি তেল কিনে নাই, সস্তায় দিলে এমনকি নিরাপদে তেল ইরান নিজেই পৌছে দিলেও না করেছিল ভারত। আর মনে রাখতে হবে, এখনও  ব্রিকসের কোন সিদ্ধান্ত নিবার পদ্ধতি হল সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেদিকে তা নয়, বরং সর্বসম্মতিতে। এর মানে এবার মোদি সজ্ঞানে মেনে নিলেন যে ভারতও এবার ব্রিকস-এ ইরানের নয়া সদস্যপদ অনুমোদন করছে ভারত। অর্থাৎ ব্রিকসের সদস্যপদ লাভের নয়া শর্ত  যা মোদি আরোপ বা হাজির করতে প্রস্তাব করেছিল তা হাওয়া হয়ে গেছে। মোদি নিজেই  সেকথা আর আঁকড়ে ধরে বসে নাই; বরং নিজেই ফাইনালি আর কার্যকর করতে চায় নাই। কিন্তু কেন? আর তাহলে এসব ভুয়া শর্ত প্রস্তাব করেছিল কেন?

কারণ, এককথায় মোদির আনা শর্ত ছিল ভুয়া ওজনহীন!  এই শর্ত সে প্রয়োগ হোক তা চায় নাই বরং অন্য কোন উদ্দেশ্য এর ছিল। সেকথায় পরে আসবো

সদস্য হতে শর্ত” শেষে কী দাড়ালো ও এর তাতপর্য কি; ঘটনা যখন সৌদি, ইউএই (UAE) এবং মিসরঃ
নয়া ছয় সদস্য এরা আর কে কে এর অর্থ তাতপর্য খুঁজলে পাই সেখানে আরেকটা প্যাটার্ণ। সেটা হল, আরও তিন রাষ্ট্র – সৌদি আরব, ইউএই আর এমনকি সাথে মিসর। [এখানে UAE বলতে যার সাত ভুখন্ডের বৃহত্তম ফলে বড় প্রভাবশালী হল দুবাই; তবে রাজধানী হল আবুধাবি]।  এছাড়া  মধ্যপ্রাচ্যের এই তিন রাষ্ট্রের সাথে ইরানও আছে (উপরের অর্থে নয় আরও অন্য অর্থে) – এটা যদি মনে রাখি তবে এর আরও অন্যান্য অর্থ-তাতপর্য আছে সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তাই এখানে আবার ইরানের উল্লেখ সেটা প্রথম তাতপর্য হিশাবে উপরে যা লিখেছি এরও বাইরের ইরান। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বিপ্লবের পর থেকে এতদিন কেউ কাউকে সহ্য করে না এমন প্রবল দুই প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল ইরান বনাম সৌদি। আর এই দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখার বড় ফ্যাক্টর এই প্রধান শক্তি ও সমর্থক এবং সুবিধাভোগী হয়ে  সুবিধা খেয়ে গেছিল আমেরিকা।  কাজেই এখানে ইরান-সৌদি একসাথে ব্রিকসের সদস্যপদ লাভ – এই আলাদা বৈশিষ্ঠকে আমল করা চোখে তা দেখতে হবে।  এর পিছনের ঘটনা হল, সম্প্রতি  ইরান-সৌদির পুরানা সেসব বিবাদ পাশে সরিয়ে রেখে এদুই শক্তির হাত মিলিয়েছে; আর এভাবে চলার উদ্যোক্তা-মধ্যস্থতাকারি হল চীন। এতে প্রকাশিত চীনের এই সক্ষমতার কথা পশ্চিমের কেউ অস্বীকার করছে না। বরং চোখ বড় বড় করে ভীত ঈর্ষান্বিত চোখে হলেও তাদেরকেও ইরান-সৌদি ঐক্য, হাত মিলানোকে স্বাগত জানাতেই হচ্ছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ-কে ইয়েমেনের হুতি আন্দোলন ও বিদ্রোহকে সৌদি দমন থেকে যা এতদিন এক মহা মানবিক সমস্যা তৈরি হয়ে ছিল তা মিটমাটের রাস্তা খুলে দিয়েছে। হুতি ইস্যু ও এর বিবাদ থেকে বের হবার – এই ইস্যু অবসান হতে যাবার সুযোগ আসাতে প্রবল প্রশংসা করতেই হয়েছে সংশ্লিষ্ট সকলকে।  কারণ কেউই নিজেকে বিবাদ পছন্দ করা মানুষ বলে হাজির করতে পারে না।    আর  ইউএই (UAE) যার সাত ভুখন্ডের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী হল দুবাই – ওর আমীর ও তার বড় সন্তান হল বর্তমানে সৌদি আরবের MBA [প্রিন্স সালমান যিনি কার্যত সৌদি শাসক] এর সবচেয়ে কাছের বড় সমর্থক ও চিন্তা শেয়ার করা বন্ধু। অর্থনৈতিক অর্থে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা দেশগুলোতে আধুনিকতার সংস্কার আনার জন্য এদুই প্রিন্স নিজ উদ্যোগ ও কাজের জন্য যারা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছেন।  একসাথে করতে একাজে এমনকি সৌদি যেসব কাজ করতে চায় কিন্তু নিজ নামে করতে চায় না তা করে দেয় দুবাই প্রিন্স – এমনটাও দেখা গেছে। বিশেষ করে বর্তমানে সৌদিতে যে অর্থনৈতিক সংস্কার বা ঢেলে সাজানো চলছে তাতে এদুই প্রিন্সের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ণ।

তাহলে সৌদি-দুবাই আর ইরান – এ তিনের মাঝে আবার চীন, এর এক আলাদা বিশেষ তাতপর্য আছে। কী সেটা?
এটাই নব উত্থিত ব্রিকস  এই বিকল্প ব্যবস্থা কায়েমের পথে চীন প্রথম অর্থপুর্ণ পদক্ষেপ। আগে অনেকবার বলেছি ১৯৪৫ সালে আমেরিকান নেতৃত্বে এক গ্লোবাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক গ্লোবাল অর্ডার চালু হয়েছিল । ইতোমধ্যে প্রায় আশি বছর এটা চলতে পেরেছে, আজও চলছে কিন্তু এখন আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা যত কমছে এর চেয়ে বহু গুণে চীনের সক্ষমতা বেড়ে সে আমেরিকাকে জিডিপিতে  ছাড়িয়ে এক নম্বর অর্থনীতির দেশ হওয়ার পথে।  দুনিয়ার সবদেশকেই একেবারেই কম বা না সুদে অবকাঠামো বিনিয়োগ যোগানোর সক্ষমতা – এটাই কোন দেশের গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হওয়ার একেবারে প্রাথমিক যোগ্যতা। কারণ এমন বিনিয়োগ দানের সক্ষমতা যখন কোন দেশের অর্থনীতির হয়, এটাই দুনিয়ায় বেশির ভাগ দেশের উপর ঐ সক্ষম দেশের প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা হয়ে দাড়ায়, দাঁড়াবেই। আমেরিকার বদলে ওর এতদিনের গ্লোবাল নেতৃত্বের জায়গায় চীন উঠে আসতেছে, দখল করতেছে – এভাবেই দিন কে দিন দৃশ্যমান হাজির হয়ে উঠছে।ঙ্কারণ,  গরীব তো বটেই এমনকি মধ্যম আয়ের দেশগুলোও (যেমন আশিয়ান জোটের দেশগুলো) যারা অবকাঠামো ঋণ পেতে ৩% পর্যন্ত সুদ দিতে প্রস্তুত (কারণ, আমেরিকার নেতৃত্বের পুরানা ব্যবস্থাটা মানে বিশ্বব্যাংক এমন সরকারগুলোকে অবকাঠামো ঋণ আর দেয়ই না তবে এসবদেশের প্রাইভেট কোম্পানিকে হলে দিতে রাজি। এই নীতি ফলো করে বিশ্বব্যাংক।) তাই, এদের কাছে চীনা অবকাঠামো ঋণ খুবই কাম্য। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য চীনের AIIB -এই ব্যাংক তাই মধ্যম আয়ের দেশগুলোর কাছে খুবই আদরণীয়!   আর মনে রাখতে হবে, এখনকার চীনের মত একটা দেশ যখন একবার অর্থনৈতিক সক্ষমতার চরম বৃদ্ধির স্তরে পৌছে [মানে নিজ অর্থনীতি বিপুল সারপ্লাস জমা করতে থাকে বা উদ্বৃত্ব সম্পদে ভরে উঠে ] এমন হয়ে যাবার অর্থ হল এরপরের দশ বছরের মধ্যেই ঐ দেশ সামরিক শক্তি হিশাবে সে হাজির হতে, দৃশ্যমান হতে শুরু করতে পারে।  আর এসব সম্ভাবনা ও সুবিধার কারণে চীন গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতৃত্বে আমেরিকার জায়গায় বসে যাবার সুযোগ পেতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, আর তা কমবেশি খোদ আমেরিকাই মেনে নেওয়া বা রেফার করে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে।
এটাকে আমি বারবার গ্লোবাল পালাবদল বলছি। আর এটা নিয়ে একদল আছে যাতা এটাকে কথিত ভুরাজনীতিক ঘটনা বলে পরিচয় করাতে চাচ্ছে। এভাবে নিজের অজ্ঞতা ঢাকার কিছু নাই, এটা অপ্রয়োজনীয়। ভূরাজনীতি বা জিও-পলিটিক্স  এই শব্দের মধ্যে যে ভূ [geo- জিও] শব্দটাই তো সঠিক নয়। কারণ এটা গ্লোবাল অর্ডার এরই নেতৃত্বের মধ্যে পালাবদলের ঘটনা।  যেখানে রূট শব্দ ও ধারণাটা হল গ্লোবাল [Global]। যা ভূ [geo- জিও] একেবারেই না। কারণ,  গ্লোবাল আর জিও- একই শব্দ না, এক অর্থও না। তবে গ্লোবাল না বলে অনেক বাংলায় “বিশ্বব্যবস্থা” লিখে; সেটা চলতে পারে।  এটা বোকা বোকা অবুঝ শব্দ  ভূ [geo- জিও]  বলার চেয়ে ভাল!

নয়া গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হয়ে উঠছে চীন – এই লক্ষ্যেই চীন পুরানা  গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট করে কেবল গ্লোবাল মুদ্রা ও বাণিজ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক আইএমএফ আর অবকাঠামো ঋণ দেবার বিশ্বব্যাংক – এই দুই গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের পাল্টা ও বিকল্প সমতুল্য প্রতিষ্ঠান গড়তে উদ্যোগ নিতেই এমন এক জোট খাড়া করেছে যাকে আমরা ব্রিকস বলে চিনছি।
তবে আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংক এর সমতুল্য (কিন্তু চীনা নেতৃত্বে) এমন বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়া সহজ কাজ নয়। এছাড়া গড়ার কাজটা চীনের বেলায় শুরুতে সে কিছু দেশকে সাথে নিয়ে বসে কথা শুরু করেছে।  বৈঠকে বসে শুরু করলেই তা খাড়া হয়ে বা কার্যকর হয়ে যাবে না।  সে পথের প্রধান বাধাথল – এখনকার ব্যবস্থায় আমেরিকান ডলারেই বেশির ভাগ আন্তঃরাষ্টীয় লেনদেনবিনিময় বাণিজ্য  (আমদানি-রপ্তানি) সম্পন্ন হওয়া আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা একেবারেই কমে গেলেও এ’জায়গায় ডলারের উপর ব্যবহার কারি দেশ ও মানুষের পুরানা আস্থা অভ্যাস সহসা বদলে দেয়া যায় না একারণে। ইতোমধ্যে বাইডেন প্রশাসন  স্যাংশন দেয়ার অতিব্যবহারের কারণে একটা বড় সংখ্যাক দেশ চাইছে ডলার নির্ভরতার বিকল্প – এমন দেশগুলোর শীর্ষে আছে রাশিয়া। হাসিনার বাংলাদেশও অতি আগ্রহী। কিন্তু আগেই বলেছি এটা ঘরে বসে বিকল্প খাড়া করে দিবার বিষয় নয়। তাতে রাশিয়া বা বাংলাদেশ এর মত দেশগুলো যতই ছটপট করুক! তাহলে ডলার মুদ্রা ভিত্তিক বাণিজ্যের আধিপত্য একে পিছনে ফেলে মানে ডলারে ব্যবসাকে সেকেন্ড অবস্থানে নামিয়ে দিয়ে, পরের সবচেয়ে চালু মুদ্রা ইউয়ান, একে সামনে আনার উপায় কী?

গত ২০১৫ সালে চীনা ইউয়ান মুদ্রাকে আইএমএফ অনুমোদিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিশাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তার আগে এমন আইএমএফ অনুমোদন দেয়া মুদ্রাগুলো হল (শুরুতে মার্কিন ডলার ছাড়াও) বৃটিশ পাউন্ড, জাপানিজ ইয়েন, ইইউ এর ইউরো। আর এসবের সাথে সেবার পঞ্চম কারেন্সি তখন হয়েছিল ইউয়ান[Yuan] কিন্তু ইউয়ান ইতোমধ্যেই লেনদেনের মুদ্রা হিশাবে ডলার বাদে বাকি মুদ্রাগুলোকে ছাড়িয়েছে।  তাই এব্যাপারে চীনা গবেষণা অনুমান যা পরোক্ষে প্রকাশিত – এর ভাষ্য অনুযায়ী এমন চাবিকাঠিটা হল চীন প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কিনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ হিশাবে। তাই সুস্থির চীন আর সাথে অস্থির রাশিয়া উভয়েই মনে করে যে এসব জ্বালানি ক্রয়ের পেমেন্ট যদি ডলারের বদলে ইউয়ানে বদলে দেয়া যায় তাহলে মার্কিন ডলার ডমিনেন্সের উপর এক বড় ধাক্কা দেয়া সম্ভব। আর তাতেই ইউয়ান হয়ে যেতে পারে গ্লোবাল বাণিজ্য-লেনদেনের প্রধান মুদ্রা । মানে গ্লোবাল বাণিজ্য ঘটবার প্রধান মুদ্রা হয়ে উঠতে পারে ইউয়ান।  যেটা গ্লোবাল বাণিজ্যে  মোটামুটি ৬০% এর বেশি হয়ে কোন মুদ্রা পৌছাতে পারলে তবে এরপর তা ক্রমশ বাড়তে থাকে  – আর তাকে সহসাই নামানো যায় না।  যে পথে এখন ডলার উত্থিত হয়ে আছে! চীনা ইউয়ান উত্থানে এক নম্বর মুদ্রা হয়ে উঠতে এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য পরিকল্পিত পথ এটাকেই মনে করা হয় – তাত্বিক ও অর্থনীতিবিদ পর্যায়ের ধারণায়। আর, এপথেই চীন আগাচ্ছে বলে মনে করা হয়। এনিয়ে গত ২০১৫ সালে আমারই অনেক লেখা আছে।

কাজেই এটা এখন বলাই বাহুল্য যে এই পথে গ্লোবাল বাণিজ্যকে ঠেলে দেবার ক্ষেত্রে সৌদি আরব কেন চীনের কাছে গুরুত্বপুর্ণ ও অন্যতম এক নির্ধারক শক্তি।  ইউএই(UAE) এর তেলবিক্রির সক্ষমতা খুবকিছু না থাকলেও সে সৌদির যেকোন কাজ-উদ্যোগের এক নম্বর সহযোগী-সমর্থক। আর এবার এদের সাথে ইরান,  যে ১৯৭৯ সাল থেকেই জ্বালানি বিক্রি সক্ষমতা থাকা সত্বেও গরীব দেশ হয়ে আছে, ইরানি অসুস্থ বাচ্চার জন্য ওষুধ কিনে দিতে অর্থনীতি অক্ষম হয়ে পড়ে ছিল – সেই ইরান গত ৪৪ বছরে খুব কম সময়েই সে নিজের তেল বিক্রি করতে পেরেছে। এই ইরানও এবার যুক্ত হয়ে গেছে যেটা এর আগে সৌদি-ইরান বিরোধ লাগিয়ে রাখার জন্য ইরান আরো অসহায় হয়ে ছিল। এখন হবে উলটা। এবার ঠিক তেল বিক্রি না তবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গ্লোবাল ভুমিকার নায়ক হয়ে উঠবে এই তিন দেশ।  আমরা মনে রাখতে পারি ইরান-চীন ২৫ বছরের বাণিজ্য-বিনিয়োগ চুক্তির কথা। যার সার কথা ইরানের তেলের বিনিময়ে চীনা ঋণ, বিনিয়োগ টেকনোলজি আর চীনা বাজার সবই উন্মুক্ত হবে ইরানের কাছে।   এছাড়া এর আরো সম্ভাবনা – মানে কোন দিকে সম্ভাব্য কী হতে পারে সেদিকে তাকালে পাই তুরস্কের এরদোয়ান-কে। যদিও তিনি শুরুতেই যোগ দিতে অপারগ হবেন। তা হলেও এটা বলাই যায় যে ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য এখন চীনের পক্ষে ও হাতে চলে গেছে।  তাই সৌদি, ইউএই (UAE) এবং মিসর কে ব্রিকসের সদস্য করে নেয়া এটা ছিল চীনের  কাছে বিরাট প্রায়োরিটি; অন্তত বাংলাদেশের তুলনায়। যদিও বাংলাদেশ চীনের জন্যও খুবই গুরুত্বপুর্ণ – এখানে ভারতের চেয়েও চীনকে প্রভাবশালী হয়ে উঠতেই হবে! কিন্তু বর্তমান অস্থিরতায় সে হাসিনার টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে দেখে – আর তা বুঝা যায় কেন সে বাংলাদেশের চেয়েও মধ্যপ্রাচ্যকে প্রায়োরিটীতে উপরে রাখলো

 এতদিন মিসর ছিল আমেরিকান সক্ষমতার এক প্রধান হাতা, এক নির্ভরশীল ফ্যাক্টর। এখন কী হবেঃ
মূলকারণ, ১৯৭৮ সালে আমেরিকান মধ্যস্থতায় ইসরায়েলকে মিসরের সাথে ক্যাম্প-ডেভিড চুক্তি করতে বাধ্য করেছিল আমেরিকা। আর এর মাধ্যমেই কিসিঞ্জারের মধ্যপ্রাচ্য পলিসির (তেলের উপর খবরদারি সহ) [Kissinger ME policy] এতদিন প্রধান পশ্চিমা-নীতি মধ্যপ্রাচ্যে কার্যকর হয়ে ছিল। আর এর সুযোগেই আমেরিকা ইসরায়েলকে দিয়ে বারবার ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ হাতে পেয়েছে, ব্যবহার করে। মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকার হাতের মুঠোয় হয়ে যাওয়ার  চাবি কাঠি হয়ে ছিল এতদিন। আমেরিকার এই বিশেষ প্রভাব ও সক্ষমতাটাই এখন দুর্বল হয়ে শুরু করবে; চীনা প্রভাব এর উপরে জায়গা নিবে। এটাই গ্লোবাল অর্থনৈতিক পালাবদল বা এর আরেকটা প্রকাশের দিক!
কিন্তু এবার চীনা মধ্যস্ততায়  সৌদি, ইউএই (UAE) এবং ইরানের সাথে মিসরও এসে যাওয়াতে ইসরায়েল – সেও এখন আমেরিকার চেয়েও সরাসরি চীনের সাথে যোগাযোগ করে নিজ নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। ইরানকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমাণাত্মক অবস্থান যদি কমাতে চায় তবে চীনের কাছে যেতে হবে। চীনের মাধ্যমে ইরানের কথা শুনতে হবে।  ক্রমশ মধ্যপ্রাচ্য মানেই  চীনই সেখানকার একমাত্র কার্যকর শক্তি ও জায়গা  – এমন বলে মেনে নিতে হবে  – যারই মধ্যপ্রাচ্যে স্বার্থ আছে এমন সকলকেই  – ঘটনা ফেনোমেনোর অভিমুখ এখন সেদিকে আগিয়ে গেল। আমেরিকার চেয়ে চীন এখন ইসরায়েলের কাছে নিজ নিরাপত্তার নিশ্চিত করার স্বার্থে অনেক বেশি ওজনদার প্রভাবের দেশ হয়ে উঠার সম্ভাবনা। এককথায় ইসরায়েল-মিসর সহ সারা মধ্যপ্রাচ্যে চীন এখন আমেরিকার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় প্রভাব নিয়ে হাজির হতে থাকবে। আর এসব ততপরতা পিছনের এক  নয়া গ্লোবাল অর্থনৈতিক ভিত্তির যোগানদার হয়ে হাজির হবে ব্রিকস ও চীনা নেতৃত্ব।

তাহলে মোদির দেয়া সদস্যপদ লাভের শর্তের কী পরিণতি হলঃ 
এক বা্ক্যে  সারকথাটা বললে, মোদির ভারত চেয়েছে হাসিনার বাংলাদেশ যেন অন্তত এবার ব্রিকস সদস্যপদ লাভ নাকচ হয়ে যায়। আর সেটাই মোদি ঘটিয়েছে বিনিময়ে, চীনের অন্যস্বার্থে সে সম্মতি দিবে এই কৌশল করে। এটাকে আপাতত মোদি নিজের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য মনে করতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এতে সারা বাংলাদেশ এখন মোদির ভারতকে প্রবল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এক দানব রাষ্ট্র যাকে পরাজিত করতেই হবে বলে গণ্য করা শুরু করে দিয়েছে পপুলার বাংলাদেশ। এতে বলাই বাহুল্য বাংলাদেশে ভারতের নুন্যতম প্রভাবও যেন না থাকে এটাই তারা আগামি যেকোন সরকারের কাছে দেখতে চাইবে। আর এটা ভারতের যেকোন শাসক শত কান্নাকাটি অথবা শত ষড়যন্ত্র করেও ফিরাতে পারবে না।
শেষ বিচারে মোদি তাই এতে ভারতের লাভের চেয়ে বরং বিশাল ক্ষতি ডেকে আনলেন। মোদি সেই কাজটাই করলেন! যেটা অন্যের জন্য খাল কাটা! আগামিতে বাংলাদেশে কোন দলের পপুলার ক্ষমতার উপর ভর করে আসার একনম্বর ফ্যাক্টর হয়ে গেল ভারতের প্রভাবশুন্য করার নীতি-পলিসি দেখানো।

বাংলাদেশ যেন অন্তত এবার ব্রিকস সদস্যপদ লাভ নাকচ হয় এটা মোদি ঘটিয়েছে বিনিময়ে, চীনের অন্যস্বার্থে সে সম্মতি দিবে এই কৌশল করে।
এটাকে আপাতত মোদি নিজের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য মনে করতে পারে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে এতে সারা বাংলাদেশ এখন মোদির ভারতকে প্রবল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এক দানব রাষ্ট্র যাকে পরাজিত করতেই হবে
বলে গণ্য করা শুরু করে দিয়েছে পপুলার বাংলাদেশ। এতে বলাই বাহুল্য বাংলাদেশে ভারতের নুন্যতম প্রভাবও যেন না থাকে এটাই তারা আগামি
যেকোন সরকারের কাছে দেখতে চাইবে। আর এটা ভারতের যেকোন শাসক শত কান্নাকাটি অথবা শত ষড়যন্ত্র করেও ফিরাতে পারবে না।
শেষ বিচারে মোদি তাই এতে ভারতের লাভের চেয়ে বরং বিশাল ক্ষতি ডেকে আনলেন। মোদি সেই কাজটাই করলেন! যেটা অন্যের জন্য খাল কাটা!
আগামিতে বাংলাদেশে কোন দলের পপুলার ক্ষমতার উপর ভর করে আসার একনম্বর ফ্যাক্টর হয়ে গেল ভারতের প্রভাবশুন্য করার নীতি-পলিসি দেখানো। 

 

কিন্তু আপাতত বাংলাদেশের হাত ছাড়তে কেন চীন এতে রাজি হলঃ
এর উত্তরটা, প্রশ্নটাকে আরেক ভাবে বুঝে বা পেশ করে দেয়া যাক। ছয়টা দেশ এবার সদস্যপদ লাভ করলো – এর সোজা অর্থ তাহলে এর স্বপক্ষে মোদির ভারতও সমর্থন দিয়েছে নইলে তা সর্বসম্মত হত না – তা পাশও হত না।  আর মোদি এই সমর্থন দিয়েছে – অবশ্যইচীনের সাথে একটা কিছুর বিনিময়ে। আর এটাই বাংলাদেশে সদস্যপদ সওদা [bounty] হয়ে যাওয়া!
আসলে, চীন বাংলাদেশ বাদে যাদেরকে সদস্যপদ এবার দিতে চায় তাতে মোদির সম্মতি কিনে নিয়েছে। আর এই কেনা-বেচার সওদা হয়েছে বাংলাদেশের সদস্যপদ না পাওয়া। বাংলাদেশ যেন সদস্যপদ না পায় এতে চীনকে রাজি করিয়ে বিনিময়ে মোদি ঐ ছয় রাষ্ট্রের সদস্যপদ লাভে নিজ অনুমোদন দিতে রাজি হয়েছে। বলা যায় এই হল, চীনের সাথে মোদির ডিল বা গিভ এন্ড টেক!  কাজেই এখানে মোদি এখানে ব্রিকসের নয়া সদস্যপদ লাভের শর্ত যাই পেশ করুক প্রকৃতপক্ষে সবই ছিল ভুয়া, দেখাইন্না এক বাহানা মাত্র। আর ওদিকে সবকিছু শেষ হয়েছে এই ডিলের মাধ্যমে! কিন্তু মোদি কেন এমন চরম হাসিনাবিরোধি অবস্থান নিল?
এটা কমবেশি অনেকের  কাছেই পরিস্কার যে ২০১৯ সাল থেকে হাসিনা ভারতের চেয়ে অনেক বেশি চীনের সাথে কমিটেড। ২০১৮ এর নির্বাচন যেমনই হোক, কথিত ঐ নির্বাচনের ব্যয় চীন যোগানোর মাধ্যমে এই সম্পর্ক যাত্রা শুরু করেছিল। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর বা চীনা তিস্তা প্রকল্প ইত্যাদি চীনের আগ্রহ যেগুলোতে বিশেষ করে যেগুলো ভারতের আপত্তি বা হাসিনাকে ফুসলিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে এতদিন যেসব প্রজেক্ট ভারত হাসিনাকে নিতেই দেয় নাই। নাকচ বা বন্ধ করে দিয়েছে মূলত সেগুলোতেও তখন থেকেই চীন চেয়েছে হাসিনাকে সিদ্ধান্ত নিতে রাজি করানো – এটাই ছিল চীনেরর মূল লক্ষ্য।  আর এগুলো সবকিছুর উপর যেকোন উপায়ে বাধা দেয়া – এটাই গত সাড়ে চার বছর মোদির ভারত চেষ্টা করে গেছে। যেমন, চীনা তিস্তা প্রকল্পে ভারতের সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দিকে ১৬ কিমি পর্যন্ত চীনারা কোন কাজ করতে পারবে না বলে ভারত আপত্তি  তুলে রেখেছে।  তিস্তার মত প্রকল্পগুলোতে চীনকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না দেয়ার পিছনে এমন ভারতীয় আপত্তিকে উপেক্ষা করে হাসিনা কাজ করতে পারে নাই। তবে সব প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন এগিয়ে যেতে পারে নাই আর বাধা সৃষ্টি করে রাখার বেশি কিছু ভারত করতে পারে নাই – এই হল এক খামোখা ব্যলেন্সিং পয়েন্ট এমন হয়ে থেকেছে। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে পরিকল্পনা হল আগামিতে হাসিনা যদি নিজেকে আবার বিজয়ী বলে যেভাবেই হোক ঘোষণা করতে পারে তাহলে এরপরেই ভারতের আপত্তিগুলো পায়ে মারিয়ে চীনের সাথে হাসিনা এগিয়ে যাবে এই ছিল চীনের সাথে সরকারের বুঝাবুঝি – অনুমিত ধারণাটা এরকম। পশ্চিমা গোয়েন্দা ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট গুলোও এরকম ধারণা দিচ্ছে। অথচ অন্য কোন কিছু দিয়ে হাসিনাকে ফিরাতে মোদি ব্যর্থ হয়ে থাকছিল।  এতে হাসিনার যুক্তি ছিল সে চীনের সাথে এমন ডিল না করলে ক্ষতায় ফিরতে পারবে না – আমেরিকান চাপ ফেরানো অসম্ভব। আর মোদির যুক্তি হাসিনা-চীনের এই ঘনিষ্ঠতা মোদির ভারতের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।  এই ত্রিভুজ সংকট পরিস্থিতিতে না পেরে মোদি হাসিনাকে থামাতে গিয়ে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে – মোদি খোদ চীনের সাথেই ডিল করে বসেছে।
তাহলে চীনের দিক থেকে – সেই-ইবা কেন মোদির প্রস্তাবে রাজি হল?

চীনকে দেয়া  মোদির ডিল-প্রস্তাব যে হাসিনার হাত ছেড়ে দিতে হবে – এতে চীন কেন রাজি হল?
এখন এটা তো সবাই জানে দেখাই যাচ্ছে যে বাস্তবতা হল,  চীন ও মোদি উভয়েই  বা এরা দুপক্ষই  হাসিনার হাত ছেড়ে দিয়েছে। বা বাংলাদেশকে ব্রিকসের সদস্যপদ না দিতে তারা এক ঐক্যমত্য কায়েম করেছে।  এর মানে মোদির ডিল-প্রস্তাবে চীন হ্যা দিয়েছে। তাহলে চীন এমন করল কেন? বাস্তবত  চীনের এতে রাজি হয়ে যাওয়া এটাই সব বলে দিচ্ছে যে খুব সম্ভবত চীনের  ক্যালকুলেশন-অনুমান হল, হাসিনা আর আগামিতে ক্ষমতায় থাকতে বা ফিরতে পারছে না। তাই, মোদির ডিল-প্রস্তাব চীনের মেনে নিয়ে হাসিনাকে ছেড়ে দেয়া আর বিনিময়ে বাজি ছয় রাষ্ট্রকে সদস্যপদ দেওয়া প্রশ্নে মোদির ভারতকে দিয়ে সমর্থন দেওয়ানো – এই ডিল গ্রহণই চীনের জন্য সহি বেটার ডিল এবং সবচেয়ে লাভজনক!

অর্থাৎ মোদি যা চেয়েছিল তা পেয়ে নিয়ে বাসায় গেছে। চীনও যেটা বেশি লাভজনক তাই পেয়ে নিয়ে ফিরে গেছে। মাঝখানে হাসিনা এদুইয়ের বেচা-বিক্রির ডিলের মধ্যে পরে সবই হারিয়েছে।
এছাড়া চীনের দিক থেকে দেখলে  তার ইউয়ানকে ডলারের স্থান নেওয়ার  পক্ষে  কাজ শুরু করার  স্বার্থ মানে এর পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যকে কাজে লাগানো এটা অনেক বেশি অর্থপুর্ণ। ও বড় প্রায়োরিটি। সেটাই সে পেয়ে গেছে।

শেষ করব তাহলে ইথিওপিয়া আর আর্জেন্টিনা কেন সদস্যপদ পেলো এর তাতপর্যঃ
ইথিওপিয়া সম্পর্কে  বাইরের বিশেষ করে এশিয়ার মানুষের ধারণা খুবই কম। সৌভাগ্যবশত আমার প্রায় তিন বছর ওর রাজধানী আদ্দিস আবাবা-তে বসবাসের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করেই কিছু কথা বলব।
ইথিওপিয়ার বৈশিষ্ট একঃ
বাইরের দুনিয়া থেকে বা অন্য মহাদেশ থেকে আফ্রিকার প্রবেশের গেটওয়ে মূলত তিনটা। বিশেষ করে বাণিজ্যিক বিমানের রূটগুলো লক্ষ করলে বুঝা যায়। আপনাকে সবার আগে কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর না হয় ইথিওপিয়াতে ঢুকতে হবে।  এসব ফ্লাইট নিতে হবে। পরে যে আফ্রিকান দেশে যেতে চান  সেদেশের ফ্লাইট বদলে নিতে হবে কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর না হয় ইথিওপিয়া থেকে। মানে এই তিন দেশই হয়ে উঠেছে আফ্রিকার যেখানে যেতে চান এরই হাব বা প্রথম মোকাম দেশ।
ইথিওপিয়ার বৈশিষ্ট দুইঃ
আফ্রিকা থেকে কলোনি দখল উঠে গেছে এশিয়ার পরেপরেই – ১৯৬০-৮০ এই সময়ের মধ্যে  ব্যাতিক্রম কেবল সাউথ আফ্রিকা ১৯৯৪।  আর একেবারেই ব্যতিক্রম হল ইথিওপিয়া যে কখনও কলোনিদখলও হয় নাই। শুধু তাই না, পুরা দুই বিশ্বযুদ্ধের সময় ইথিওপিয়া রাজা হাইলে সেলাসি শাসিত দেশ ছিল। রাজা ক্ষমতায় ছিল ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। যতক্ষণ তা এক সোভিয়েত কমিউনিস্ট সমথিত  সামরিক ক্যু ঘটেছিল হাইলে মেঙ্গাস্তু [Mengistu Haile Mariam] -র হাতে। আরও পরে ১৯৯১ সালে চীনাস্ইটালে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার মত আরেক কমিউনিস্ট গ্রুপ এখন ক্ষমতায়। আর সেনাবাহিনী হল ঐ গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা।
সারা আফ্রিকার আর বড় পিছনে পড়ে অক্ষমতা হল, নুন্যতম পুজি বিকশিত বা শহরায়ন ঘটবার আগেই কলোনিদখল হয়ে যাওয়া। কথাটা অন্যভাবে বললে, সারা আফ্রিকার মানুষ আগে শহর কী জিনিষ তা দেখেনি। কলোনি মাস্টারেরা দখলের পর তারাই শহর গড়েছিল – মানে এসব মাস্টারের হাত ধরেই আফ্রিকার মানুষ শহর কী তা চিনেছিল। তুলনায় ভারতে বৃটিশেরা দখল নিবার আগেই আমাদের অন্তত তিনটা বড় বড় সমৃদ্ধ শহর (লক্ষ্ণৌ, হায়দ্রাবাদ আর দিল্লি) গড়ে উঠে গিয়েছিল।  আর এসব শহরের শহুরে পোষাক-ই হলো পাঞ্জাবি, এজন্য এটা কোন ধর্মের পোষাক নয়। শহরের প্রতীকী পোষাক বলে তা এখনও ভারতের সামাজিক অনুষ্ঠানে বা বিয়ের মুখ্য পোষাক!
আফ্রিকার এই মারাত্ম পিছনে পড়ে থাকা এটা এতই মারাত্মক যে কলোনি শাসকেরা ফিরে গেলে সাধারণ ট্রেডিং  মুদিখানা বা পষাকের মত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ট্রেডিং – এটা শুরু করার মত মধ্যবিত্ত আফ্রিকার প্রায় সব দেশেই গড়ে উঠে নাই। আর এজায়গাটাই দখল করে আছে বৃটিশদের হাত ধরে আফ্রিকার মাইগ্রটেড ভারতীয় শ্রমিক পরিবারেরা। অথচ এই কমন চিত্রের একমাত্র ব্যতিক্রম হল ইথিওপিয়া।
একালে অবকাঠামো পুঁজি ও সাথে FDI বা বিদেশি কারখানা পুঁজিও চীনের চীনের কারণে পাওয়া সহজ হয়েছে বলে এমন পুঁজি কাজে লাগানোর সক্ষমতা ইথিওপিয়ার সবচেয়ে বেশি। একারণের চীনের চোখে এক গুরুত্বপুর্ন গন্তব্য হল ইথিওপিয়া! মানে এটাও আফ্রিকায় চীনেরই বড় স্বার্থের দেশ যাকে চীন ব্রিকস এর সদস্য করে নিল!

সবশেষে আর্জেন্টিনাঃ
গত কমপক্ষে সাত বছর ধরে লাগাতর আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিক অবস্থা ডুবন্ত। যার মুদ্রাস্ফীতি ১০০% এর বেশি আর ৪০% এর বেশি লোক দারিদ্র সীমার নিচে চলে গেছে। এঅবস্থায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা  আর্জেন্টিনার কেস ব্রিকসে নিয়ে আসে, বিশেষ করে চীনের নজর ও বিবেচনায়।  ভেনেজুয়েলা যেমন সেবার চীনের কাছে কিউবান সুপারিশ  পেয়েছিল।  তেমনই আর্জেন্টিনাওপক্ষে পাওয়া শক্ত সুপারিশের কারণে চীনের নজরে আসায় এর পরিণতিতে র্আজেন্টিনাও এবার ব্রিকসের সদস্যপদ লাভ করে যায়। আর এতে চীনের আরেক বড় লাভ হয় নিজের পক্ষে ব্রাজিলের সমর্থন ও আস্থা আরো পোক্ত হল।

তাহলে এককথায় বললে ছয় নয়া সদস্যই অনুমোদন পেয়েছে মূলত চীনের আগ্রহ ও সমর্থনের কারণে।  কারণ,  মোদি যতই ভাব দেখাক ব্রিকস বলতে এর মূল সক্ষমতা তো চীনের।  একমাত্র চীনেরই আমাদের মত দেশকে অবকাঠামো বা অন্যধরণের পুঁজি ঋণ দিবার সামর্থ আছে। তাতে ব্রিকস এর উদ্যোক্তা সদস্য আরো চার রাষ্ট্র হলেও এরা হল ডেকোরেশন!  বাস্তবত কার্যত চীনই মূল চালিকাশক্তি। তাতে ভারতের মোদি যতই ভাব দেখাক! বাংলাদেশকে ব্রিকসের বাইরে রাখুক!
এরই রিফ্লেকশন ঘটতে বা ছাপ পড়তে দেখেছি আমরা এবারের নয়া সদস্যপদ বিতরণে!

আপডেটেডঃ  ২৮  আগষ্ট  ২০২৩; রাত ২ঃ ১৩
সর্বশেষ  আপডেটেডঃ  ২৯ আগষ্ট ২০২৩;  সকাল ০৮ঃ ১১ 

>
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

Leave a comment