বার্মা নিয়ে আমেরিকান বোকা পরিকল্পনায় উলটা,
এখন সব নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে উঠার পথে
গৌতম দাস
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সন্ধ্যা ১৭ঃ ৪৮
https://wp.me/p1sCvy-5mC
China success, Western failure in revolutionary Myanmar
বর্তমানের বার্মা নিয়ে বিশেষ করে তার “সীমান্ত যুদ্ধ” নিয়ে অজানা আশঙ্কা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। যদিও এটা দুই দেশ বার্রমা ও বাংলাদেশের মধ্যে – “সীমান্তে ঘটা কোন যুদ্ধ”- নয়। বরং একই বার্মার সেনা সরকার আর বিদ্রোহী এথনিক (ethnic) গোষ্ঠির যুদ্ধ। কিন্তু ঘটনাস্থল যেহেতু বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্ত আর সেনা সরকারের বাহিনী বলতে তারা কার্যত বার্মার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি বা Border Guard Police) ফলে, “বিজিপি বনাম বিদ্রোহী গোষ্টির” যুদ্ধের গোলা কখনও কখনও বাংলাদেশে এসে পড়ছে। আর এটাই সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশিদের জনজীবনকে মারাত্মক আতঙ্কিত করছে। এতে এলাকার বাংলাদেশি প্রশাসন বাসিন্দাদের সরিয়ে নিরাপদ দুরত্বে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেটা সঠিক সিদ্ধান্ত।
বার্মা কী আর, কোথা থেকে এখানে, এর পিছনের পটভুমি নিয়ে কিছু কথাঃ
বার্মার পিছনের পটভুমির দিক নিয়ে অল্প কথায় বললে, প্রথমত, বার্মা কখনও জনগণের ক্ষমতার উপর দাঁড়ানো অন্তত মুখে বা কনষ্টিটিউশনে লিখে স্বীকার করা অর্থেও কোন রিপাবলিক রাষ্ট্র করা হয় নাই, ছিল না আর এখনও নয়। রিপাবলিক বলতে বুঝায় যে, ঐদেশের শাসনক্ষমতা (ruler) যখন স্বীকার করে নেয় যে তার ক্ষমতার উতস একমাত্র জনগণ; মানে ঐ দেশের বাসিন্দা-পাবলিকেরা নিজ দেশের শাসকদেরকে একটা শাসন ব্যবস্থা স্থাপনের লক্ষ্যে (গণভোটে বা জনপ্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে) রায়-ম্যান্ডেট দিয়েছে। আবার এই শাসকেরা রাজা-বাদশা নয় অথবা রাজা-বাদশার উত্তরাধিকার সুত্র তারা নিজেদের রাজা বলে দাবী করছে না। এই অর্থে বার্মা কখনই কোন রিপাবলিক নয়। এমনকি দেশের নামেও রিপাবলিক শব্দটা নাই; তাহলে বার্মা কী এর সবই অস্পষ্ট। তাই বার্মার শাসক বলতে আসলে, এখানে মূল ক্ষমতাটা এক ধরণের মিলিটারীদের একটা ক্লাবের হাতে যাদের উপরে কেউ নাই; আর তারাই দেশটাই মালিক ও ক্ষমতাধারী। এভাবেই এটা চলে আসছে অং সান সুচি এর বাবাদের [আমরা যে নামে চিনি এই “সু চি” এর বাবার নাম অং সান (Aung San)] আমল থেকে।
কেন এরকম? এর মৌলিক কারণ হল বার্মা দেশের বাসিন্দাদের মেন্টর (Mentor) [মানে যাদের চিন্তা অনুসরণে বা প্রভাবিত হয়ে] – বার্মার এই মেন্টর কারা ছিল সেটা বুঝতে হবে আগে। যেমন, আমাদের উপর মেন্টর – প্রভাবক ভুমিকা যদি বৃটিশ কলোনিদখলদার বা ভারতের উপর বৃটিশদের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা-কে বলি তবে বার্মার মেন্টর হল সেকালের রাজতন্ত্রী জাপান। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) এশিয়ায় হিটলারের সহযোগী একমাত্র শাসক ছিল জাপান আর সে জাপান তখনও সম্রাট শাসিত ছিল। অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধে দুপক্ষের প্রধান রাষ্ট্রগুলো সকলেই রিপাবলিক হলেও জাপান ছিল এক ব্যতিক্রম – ছিল সম্রাটের সাম্রাজ্য। একারণে, এখনও জাপান রাষ্ট্রের নাম কি – তা খুঁজে দেখলে সেই আনুষ্ঠানিক নামে কোন রিপাবলিক শব্দ নাই। এর বদলে সব জায়গায় ‘ইউনিয়ন’ বলে একটা শব্দ আছে যার আবার সুনির্দিষ্ট অর্থ নাই। অর্থাত পাবলিক বা জনগণের ক্ষমতা বলে বা বুঝায় – এমন কোন ধারণা ইঙ্গিতও নাই।
বৃটিশেরা ভারতের মতই বার্মা দখল ও কলোনি করেছিল ১৮২৪ সালে। কিন্তু এই দখলি বার্মা-কে তারা ভারতের সাথে মাখিয়েই শাসন করে গেছিল। যেমন দখলি-বার্মা ভুখন্ড যেন ভারতেরই আরেকটা প্রদেশ এভাবেই তারা শাওন শুরু করেছিল। তবে এনিয়ে তরুণ বার্মীজদের মনে চরম অসন্তুষ্টি টের পেয়ে গত ১৯৩৭ সালের এপ্রিলে প্রথম বৃটিশ-ভারত বর্মাকে ভারত থেকে আলাদা করে বৃটিশদের কলোনি শাসন কায়েম করেছিল। অর্থাৎ এর আগে পর্যন্ত বৃটিশ-ভারতেরই আরেকটা প্রদেশ যেন বার্মা – এভাবেই বৃটিশেরা বার্মা শাসন করে গিয়েছিল। আর চলমান ব্যাপক এই ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয় তরুণদের মধ্যে থেকে নানা ঘটনাবলী শেষে একপর্যায়ে প্রথমে এদের ত্রিশজনকে (যারা বার্মার শাসকদের ভয়ে তখন থাইল্যান্ডে পালিয়ে ছিল) – এদের জাপানে নিয়ে ট্রেনিং দিয়েছিল জাপানের রাজতন্ত্রী সরকার। এই ত্রিশজনের একজন হলেন সু চির বাবা। কিন্তু তাদের ঐ ট্রেনিংয়ের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা বা খারাপ দিকটা হল, বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যারা এই ট্রেনিং দিয়েছিল তারা রাজতন্ত্রী। তাই এই ট্রেনিং কোন রাজনৈতিক ট্রেনিং ছিল না। কোন মনার্কি [monarchy] বা রাজা-বাদশার দেশে রাজনীতি ধারণা বা রাজনৈতিক দল ভোট ইত্যাদি কিছুই থাকে না। রাজার দেশে প্রজারা স্বাধীন ব্যক্তি নয়। প্রজা মানেই তো অধীনস্ত [sub-ordinate] মানেই সে স্বাধীন সত্বা নয়। তাই সমাজে স্বাধীন ব্যক্তি ধারণা ও ব্যক্তি ধারণা উত্থান এর ধারণা আসা খুবই গুরুত্বপুর্ণ! একেবারে পুর্বশর্তের মত জরুরি। রাজনীতিটাই বাদ দিয়ে সামরিক ট্রেনিং মাত্র; যা মারধর, গোলাগুলি আর টর্চার কিভাবে করতে হয় এসব শিখা সর্বস্ব! অথচ ঐ ত্রিশজন ট্রেইন্ড তরুণই একাল পর্যন্ত বার্মার শাসন ক্ষমতা ও কাঠামো যা হয়েছে সবকিছুর উদগাতা, কিন্তু যারা “রাজনীতি” বলতে কি তা জানে নাই একারণেই পরবর্তিতে এটা আর্মির একটা ক্লাব ছাড়া আর কিছুতে গিয়ে পৌছাতে পারে নাই। এই ত্রিশজনই তাই হয়ে উঠেছিল বার্মার সকল ক্ষমতার উৎস এবং শাসক। এটাই ১৯৪২ সালে বৃটিশ ইন্ডিয়ার সাথে লড়াই করে শাসক বৃটিশদেরকে পরাজিত করে (তবে জাপানের কোলে বসে) নিজেরা বার্মাকে স্বাধীন করেছে বলে ক্রেডিট নিত। ১৯৪৮ সালে ভারতের মত বার্মাও বৃটিশ কলোনি-শাসকেরা ত্যাগ করে চলে যায়। আর শুরু হয় “স্বাধীন বার্মায়” ঐ ত্রিশ জনের শাসন। যারা এরপর মূল দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় কেউ সামরিক বাহিনীতে কেউ রাজনীতিতে রাজনৈতিক শাসক – এভাবে। এতে শাসন ব্যররথতার জন্য একে অপরকে দায়ী করতে থাকে। যা সমাপ্ত হয় যখন ১৯৬২ সালের শেষ নির্বাচনের পরে ঐ মিলিটারি অংশটাই জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সব ক্ষমতা দখল করে বসেছিল। এসবের উত্তরসুরি আজকের ক্ষমতাসীন সামরিক ক্লাব। তবে নে উইন সেকালে নিজেকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট ধারার কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দিতেন।
অন্যদিকে, এথনিক (ethnic)-জাত বিভক্তি বার্মাতে মারাত্মক। মূল এথনিক গোষ্টি বর্মীরা [Bamar (68%)] আর বাকিদের মধ্যে আবার তুলনায় সংখ্যায় বড় এমন আরও সাতটা [The eight ‘official’ groups are the Bamar (68%), Chin (2.5%), Kachin (1.5%), Karen (7%), Kayah (1.83%), Mon (2%), Rakhine (4%) and Shan (9%).] – এভাবে এথনিক জাত গোষ্ঠির কথা আলোচিত হয়, এরা এই সাত জনগোষ্ঠি সকলেই বর্মীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী যোদ্ধা। মনে রাখতে হবে এতসব জাত-বিভক্তি সত্বেও এর একমাত্র সমাধান হল – কেবল রাজনীতিই পারে সকল এথনিক পক্ষকেই সাথে নিয়ে একটা রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা (রিপাবলিক) কায়েম করে সকলে সমান অধিকার বসবাস করা। কিন্তু এটাই স্বাধীন বার্মার জন্মের আগে থেকেই অনুপস্থিত। শাসক বর্মী বা বামার-রা বার্মা নাম বদলে মায়ানমার রেখেছিল সাধু সাজতে; কিন্তু তা লোক দেখানি ছিল বলে অন্য এথনিক কেউ আমল করে নাই।
গত ১৯৮৯ সালে নে উইনের শাসনও ক্ষমতাচ্যুত হয়, ক্ষমতা নেয় সাত-আট বর্মী জেনারেলদের একটা গোষ্ঠি; কিন্তু জাতিসংঘের অবরোধ আরোপে সেই সরকারও দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু সীমান্ত আছে বলে একমাত্র চীনই হয়ে যায় বার্মার সাথে বাকি দুনিয়ার যোগাযোগের মাধ্যম; ইনফরমাল চোরাচালানি টাইপের ‘বাণিজ্য সম্পর্ক’ শুরু হয়েছিল সেই থেকে। পরে ২০০৭ সালে ভারতের কূটবুদ্ধি-পরামর্শে দুতয়ালিতে আমেরিকা-ইউরোপ-পশ্চিমারা চীনের পাশাপাশি তারাও বার্মার মাখন খেতে এগিয়ে আসে। যার দলিল হল ২০০৮ সালের কথিত কনষ্টিটিউশন মানে সামরিক ক্ষমতাকে স্বীকৃতি (উদ্ভট ভাবে, আর্মি প্রতিনিধিরাও সংসদে ২৫% হয়ে বসবে) দিয়ে এক কনষ্টিটিউশন। এছাড়া বাইরে দেখাবে সুচি কে যেন তিনি সিভিল-শাসন বলে তারা সাইনবোর্ড হিসাবে রাখবে। ভারতের কূটবুদ্ধি-পরামর্শ এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে জেনারেলেরা এই প্ররোচনায় ইসলামবিদ্বেষী হয়ে রোহিঙ্গাদের ২০১৭ সালে মেরেধরে দেশত্যাগ করতে, বাংলাদেশে যেতে বাধ্য করেছিল। মজার কথা হল, তখন আমেরিকা, চীন, ভারত, ইউ ইত্যাদি কেউই শাসক জেনারেলদেরকে দায়ী বা দোষারোপ করে নাই। সকলেই কথিত এক আরসা (ARSA) বাহিনীকে এদের উপর দোষ চাপিয়েছিল। কারণ, বর্মি জেনারেলেরা ওসব (আমেরিকা, চীন, ভারত, ইউ ইত্যাদি) সকল-বিদেশিকেই নানান ব্যবসা বিতরণ করে দিচ্ছিল। যেটা কেউই হারাতে চায় নাই। ফলে কোন বার্মা এক্ট বা গণতন্ত্র-মানবাধিকারের কথা কারই মনে ছিল না। কিন্তু সেটাও অচল হয়ে পড়ে ২০২০ সালের নির্বাচনের পরে, আর্মি আবার সব ভেঙ্গে দিয়ে নিজের হাতে সব ক্ষমতা নেয়।
এবার চলতি ঘটনার দিকেঃ
বার্মা নানান কারণে এক অদ্ভুত জায়গা ও পরিস্থিতি। চীন বার্মায় একই সাথে সেনা সরকার এবং বিদ্রোহী এথনিক গোষ্ঠিগুলার সাথে ‘ঘনিষ্ট’ সম্পর্ক রেখে চলতে পারে। সেনা সরকার আপত্তি করে না। এমন খুব কম দেশই পাওয়া যাবে বা নাই। মানে জেনারেলদের এতই চীনকে দরকার যে বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলার অস্ত্রের উৎসও চীন অবলীলায় হতে পারে। তবে এতদিন চীন কোনপক্ষকেই একে-অন্যের উপর চড়াও হয়ে উঠতে দেয় নাই, ভারসাম্য বজায় চলতে বাধ্য করে রাখতে পেরেছিল। এটাই চীনের বর্মীজ সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যেন একটা লাইন টেনে, বিবদমান প্রত্যেকের সীমারেখা বাতলে দিয়ে আর তাতে চীন নিজেই এক ভারসাম্য শাসক হয়ে দুপক্ষের উপর দাঁড়িয়ে থাকা শুরু হয়েছিল। তবে মোটামুটি গত (২০২৩) ডিসেম্বরকে টার্গেট করে চীন এই ভারসাম্যটা ভেঙ্গে জেনারেলকে নিচে বা কোনঠসা করে বিদ্রোহীদেরকে চড়াও হয়ে উঠতে এলাও করেছে। কিন্তু সেটা কেন?
আমেরিকার বার্মা এক্টঃ
চীনের এমন আগের ভারসাম্য কিছুটা ভেঙ্গে আবার নয়াভিত্তিতে আরেক ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে ততপর হবার পিছনের কারণ আমেরিকার কথিত বার্মা এক্ট। বাইডেনের আমেরিকার সমস্যা হল, মুরোদ থাক আর নাই থাক সবকিছু আগেই লেড়েচেড়ে আউলা করে দিতে হবে – এই নীতিরই এক ফসল হল বার্মা এক্ট। যতদুর আন্দাজ করা যায় মোটা দাগে এতে আমেরিকান পরিকল্পনাটা হল, বার্মায় দখল দেয়া মানে জেনারেলদের পতন ঘটিয়ে যেন সামরিক ক্যু হয়েছে এমনভাবে পছন্দের জেনারেল বসিয়ে তা করা। আর এর সাফাই হিসাবে বার্মায় গণতন্ত্র-ও-মানবাধিকার আনবেন বাইডেন, এর নামই বার্মা এক্ট! ব্যাপারটা সামরিক আবার আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে আমেরিকা নিজ মেরিন বার্মার মাটিতে নামাবে না, কেবল এরিয়াল (arial) কভার মানে আকাশপথে কাউকে উড়তেই দিবে না – যাতে বার্মার কোন উড়োজাহাজই মাটি ছেড়ে ডানা না মেলতে পারে। আর বাংলাদেশের পদাতিক ব্যবহার করবে আমেরিকান মেরিনের জায়গায়। আবার বাংলাদেশের পদাতিক মুভ করাতে চাইলে আগে আমাদের সরকারের উপর দখল লাগবে। তাইবাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে বিরোধিরা বিজয়ী হতে পারলে এর সুবিধার উপর ভর করে তাতে “বাইরের” সুবিধাটা (মানে যেমন বার্মা দখল) আমেরিকা পেত। কিন্তু আগেই বলেছি আমেরিকান মুরোদের খবর নাই! তাই সবকিছু লেড়েচেড়ে আউলিয়ে সবাইকে পথে নামিয়ে ভন্ডুল করে – পুরানা সব ভারসাম্য নষ্ট করে এখন বাইডেন পলাইছে শুধু না। হাসিনাকে ‘ব্যক্তিগত’ চিঠি লিখতেছে।
যদিও বিষয়গুলো এত সহজ নয়। পুরানা ভারসাম্য ভাঙ্গার একটা খেসারত তো থাকবেই। মোটামুটি গত ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা – অন্তত চীনের ক্যালকুলেশন এটাই ছিল। এভাবে মার্ক করে চীনও আমেরিকান বার্মা এক্টকে মোকাবিলার নিজ পরিকল্পনা সাজাইয়েছিল। অর্থাৎ চীনের দিক থেকেও ডিসেম্বর ছিল টার্গেট; তবে তা ঠিক বাংলাদেশ নিয়ে নয় ভিন্ন অর্থে মানে, বার্মাকে নিয়ে। এইযা ভিন্নতা!
বার্মায় কী ঘটছে এর একটা সোর্স এশিয়া টাইমসঃ
এশিয়ান টাইমস এটা হংকং থেকে প্রকাশিত একটা সমৃদ্ধ ওয়েব ম্যাগাজিন। এটাকে এটাকে সম্ভবত এশিয়ার “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল” বললে অত্যক্তু হবে না। অর্থাৎ নিউইয়র্কের আদি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল যেমন বাবা গ্লোবাল পুঁজি বাজার যদি ধরি তবে চীন -কেন্দ্রিক নয়া এশিয়ান পুঁজি বাজার তৈরি হয়েছে হংকং-সিঙ্গাপুর কেন্দ্রিক; আর এসবকে কেন্দ্র করে জর্নাল-টা হল এশিয়ান টাইমস। যার আবার ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস বলে আলাদা পত্রিকা হয়েছে, সাথে আরো একটা। প্রায় আটজনের একটা গ্রুপ যাদের ওয়াল স্ট্রিটে মিডিয়ায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তারাই মূলক এই পত্রিকাটা চালায়। এদের উপর ভর করে আবার একদল পলিটিক্যাল এনালিস্ট গড়ে উঠেছে বার্মাসহ আশিয়ান জোট এলাকার রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে কাজ করা যাদের এলাকা। এদের একজন হল ডেভিড স্কট ম্যাথুসন [DAVID SCOTT MATHIESON]; যিনি নিজের পরিচয় লেখেন – an independent analyst working on conflict, humanitarian and human rights issues – এভাবে। এসব ততপরতা গুলোকে বলা যায় গ্লোবাল নেতা আমেরিকা-পরবর্তিতে এশিয়ায় কী হতে যাচ্ছে এরই রিপোর্টার এনাস্লিস্ট হচ্ছেন এরা।
সেই ডেভিড স্কট বর্তমান বার্মার পরিস্থিতি নিয়ে নিএই দুখানা এনালাইটিক্যাল রিপোর্ট ছেপেছেন। আর একই সাথে নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হওয়া একটা রিপোর্টের রেফারেন্স দিয়েছেন যেটা আসলে আমেরিকান প্ররোচনায় বিদেশে গঠন করা জান্তাবিরোধী সু চির সরকার এর করুন হাল নিয়ে লেখা রিপোর্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে সু চুদের সরকারকে আমেরিকার নিজের মত করে সাজিয়ে নেয়া National Unity Government of Myanmar বা সংক্ষেপে NUG বলে ডাকা হয়। যাদের অবস্থা হল বাংলাদেশে এখনকার বাংলাদেশি বিরোধীদলের মত যারা হাসিনা পতন বা নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েও পুরানা গান-ই গাইছে। এই অবস্থাকে বুঝাতে ইংরাজিতে শব্দটা হল এবানডান (abandon) বা পরিত্যক্ত বলতে যা বুঝায়! তো বাইডেনের আমেরিকান পরিত্যক্ত আমাদের বিরোধীদলের মতই, সু চিদের NUG সরকারের অবস্থা। নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হওয়া সেই করুণ রিপোর্টও দেখতে পারেন এখানে। এদেরকেই বাইডেন তার বার্মা এক্টের খোরাক বা কথিত হবু সরকার বানাতে চেয়েছিল, আর তাদের অবস্থা আমাদের বিরোধীদলের মত!!!
বার্মা এক্টকে মোকাবিলার চীনা নিজ পরিকল্পনাঃ
চীনের দিক থেকে নিজ পাল্টা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আমেরিকার নিজেরটার চেয়ে তুলনামূলক অনেক সহজ ছিল। এর মূল কারণ, আগে দীর্ঘদিন থেকেই বর্মার সেনা সরকার আর বিদ্রোহী – এভাবে দুপক্ষের উপরই চীনা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাই ছিল। মানে যদি বার্মার ভিতরের তিনটা পক্ষ আছে ধরলে, এর একটা হল জেনারেলদের জান্তা সেনা সরকার; দুই হল, সাত-আটটা এথনিক-জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্টি যারা আবার এখন চীনের প্ররোচনায় ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একত্রিত হয়েছে। নয়া পরিস্থিতিতেও জেনারেলেরা আর ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স দুইটাই এখনো চীনের নিয়ন্ত্রণে। আর তৃতীয় পক্ষটা হচ্ছে কেবল আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের সু চিদের NUG। যেটারই এখন পরিত্যক্ত অবস্থা!
আর এবারের চীনা পরিকল্পনা ছিল জেনারেলদের হাতটা ধরেই রাখা কিন্তু এবার একটু ঢিলা করে ধরা যাতে বিদ্রোহীরা একটু আপার হ্যান্ড পায়। এতে যদিও আগের ভারসাম্য মানে জেনারেল আর বিদ্রোহীরা আগে প্রত্যেকে যে সীমারেখার মেনে চলার মধ্যে দিয়ে ভারসাম্য তৈরি করে বসবাস করছিল – সেটাই এখন চীন ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে। আর তা দিলে চীনের স্বার্থের এতে কোন ক্ষতি হবে না কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজব। মানে জেনারেলেরা এতে বিগড়ে গিয়ে চীনবিরোধী হয়ে যায় যদি? চাইকি আমেরিকার হাত ধরে ফেলে যদি?
জবাব হল, চীন জানতে এমন দুটাই অসম্ভব। কারণ জেনারেলদের চীনবিরোধী হওয়া মানে কি ভারত? নাকি রাশিয়া বা খোদ আমেরিকার হাতধরা? না, এমন প্রত্যেকটাই বাস্তবে অসম্ভব। চীনবিরোধী হয়ে রাশিয়া একচুলও অন্যদিকে যাবে না। আর আমেরিকা? আগেই বলেছি বাইডেনের যতই “বার্মা এক্ট” থাকুক বা সু চিদের NUG থাকুক এই আমেরিকা তো এখন বাংলাদেশ ছেড়েই ভেগে গেছে কাজেই – মানে বাংলাদেশ থেকে সামরিক সহায়তা পাবার বাস্তবতাই আউলায়ে গেছে – আর এতে আমেরিকা তার বার্মা এক্টও এখন কিছু ছেড়া কাগজ মাত্র- মুরোদহীন। আর এতদিন আমেরিকা তো এই জেনারেলদের বিরুদ্ধেই হম্বিতম্বি করে গেছিল। ফলে সেই জেনারেলেরা এখন চীনের উপর ক্ষেপে গিয়ে বাইডেনের হাত ধরার কোন বাস্তবতাই নাই। আবার আমেরিকা বার্মার ঠিক কার হাত ধরার কথা ভেবেছিল জেনারেলেরা নাকি সু চিদের NUG দের??? অবশ্যই সেটা সু চিদের NUG। মানে জেনারেলদের ভাগ্যে আমেরিকান দীয়া-আশীর্বাদের কোন সুযোগই ছিল নাই, ছিলই না। আর এখন তো বাইডেন নিজেই পরিত্যক্ত। আর ওদিকে ভারতও এসবের ভিতর উল্লেখ-অযোগ্য। কারণ এর না আছে অর্থনৈতিক বা সামরিক সক্ষমতা। পারে কেবল কূটকাচালি বা প্যাচ-লাগানি। যেটাও এখানে সম্ভব না; যদিও ভারতের হম্বিতম্বি আছে সেকথায় শেষে যাবো! তবে সেটাও কারও ঘাড়ে চড়ে করতে চাইবে ভারত আর এটাই সম্হভবত হাসিনা সরকার!! আর মনে রাখতে হবে আমেরিকান বার্মা এক্ট পরিকল্পনা তো ভারতেরও স্বার্থবিরোধী করে সাজানো ছিল।
কাজেই চীনের দিক থেকে জেনারেলদের হাত হাল্কা করে ধরার এটাই ছিল পারফেক্ট টাইম। কারণ তারা তবু চীনকে ছেড়ে কোথাও যাবার জায়গা নাই। সেজন্যই শুরুতেই যেটা বলেছি, বার্মীজ সেনা সরকারের উপর বিদ্রোহীদের চড়াও হতে দেওয়াটা আসলে চীনা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। যার দুচারটা গোলা বাংলাদেশে এসে পড়ছে। চীনা পরিকল্পনায় বাংলাদেশে সম্ভাব্য সরকার বদলের সময়কাল ছিল ডিসেম্বর-কেন্দ্রিক। তাই জেনারেলদের উপর বিদ্রোহীদের সওয়ার হওয়ার টাইমিং-টা ছিল সে-মোতাবেক !
তাই বার্মা এক্ট সফল করতে হাসিনাকে সরাতে আমেরিকার এগিয়ে আসার আগেই সেক্ষেত্রে বাইডেন দেখত বার্মা বিদ্রোহীদের ক্ষমতায় কিন্তু জেনারেলরাই নাই, উধাও! কিন্তু এখন বাইডেনের পলায়ন ঘটে যাওয়াতে এতে নিট কিছু লাভ হতে পারে জেনারেলদের। তারা আয়ু পাবে। কিন্তু আরও অনেক পরে।
এবার আবার ডেভিড স্কটের রিপোর্ট থেকে এনিয়ে তার বক্তব্য তুলে আনব।
তিনি বলছেন, একটা ভুল আশা ছড়িয়ে পড়েছিল যে থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনের মতো মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র। পুরা বক্তব্যটাই নিচে কোট করে দিয়েছে। ডেভিড স্কটের রিপোর্ট এর মূল লেখাটার শিরোনাম হল, China success, Western failure in revolutionary Myanmar এখানে। যার বাংলা অনুবাদ ছেপেছিল প্রথম আলো। আমি সেই অনুবাদের লিঙ্ক হল এখানে।
মিয়ানমারের ক্ষেত্রে চীন আন্তর্জাতিক পরিসরের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাবকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা
যায়। তিন বছর ধরে একটি চিৎকারই প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে যে মিয়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলনে বাইরে থেকে অস্ত্র দরকার। একটা ভুল আশা ছড়িয়ে
পড়েছিল যে থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনের মতো মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের প্রতিরোধযোদ্ধাদের
নীরবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে চীন। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের ওপর চীনের কৌশলগত সমর্থন না থাকলে অপারেশন ১০২৭ সম্ভবপর হতো না।
আর ডেভিড স্কটের শিরোনামেই প্রায় সবকথা বলা আছে। লিখছেন চায়না সাকসেস আর ওয়েস্টার্ণ ফেইলিওর। মনে রাখতে হবে ডেভিডেরা সুইডেন, সুইজারল্যান্ড বা নরওয়ের শান্তি নিয়ে কাজ করা গ্রুপের সাথে সম্পর্কিত। তবে ডেভিডের সবচেয়ে মারাত্মক কথা যে – “একটা ভুল আশা ছড়িয়ে পড়েছিল যে থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনের মতো মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র”। আর এটাই বাংলাদেশের এখনকার বিরোধী দলেরও সেই একই অবস্থা! ডেভিড আরো লিখছেন, “কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের প্রতিরোধযোদ্ধাদের নীরবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে চীন। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের ওপর চীনের কৌশলগত সমর্থন না থাকলে অপারেশন ১০২৭ সম্ভবপর হতো না”।
এই হচ্ছে ডেভিট স্কটের তথ্য ও ব্যাখ্যা। আর ঐ অপারেশন ১০২৭ হচ্ছে সেনা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সম্মিলিত অপারেশনের কোন নাম – যেটা চীন সমর্থিত।
আমেরিকার বোকা পরিকল্পনায় এখন উলটা, সব নিয়ন্ত্রণ এখন একা চীনের হাতেঃ
কথা ঠিক, পরিশেষে পুরা পরিস্থিতির সবটাই চীনা নিয়ন্ত্রণে। বার্মার তিনপক্ষের সু চিরা বাইডেন হাতছেড়ে দেওয়ায় পত্রিত্যক্ত! আর বাকি দুপক্ষ মানে জেনারেলেরা আর বিদ্রোহিদের মধ্যে থে বর্তমানে চীন বিদ্রোহীদেরকে আপার হ্যান্ডে বসিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমি মনে করি না চীন বার্মা বিদ্রোহীদেরকে জেনারেলদের উপরে বসায় দিবে – জিতিয়ে বা জিততে দিবে। এর চেয়ে চীন বরং আবার জেনারেল আর বিদ্রোহীদের মধ্যে মানে উভয়ের ক্ষমতা ও এক্তিয়ার প্রসঙ্গে আবার নয়া এক ভারসাম্য ব্যবস্থা তৈরি করে দিবে। চীন যদি বুদ্ধিমান হয় তো এটাই করবে। তবে এটা অবশ্যই নয়া আরেক ভারসাম্যে – মানে পুরান হিসাবে নয়। এতে অনেক কিছুতেই বিদ্রোহিরা এবার আপার হ্যান্ড পাবে। আর এসবের মূল নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে আরও সবল হবে। রোহিঙ্গারা ফিরবে কিনা সে ইস্যুতে চীন এখন এককভাবে নির্ধারক হবে। অর্থাৎ মুল কথা – বার্মার যে এথনিক জাতিহগত সংঘাত এটা মিটানোর মত রাজনীতির হদিস বা রাজনৈতিক জ্ঞান বা বুঝাবুঝি এখনও বার্মার কোন কোণাতেই নাই। চীনেরও জানা নাই। কারণ সমাধানটা হল ফেডারেলিজম (Federalism)। অনেকে আমেরিকান ফেডারেলিজম বললে বুঝে। আর এটা আমেরিকার বাইরে – মানে ইউরোপেরই কোথাও নাই। আর সবচেয়ে বড় কথা এটা হল – জাতিবাদ বা কমিউনিস্টদের জাতীয়তাবাদের বিপরীত ধারণা। অর্থাৎ জাতিবাদি লড়াই (এথনিক বিবাদ) অনেক দেশের মত বার্মারও এখন প্রধান শত্রু!
আর সব হারানি ভারত এসবের ফয়দা খেতে এখন হাসিনার মাধ্যমে – অন্তত বর্মা ইস্যুতে তাকে চীনবিরোধী অবস্থানে জায়গা করতেই হবে মনে করছে। এককথায়, বর্মা সীমান্তে বিশৃঙ্খলা সাময়িক হলেও ভারতেরও স্বপ্নে পোলাও খাবার মত এক আশা তৈরি হয়েছে যে, হাসিনা সরকারের কাঁধে চড়ে ভারতের বার্মা দখলের মুরোদ না থাকলেও একটা শেয়ার নিতে চায়। ভারত আবার প্রবল একটা আশাও খাড়া করেছে যে একাজে আমেরিকার তাদের পিছনে দাঁড়াবে। ভারতের এই অবাস্তব আশা – উচ্চাশা এটাই এখন হাসিনা সরকারকে বেচাইন করে তুলছে! এসবের কারণে, সরকার এতে ততটাই চীন থেকে দূরে না চাইলেও হয়ে পড়ছে। সরকার সতর্ক না হলে ভুল পদক্ষেপ দিয়ে ফেললে তাতে শুধু সরকার না পুরা বাংলাদেশই – সরকারের ভারতপ্রীতিতে বা চাপে পড়ে – বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে! যদিও সবকিছুই এখনও – প্রাইমারি অভিমুখ কোনটা নিবে – সেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে – কিন্তু লক্ষণগুলো খুবই খারাপ ঝোঁকের! এক ব্যাপক দেশি-বিদেশি নয়া পোলারাইজেশনও ঘটাবার চেষ্টা শুরু হয়েছে। তা কতদুত সফল হবে এখনই জানি না। যদিও একারণে, ব্যাপক উঁকিঝুঁকি মারা শুরু হয়েছে!
সর্বশেষ আপডেটঃ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ভোর চারটা দশ মিনিট
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

