অকেজো না, চীন-ভীতিতে ভারত এখন সার্ক বিলুপ্তি চায়


 অকেজো না, চীন-ভীতিতে ভারত এখন সার্ক বিলুপ্তি চায়

গৌতম দাস

০৭ অক্টোবর ২০২১, ০৭:৫৬ পিএম

https://wp.me/p1sCvy-3KC

 

 

গত পনেরো আগস্ট ছিল এক আজব ঘটনার দিন। বিগত ২০ বছর ধরে  (তখন থেকে) এক মেরুর দুনিয়ায় মহাপরাক্রমশালী আমেরিকা, আফগানিস্তানে এক পুতুল সরকার গঠন করে শাসন করে আসছিল। প্রথমে কারজাই পরে গণি সরকার এভাবে। কিন্তু এবছর, যার প্রটেকশনে সেই পুতুল সরকার  ক্ষমতায় ছিল সেই আমেরিকা নিজেকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর তাতে, ‘”তালেবানেরা কাবুল দখলে আসছে’ এই আওয়াজ শুনেই গনি সরকার শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর সত্যিই তালেবান যোদ্ধারা শহর দখল করে এবং ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিল ঐ ১৫ আগস্ট ২০২১।

আসলে কোন সরকার যখন তাকে উৎখাত করতে কেউ এগিয়ে আসছে শুনে নিজ রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং তার সেনাবাহিনীও কোনও প্রতিরোধে এগিয়ে আসে না, এটাই আসলে মুরোদহীন সরকারের উদাহরণ। কারণ, যার নিজেকে রক্ষার মুরোদ নাই সেটা তো কোন সরকারই নয়!

সরকারের বৈধতার প্রথম ধাপ হল মুরোদ, যে মুরোদের খাঁড়া অর্থ গায়ের জোর, নিজেকে রক্ষার সক্ষমতা। এরপরের ধাপ হল, জনসমর্থনে ঐ সরকারের পক্ষে জন-অনুমোদন নেয়া। তবেই সেটা পুরাপুরি এক বৈধ সরকার হয়। যদিও এরপরেও আরেকটা ধাপ থেকে যায় যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি বা জাতিসংঘের স্বীকৃতি। তবে সে পর্যায়ে যাবার আগেই, আশরাফ গনি সরকারের নিজেকে রক্ষার মুরোদ ছিল না, এই হলো গোড়ার সমস্যা।

ট্রাম্পের আমলে এসে আমেরিকা আফগানিস্তান ‘ফেলে’ পালাতে চাচ্ছিল। তাই আফগানিস্তান থেকে পালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই (আপন ঘোষিত শত্রু) তালেবান গোষ্ঠির সাথেই এক আপোষনামা রচনার চেষ্টা করেছিল। আর তাতে সফল হলে এক চুক্তি সই করেছিলেন গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০। কিন্তু ট্রাম্প এই চুক্তি করেছিলেন গনি সরকারকে উপেক্ষা করে, তাকে এই চুক্তির কোনও পক্ষই না করেই। কারণ  আফগান পুতুল সরকারকে এর মধ্যে আনা যাবে – এটাই ছিল তালেবানের ট্রাম্পকে দেয়া পুর্বশর্ত। আর অসহায় ট্রাম্প নিরুপায় হলে এই শর্ত মেনেই চুক্তিটা করেছিল।

এই যে গনি সরকারকে উপেক্ষা করে তালেবানের সাথে চুক্তি সই করা – আসলে সেদিন থেকে এর সোজা মানে হয়ে গিয়েছিল; আমেরিকান প্রটেকশনে তারা আর পুতুল সরকারও থাকে না। সরাসরি বললে, বাস্তবত ওইদিন থেকে গনি সরকারকে আমেরিকাও আর কোন সরকার মানতে অস্বীকার ঘোষণা করে দিয়েছিল। যদিও এরপর থেকে কেউ গনি সরকারকে ঠেলে ফেলে দেয়া বা চ্যালেঞ্জ দেয়নি বলে বাইরে থেকে দেখে এটাকে আগের মতনই  এক সরকার মনে করেছিল। আর নিজস্বার্থ এই মোহে ছিল ভারত সরকারও।

যদিও বাস্তবতা ছিল ট্রাম্প গনি সরকারকে এতিম করে ছেড়ে দিয়েছিল, কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়েছিল। গনি সরকারকে সাথে না রেখে কেবল তালেবানের সাথে চুক্তি করার মানেই তো হল ট্রাম্প স্বীকার করে নিয়েছিলেন গনি সরকার বলে কেউ নাই, তালেবান যোদ্ধারাই আফগান ক্ষমতার একমাত্র হকদার। অথচ ১৫ আগস্ট কাবুলে তালেবান যোদ্ধাদের প্রবেশের পরে  সবাই এমন ভান করতে থাকল যেন ঐদিনই বোধহয় প্রথম গনি সরকার ক্ষমতাচ্যুত হল আর তালেবান ক্ষমতা পেল। এজন্য বলছি ১৫ আগস্ট হল এক আজব দিন! ভান আর ভনিতার দিন!

এখন ভান করাদের মধ্যে ভারত সরকারকে আমরা শীর্ষে রাখতে পারি। কেন? কারণ তারাও আমেরিকান ক্ষমতার দিকে চেয়ে থাকা বা আমেরিকার আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখা পার্টি। অথচ এখন তারাও নিরুপায়। অতএব তারা ভান করছে বা মনে করছে যে গনি সরকারই “বৈধ সরকার”। তবে আমেরিকান ক্ষমতার আড়ালে বসে আফগানিস্তান থেকে যারা ব্যবসা আর প্রজেক্ট লুটছিল ভারত সরকার তাদের অন্যতম বলেই এই মিথ্যাকথার আড়ালে মুখ লুকানো ছাড়া এখন আর উপায় কী?

কিন্তু আবার সাবধান! এখন সব অর্থেই কার্যত ‘গনি সরকার’ বলে আর কেউ নাই। কিন্তু এর মানে কি তাহলে আপনাতেই তালেবান বৈধ সরকার? অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের বা জাতিসংঘের মেনে নেয়া অর্থে? অবশ্যই না। যদিও কার্যত তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায়।

আর নিজেদেরকে বৈধ সরকার বলে খুঁটি গাড়তে বা অনুমোদন যোগাড় করতে যেসব বাধা তালেবানের সামনে এর তালিকাটাও ছোট না। যেমন-

একঃ তালেবানেরা এখনও নিজেরাই ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক শপথ নিতে পারে নাই; শপথের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দেখাতে পারে নাই।

দুইঃ সেই আনুষ্ঠানিকতায় আবার কাদের দাওয়াত দিবে, এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হল – দাওয়াত দিলেই সে দাওয়াতি আসবে এর নিশ্চয়তা এখনো নাই বলেই মনে হচ্ছে।

তিনঃ দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় তাদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ আছে এমন সত্য-মিথ্য অনুমান ছড়িয়েছে যেটা তাদের পক্ষে যাচ্ছে না। আর, ওদিকে শপথ অনুষ্ঠানও হতে দেখাতে পারছেনা বলে সেই অভ্যন্তরীণ আন্তঃ বিভেদের অনুমানই আরও পোক্ত হয়ে চলছে।

চারঃ সর্বশেষ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো বা না-ভেটোসদস্য সবাই মিলে মোট ১৫ সদস্যের সমর্থনে জাতিসংঘের পাশ হওয়া এক প্রস্তাব যা আহবান রেখেছে,  আফগানিস্তানের সব পক্ষকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ[inclusive] ও মানবাধিকার রক্ষার পক্ষের এক সরকার গড়তে। এনিয়ে বিস্তারে আমার আগের লেখা এখানে

পাঁচঃ  অর্থাৎ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বৃটেন ও ফ্রান্স – এই পাঁচ পরস্পরের স্বার্থবিরোধী ভেটোসদস্য একসাথে এই প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, যা খুব কম ঘটে থাকে, রেয়ার। আর বলা বাহুল্য এটা তাই তালেবানের  উপর খুবই শক্ত চাপ।

ছয়ঃ আমাদের অনেকের ধারণা, কোন দেশে আমরা মুরোদে কুলালে যেমন ইচ্ছা তেমন কোনও সরকার গঠন করে বসতেই পারি, আর যেন যেমন ইচ্ছা তা চলতে চালাতেও পারি, আমারটাই ভাল, আমার ধর্মটাই বা শ্রেষ্ঠ মনে ঠাউরে সেই যুক্তিতে। কিন্তু এই অনুমান ভুল ও ভিত্তিহীন। একটা সমাজেও আমরা এভাবে টিকতে বা থাকতে পারব না। এছাড়া এটা উল্টা আমাদেরকেই একঘরে করে ফেলতে পারে। ফলে এমন চিন্তার কারণেও এনিয়ে একটা স্থবিরতা চলছে।

সাত) মূল সমস্যা, তালেবান এক আমিরাত (আমীরের) সরকার-  অর্থাৎ আমিরাতে আফগান সরকার চাইছে। যদিও তারা জনপ্রতিনিধির সরকার না রাজা হবেন তা স্পষ্ট করতে পারছেন না। যদিও ঝোঁক রাজা বা আমীর হবার। [যদিও আমীর হলে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেবে না।]
এই প্রসঙ্গ শেষ করার আগে  উপরের ছয় নম্বর পয়েন্টে যেটা ভুল অনুমান বলেছি সেটা কেন তা এখন নিচে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নিব।

ঐ অনুমিত যুক্তি ভুল কেন?
সমাজ মানেই আসলে পণ্য বিনিময়ের সমাজ। এই বিনিময় মানে আপনি যা উতপাদন করেছেন তা অন্য উতপাদকে দেওয়ার বিনিময়ে সেই উতপাদকের পণ্য পাওয়া-নেয়া ও ভোগ করা। এভাবে পরস্পর সকলে মিলেই এক পণ্য-বিনিময় সম্পর্কে জড়ানো এটাই সমাজ। তাহলে সমাজ মানেই সেখানে পণ্য-বিনিময় আছে। আর এই পণ্য-বিনিময়ের ভিত্তিতে আমরা সমাজ হয়ে থাকি।
এখন একটা নতুন কথা বলি।  এই যে আমরা পরস্পরের সাথে পণ্য বিনিময় করতে রাজি হই বা জড়াই – এই বিশেষ কাজেরই আরেক অর্থ-তাতপর্য আছে।  যেমন মাইগ্রেশন [migration] মানে গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে কাছাকাছি শহর বা রাজধানীর দিকে বসবাসের জন্য রওনা দেয়া, এটাই মাইগ্রেশন।   এখন গরীব বা নদীভাঙনে পড়া লোক যখন কাছের কোন সমৃদ্ধ শহর বা রাজধানিতে প্রবেশ করে  তখন ঐ সমাজে সে বাইরের আর নতুন লোক। এমনকি হতে পারে সে হাতে কোন অর্থও নাই। তাহলে বিনিময় করবে কী করে?  আর বিনিময় না হওয়া মানে কিন্তু নতুন বা মাইগ্রেটেড হয়ে আসা লোকটা যে ঐ নতুন শহরে আছে এর অস্তিত্ব স্বীকৃত না হওয়া।  তাহলে কী হয় তখন?  কান খাড়া করে শুনেন তা হল, আমাদের সমাজে সাধারণত যা ঘটে,  কেউ নতুন আগত লোকটার কাহিনী শুনে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।  এভাবে এখন সম্পর্ক শুরু হবে। একজন সাহায্য করবে বা দিবে (ঠিক কোন সচেতন বিনিময়ে না হলেও) স্বেচ্ছায় আর গ্রহিতা লোকটাও স্বেচ্ছায় সবার জন্য দোয়া করবে। আর সারকথায় এভাবে পরস্পরকে সমাজে স্বীকার করে নিবে। এভাবেই আমাদের অলক্ষ্যে আমরা সমাজে পরস্পরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেই। তাহলে সমাজ মানে পণ্য বিনিময় সম্পর্ক। আর এমন বিনিময়ের ভিতর দিয়ে পরস্পরকে স্বীকার করে নেয়া। এ যেন স্বীকার করে নেয়া যে, হ্যা, তুমিও কিছু উতপাদন বা তৈরি করেছো মেনে নিলাম। এমনকি সময়ে বিনা বস্তুগত বিনিময়, সামাজিক দায় মিটাতে অন্যকে সাহায্য করা আর সর্বপরি সবার জন্য নিঃস্বার্থ দোয়া করা। এভাবেই সম্পর্ক তৈরি করা জড়ানো আর এর ভিতরেই মানুষের বসবাস। আর ঠিক এর উল্টাটাই হল কাউকে একঘরে করে।
তাই কোন জনগোষ্ঠি নতুন করে রাষ্ট্র-সরকার মানে নতুন করে পারস্পরিক স্বীকৃতির আসর বসানো। আর এটারই সবচেয়ে বড় রূপ হল বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিময় সম্পর্কে জড়ানো। আর এর ট্রেন্ডটা হল, যতই দিন যাচ্ছে আমরা ততই আমরা চিনা-জানা তেমন নাই এমন দেশ-ভুমির মানুষের সাথে গভীর বিনিময় সম্পর্কে আমরা জড়িয়ে যাচ্ছি, নিজের স্বার্থেই।  তাই শুরু থেকেই যেমন ইচ্ছা তেমন করে চলতে চালাতেও পারি অবশ্যই তবে এটা আইডিয়েল [ideal]। মানে হল এটা  যতটা কল্পনার ততটাই তা বাস্তবে সুবিধার না, আর তা বাস্তবায়ন অযোগ্য এমন কল্পনা।
সবশেষে, সার্ক নিয়ে কিছু কথা বলে শেষ করব।

সার্ক [SAARC]:
 এতদিন ভারত পাকিস্তানের ভয়ে সার্ককে অকেজো করে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তার ভয় এই অবস্থায় যদি ভারতকেই বাদ দিয়ে চীন সার্কে ঢুকে যায় আর সার্ককেই কার্যকর করে ফেলে! তাই ভারত এখন সার্ককেই বিলুপ্ত করে দিতে চায়। তাই এখন প্রকৃত বাস্তবতাটা হল সার্ক নিয়ে ভারত যেদিকেই যাক, চীনেরই লাভ আর ভারতের ক্ষতিই হবে। মূল কারণ, ভারত চীনের সাথে তুলনাযোগ্যই নয়, কমপেটিবল নয়।
সার্ক এই জোট নিয়ে কথা-আলোচনা যত দিন যাচ্ছে ততই কমে নাই হয়ে যাচ্ছে। অল্পকথায় একেবারেই এর মূল কারণ, ২০০১ সাল থেকে দুনিয়া নতুন অভিমুখ বা ঝোঁকে বইতে শুরু করানো হয়েছিল তাই।  ভারত বা আমেরিকার মত দেশের ভাষায় বললে এটাকে তারা শব্দে আকারে বলবে  “সন্ত্রাসবাদ” বা “ওয়ার অন টেরর”।  আসলে এসব দেশগুলো ভেবেছিল, “ওয়ার অন টেরর” এর নামে  “ইসলাম কোপানো” শুরু করলে তারা নিজেদের অপরাধ আড়ালে ফেলে দুনিয়াটাকে নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আজ ২০ বছর পরের অভিজ্ঞতা বলছে সেটা ঘটেই নাই। উলটা সময়টা এখন ভারত ও আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমের এখন কাফফারা দিবার সময়। কারণ তারা সমুলে হেরে  গেছে। আর আফগানিস্তান থেকে সেনা গুটিয়ে চলে আসা এর জলজ্যান্ত নমুনা।  এছাড়া  নতুন নতুন ক্ষত ও বিরোধ তৈরি করেছে তারা, সেসবের জন্য নতুন কাফফারা দিতে হবে। আর সবার উপরে এদের সবার সব ধরণের সক্ষমতাই এই প্রশ্নের সম্মুখীন ও পড়তির দিকে। তাই বুদ্ধিমানেরা কেউ কেউ আগেই পুণঃমুল্যায়নে বসে গেছে। কিন্তু না চাইতে যেসব নতুন ক্ষত তৈরি করেছে তার কী হবে?
কথাটা বোধহয় এভাবে বলা যায়।  আগেই বলেছি এখানে “ইসলাম কোপানো” আর এর সুযোগ নেয়াটা দিয়ে শুরু হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল ইসলামি সমাজগুলোকে অস্বীকৃত আর চাপে মার্জিনালাইজ করে রাখলেই তারা জিতে যেতে পারবে। কিন্তু ২০ বছর পর দেখা যাচ্ছে ফল হয়েছে উলটা। আর তাতে দুটা ধারা তৈরি হয়েছে। একটা হল, গোণায় ধরা আর আপন করে নেয়া। পুর্ণ মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে সসম্মানে পাশে রাখা, পারস্পরিক সম-মর্যাদার গ্লোবাল সমাজ গড়ার পথে রওনা দেয়া। আর এর বিপরীতে আরেক ধারা হল, আমরা শ্রেষ্ঠ, এককালে সব আমাদেরই ছিল। তাই, ইসলামের নেতৃত্বে আগে আমাদের নয়া কিছু রাষ্ট্র গড়ে তোলা এরপর এর অধীনে দুনিয়াকে ঢেলে সাজানো।
তবে ২০০১ সালের মূল পরিবর্তনের কৌশলগত কারণে আমেরিকা ভারতকে তোয়াজ করে একে চীনের বিরুদ্ধে খারা করেছে শুধু তাই না। পালটা পাকিস্তানকেই আমেরিকা নিজ সন্ত্রাসী হামলার লঞ্চিং প্যাড হিসাবে ব্যবহার করেছে আবার পাকিস্তানকেই সন্ত্রাসবাদী বলে দোষী দাবি করেছে। এই সুযোগে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ক্ষমতায় উপরে এক সাধু রাষ্ট্রের ইমেজে বসার চেষ্টা করেছে। ফলে সেই থেকে এর প্রভাবে সার্কের ভিতরে ভারত আর পাকিস্তানকে নিজের সমান গণ্য করতে চায় নাই।  এটাই সার্কের অকার্যকর হয়ে পড়ার মূল কারণ।  সারকথায় সার্ক অকার্যকর হবার মুল কারণ  আমেরিকার নীতি। পাকিস্তানকে কোপের মধ্যে রাখা আর বিপরীতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ভারতের তোয়াজে রাখা।
এতে ভারত চেয়েছে সার্ক থেকে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাকিদেরকে নিয়ে নতুন জোট করা। সাথে অন্য নতুন কাউকে ঢুকানো। এতে ১৯৯৭ সালে গড়া সেটার নাম বিমসটেক [BIMSTEC] বা বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ, একেই ভারত সার্কের বিকল্প হিসাবে পুশ করতে শুরু করেছে। আসলে ২০০১ সাল থেকে “সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতার” আড়ালে, মার্কিন সমর্থনে ভারতের মুসলমান ও পাকিস্তানবিদ্বেষ চরমে উঠাতে ভারত আর সার্ক টিকাতেই চায় নাই। এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ, নয়াদিল্লিতে সরকারি আমন্ত্রণে ২০১৬ সালে ভারত সফররত একদল বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় সাবেক রাষ্ট্রদুত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী [বর্তমানে ঠিঙ্কট্যাঙ্ক ORF ফেলো] খোলাখুলি বলেই ফেলেছিলেন, [দেখুন সার্ক ভুলে যেতে বললেন পিনাক রঞ্জন;] আর ‘বিমসটেক জোটের’ ওপর বাংলাদেশ জোর দিক।
কিন্তু ২০২১ সালে এসে আবার ভারত পল্টি দিচ্ছে।  এবার বলছে সার্ক আর অকেজো করে রাখা না, সার্কের বিলুপ্তি দরকার। কেন? ভারতের ভয় সার্ক অকেজো করে ফেলে রাখলে সার্কে ঢুকে চীন না সার্ক নিয়ে চলে যায়!  কিন্তু কাজটা সে করতে গেছে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে নিউইয়র্কে সার্কের এক সভাকে কেন্দ্র করে।

আফগানিস্তানকে নিয়ে সার্ক বৈঠকে হতে গিয়েঃ
গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের বার্ষিক  সাধারণ পরিষদ বৈঠকের সাইড লাইনে। আফগানিস্তানকে সার্কে সর্বশেষ যুক্ত সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে নেয়া হয়েছিল আগেই। সংশ্লিষ্ট নেতারা সার্কের একটি বৈঠক করতে চেয়েছিলেন ঐ সাইড লাইনে। কিন্তু তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি মূলত আফগানিস্তানকে সেখানে ডাকা হবে কি না বা হলে কীভাবে এনিয়ে অমীমাংসিত বিতর্কের কারণে।

এমনিতেই গত ১৫ আগস্টের পরে ভারত আফগানিস্তান ইস্যুতে একা হয়ে এক আজিব অবস্থান নিয়েছে। তা হল অনেকটা যেন “আমাকে আগের গনি সরকার ফিরে এনে দাও। আমি এর অন্য কমকিছু হলে মানব না’- টাইপের।  সম্ভবত এর মূল কারণ এতদিন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার আড়ালে থেকে আফগান ইস্যুতে অবাধ বিচরণ ও সুবিধা খেয়েছে। আর এখন ঠিক উল্টা যুক্তরাষ্ট্রও কারও দিকে না কেবল নিজের একক  স্বার্থের দিক চেয়ে চলার কারণে ভারত একা বোধকরা এক এতিম যেন! তাই সার্কের ঐ হবু মিটিংয়ে ভারতের অবস্থান ছিল, আগের নাই হয়ে যাওয়া গনি সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব আনতে হবে। তবে, ভারতের ব্যাখ্যা পাকিস্তান বরং তালেবানদেরকে ঐ আফগান প্রতিনিধিত্বের আসনে বসাতে চেয়েছে, তাই সব ভন্ডুল হয়ে গেছে। সারকথায় ওই বিতর্কে পড়ে, সার্কের সভা বসতেই পারেনি; বাতিল হয়ে গেছে।

কিন্তু ভারতের মিডিয়া এ নিয়ে অস্থির অধৈর্য হয়ে উঠেছে। যেমন দ্যা প্রিন্ট পত্রিকায় জ্যোতি মালহোত্রার এক লেখা। [অনুমান করা হয় এটা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লেখানো।] তারা নিজেরাই এর সারাংশ সেখানে করেছে এভাবে: “চীন আর সার্ক রুমের মধ্যে ঢুকে পড়া হাতি নয়। বরং সে ওর পুরা ঘরবাড়িই দখল নিয়ে বসেছে। ভারতের বরং উচিত হবে তার পড়শিদের ছেড়েছুড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইউকে, রাশিয়া প্রভৃতি অগ্রসর দেশ ও কোয়াডের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া” ।

China is no longer the elephant in the SAARC room, it occupies the entire zoo. India would rather jump over its neighbourhood and build ties with US, France, UK, Russia, and the Quad.

এসব কিছু আসলে ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের এলায়েন্স গড়ে তোলা, যার ভিত্তি হল কথিত ‘সন্ত্রাসবাদ’ ইস্যু। আর এতে এর নামে ভারতের অদ্ভুত এক মুসলমানবিদ্বেষী মন আর সেই মনের তৈরি করা ঘৃণা হাজির হয়েছে! যুক্তরাষ্ট্রও প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ভারতের এই আচরণ সমর্থন করে গেছে আর আজ এরই পরিণতি দেখছে সবাই।
আসলে একালের আফগান থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের পরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে তার গত ২০ বছরের সম্পর্ককে পুনঃমুল্যায়নে ঢেলে সাজিয়ে নেয়া শুরু করাতে ভারতের এই দিশাহীন প্রতিক্রিয়া।
বাংলাদেশেরও কিছু মিডিয়ার এখন লক্ষ্য ভারতের এই দিশাহীন প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে লেখা ছেপে নিজের ভাগ্য গুছানো। যেমন মানবজমিনের এক লেখার শিরোনাম “আফগান সংকট খাদের কিনারায় সার্ক”।

এটা প্রমাণ করে ভারতের বিদ্বেষী আচরণ কোন মাত্রা ছুঁয়েছে। একালে এর উপর যুক্ত হয়েছে আমেরিকা আর আগের মতো ভারতকে সমর্থন করতে পারছে না, সম্পর্ক আর আগের মতো নাই। আমেরিকা নিজের স্বার্থ নিয়েই ডুবে আছে। আর সে ভিত্তিতেই ভারত-আমেরিকান সম্পর্ক ঢেলে সাজাতে চাইছে। আর এতেই ভারতের প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত ও ভয়াবহ!

চীন থাকলে ভারত-পাকিস্তান কোনই সমস্যা নাই, কেন এমন??
কথাটা আসলেই সত্য, অকাট্যভাবে প্রমাণিত। আমেরিকাই ভারতকে তোয়াজ করে গাছে তুলে তার পাকিস্তান-চুলকানি বা সময়ে চীন চুলকানি তৈরি করেছে। সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানেইজেশন [SCO] মূলত চীনের নেতৃত্বে এক জোট। এর উপর সাথে আছে পুতিনের রাশিয়া। এবং সেন্ট্রাল এশিয়ার কিছু দেশ।  সম্প্রতি এই জোটে  ভারত ও পাকিস্তান দুদেশকেই অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, আফগান বা তালেবান নিয়ে অস্থিরতা এই সময়ে  SCO তে ভারত ও পাকিস্তান একসাথে সুন্দ্রভাবে মিটিংয়েও বসেছিল। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হল?  এখানেই শেষ না।  পাকিস্তানে যাচ্ছে ভারত! কেন? এই SCO এর পক্ষ থেকে এক সন্ত্রাসবিরোধী ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে। না আপনারা ভুল শুনেন নাই। আচ্ছা, ভারতের বিশ্বস্ত মিডিয়া ভোরের কাগজের রিপোর্টের লিঙ্কটা দিচ্ছি দেখেন যার শিরোনামঃ পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী মহড়ায় যাচ্ছে ভারত।  অথবা ভারতের জি-নিউজের খবর শিরোনাম “পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ভারতীয় সেনা, এবার সঙ্গী চিনও”। এর অর্থ কী ?
অর্থ একটাই। আমেরিকাই ভারতকে বিগড়েছে, উস্কানি দিয়ে গেছে। যে কারণে চীনের নেতৃত্বে থাকলে ভারত ঠিক থাকে এবং ভারত-পাকিস্তান একসাথে কাজ করতে পারে, অবলীলায়।
ঠিক একই সময়ে যখন আমেরিকার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরমান এখন ভারত সফরে আছেন।  আর ভারত শেরমানের কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নালিশ দিচ্ছে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা, কনট্রোল করার জন্য; [ India Wednesday raised concerns over … Haqqani Network in Afghanistan along with the active role being played by Pakistan there…]। আর জবাবে শেরমান বলছেন, আফগান ইস্যুতে আমরা ভারত-আমেরিকা এক দেহ এক প্রাণ; US-India ‘one mind, one approach’ on Afghan-related issues. কেন? মনের দুঃখে দ্যা প্রিন্ট পত্রিকায় জ্যোতি মালহোত্রা যেন “পড়শিদের ছেড়েছুড়ে দিয়ে”  বনবাসে চলে যেতে চেয়েছেন!
অথচ এটা অপ্রয়োজনীয়! চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে পাশে নিয়ে এক ওয়ার্কিং জোট গড়ে নিয়েছেন। আপাতত যেখানে বাংলাদেশ হল ওয়ার হাউজ! আপাতত টিকার ওয়ার হাউজ!


লেখক : 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ০৬ অক্টোবর ২০২১, সাপ্তাহিক দেশকাল পত্রিকার ওয়েবে ও প্রিন্টে   “সার্ক এখন কারও না– এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
সাপ্তাহিক দেশকালে  ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a comment