ভারতের নিজেকে বিশেষ প্রিয়া দাবি, আমেরিকার অসহায়ত্ব


ভারতের নিজেকে বিশেষ প্রিয়া দাবি, আমেরিকার অসহায়ত্ব

গৌতম দাস

১১ অক্টোবর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3L8 

 

State-Dept-No-2-to-visit-Pakistan-India-after-Taliban-takeover


সার-সংক্ষেপঃ ছবিতে মাঝখানে আমেরিকান উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা আমেরিকান ডেপুটে সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়েন্ডি শেরমান যার দুপাশে দুজন, বায়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আর ডানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী। ওয়েন্ডি ভারত-পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন, বিশেষত আফগানিস্তান ইস্যু নিয়ে কথা বলতে। তাতে প্রথমে ভারত, পরে পাকিস্তানে গিয়ে এই ইস্যুতে কথা বলার পরে শেষে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পরে এই প্রথম ওয়েন্ডি সরাসরি আফগানিস্তান সফরে চলে গেছেন যখন আমেরিকা একা নয় দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রই তা-লে-বা-ন সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন নাই। আবার তাদের নয়া সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণও যখন ঘটে নাই, এমন সময় এটা।  তাই তা-লে-বা-ন-দের জন্য এটা মর্যাদার ও  আনন্দের যে খোদ আমেরিকা  আনুষ্ঠানিক  স্বীকৃতিদান সম্পন্ন না হলেও ওয়েন্ডি আফগানিস্তানে আসার তাগিদ বোধ করেছেন ও কথা বলেছেন। কিন্তু ভারত থেকে পাকিস্তান রওনা দিবার আগে, ভারত নিজেকে আমেরিকার “বিশেষ প্রিয়া” যেন এই গুরুত্ব দাবি করে বসেছিল। কী করে? যখন সে জানতে পারে ওয়েন্ডি ফেরার সময় পাকিস্তান যাচ্ছেন, তখন এটাকে দেখেছিল ভারত-পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মাপা মানে সমান গুরুত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে অনুযোগ করেছিল। শব্দটা হল, হাইফেনেশন মানে ভারত-পাকিস্তান মাঝখানে একটা ড্যাশ দিয়ে লেখা। স্বভাবতই এটার কো গুরুত্ব দেন নাই ওয়েন্ডি। আসলে এসম্পর্কেও একুটাই শব্দ প্রয়োগ করার আছে  “ফাজলামো” করে ভারত নিজেকে নিচে নামাচ্ছে! অপ্রয়োজনীয়!]

 

কোনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসাবে একজন প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রিন্টেড পত্রিকায় নিজের রাষ্ট্র-সরকারের মনোভাব-অনুভব নিয়ে কলাম লিখবেন তা সাধারণত আমরা দেখতে অভ্যস্ত নই। তবে তাই বলে তিনি লিখতে পারবেন না, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। বরং এমন সরাসরি লেখার ভেতর দিয়ে একধরনের স্বচ্ছতা আর অনেককে বা অনেক ইস্যুকে কিভাবে তিনি দেখেন, দেখতে চান তা নিয়ে আর কোনো লুকোছাপা গোপন ডিলিং নয়, এর বদলে ইস্যুটাকে ওপেনহ্যান্ড ডিলিং করার সাহস দেখানো যায়, অবশ্যই।

তেমনি একটা কাজ করেছেন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি আমেরিকার “ওয়াশিংটন পোস্ট” পত্রিকায় একটা মতামত কলাম লিখেছেন গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১। বলাবাহুল্য, তাতে প্রসঙ্গ হলো, এ সময়ের মুখ্য ইস্যু আফগানিস্তান এবং ২০ বছরের দখলমুক্তিতে একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পাকিস্তানির ফিলিং ও মূল্যায়ন। আর তার শিরোনাম হলঃ [Imran Khan: Don’t blame Pakistan for the outcome of the war in Afghanistan]।

সেকালের পাকিস্তান আমলের এক পশতুন এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার একরামুল্লাহ খান; এমন বাবার অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট ছেলেই হল ইমরান খান। প্রচলিত অর্থে ইমরান রাজনীতিবিদ নন, মূলত আন্তর্জাতিক লেভেলের ক্রিকেট প্লেয়ার বা দলের ক্যাপ্টেন। সেখান থেকে রিটায়ারমেন্টের পরে যেমনটা হয় আমরা দেখি, তিনি জীবন উপভোগকারী; কেউ কেউ যার ভেতর প্লেবয় ইমেজও খুঁজে পান। এরপরও তিনি সরাসরি রাজনীতিক হতে যাননি, বরং তার আগে সামাজিক চ্যারিটি বা দাতব্যমূলক কাজে নেমে গিয়েছিলেন; একেবারে এক ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার কাজে। এরই মধ্যে একবার হঠাৎ তিনি ১৯৯৬ সালে এক নয়া রাজনীতিক দল খুলে বসেন, নাম তেহরিক-ই-ইনসাফ। বাংলা করলে অর্থ হয় ‘ইনসাফের জন্য আন্দোলন’। দলের সংক্ষিপ্ত নাম পিটিআই [PTI] (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ)।

আমেরিকা গত ৪০ বছর ধরে পাকিস্তানকে প্রথম নিজের পছন্দের ইসলামে সাজিয়েছে আর  যেভাবে খুশি পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছেঃ
আফগানিস্তান থেকে ২০ বছরের দখলদারিত্ব সম্প্রতি শেষ টেনেছে আমেরিকা। তবে এই ২০ বছরেরও আগের (গত শতকে) ২০ বছরের ইতিহাসও কম লম্বা ছিল না। বলা যায় ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিলের ইরান বিপ্লব ছিল এর সুইচ-অন বা স্টার্টিং ঘটনা। ইরান এক নয়া ‘ইসলামী রিপাবলিক’ বলে নিজেকে ঘোষণা করেছিল সেদিন। ইরানের ঐ “খোমেনি বিপ্লবের” সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হল, এই প্রথম ১৯০১ সাল থেকে ইরানের তেল চুষে খাওয়া ব্রিটিশ কোম্পানি আর পরে (১৯৫৩ সাল থেকে) আমেরিকান নেতৃত্বে ব্রিটেনসহ পশ্চিমা পাঁচ তেল কোম্পানির যৌথ লুটপাট বন্ধ ও উতখাত করতে সক্ষম হয় তারা। ইরান এখান থেকেই তাদের গুটিয়ে চলে যাওয়ার শেষ দিন ঘোষণা করতে পেরেছিল।
কিন্তু তাতে আরেক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয় ভীত সোভিয়েত ইউনিয়নের মনে। তার দুশ্চিন্তা হল সেন্ট্রাল এশিয়া নিয়ে। সেন্টাল এশিয়া বলতে যা এখন আলাদা পাঁচ দেশ, আর যাদের নামের শেষে ‘স্তান’ আছে যেমন কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান; এরা। গত (১৭২১-১৯১৭) রাশিয়ান জার-সম্রাটের আমল জুড়ে সেন্ট্রাল এশিয়া রাশিয়ার দখলে ছিল; আবার পরেও লেনিন-স্টালিনের  বিপ্লব বা আমল থেকে তাঁরাও এদের নিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে নিয়েছিল। পিছনের মূল কারণ, সেন্ট্রাল এশিয়ার জনগোষ্ঠী এরা একেবারে গোড়ায় এথনিক জনগোষ্ঠি হিসাবে হল চীনা-মঙ্গোলয়েড। তারা চীনের তাং রাজার [Tang dynasty (618–907 CE)] অধীনে ছিল। কিন্তু  আব্বাসীয় ডাইনেস্টির আমল (৭৫০-১২৫৮) এই তাং রাজা পরাজিত হয়ে যায়। আর তাতে বাসিন্দারা তখন থেকে মুসলমান বা ইসলাম অনুসারী হয়েছিল। ফলে ইরানের খোমেনি বিপ্লবের পরে ইরানের পড়শি এরা না “বিপ্লবী” প্রভাবে পড়ে যায় আর তাতে না তারা তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বের হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়। এই ভয়ে কমিউনিস্ট সোভিয়েতরা ইরান আর সেন্ট্রাল এশিয়ার মাঝখানে এক প্রাচীরতুল্য বাফার স্টেট হিসেবে অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ সামরিকভাবে দখলে নিয়ে নিয়েছিলেন ওই বছরই, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯।  যার কাভার দেয়া হয়েছিল যে  আফগান কমিউনিস্ট পার্টি নাকি আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে ব্রেজনেভ-এর দেশকে ডেকে নিয়ে এসেছে।  কিন্তু এতে হিতে বিপরীত ঘটে যায়।

সেটা স্নায়ুযুদ্ধের আমল; ফলে সোভিয়েত “আগ্রাসনের” বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে আমেরিকা ফরজ জ্ঞান করে পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করেছিল। বলা যায় পাকিস্তানকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে চরম অপব্যবহারটা করতে শুরু করেছিল।  এতে পাকিস্তানকে “আমেরিকান স্বার্থে ইসলামী” করে সাজিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদিন’ আন্দোলন শুরু করেছিল আমেরিকা। এতে পাকিস্তান নিজের স্বার্থের নিজের জন্য আর দেশ-রাষ্ট্র থাকেনি। পাকিস্তান হয়ে যায় একদিকে সিআইএর ঘাঁটি ও তৎপরতার কেন্দ্র; অন্যদিকে আফগান রিফুইজিদের আশ্রয় আর আফগান মুজাহিদিন যোদ্ধাদের সুরক্ষার দেশ যাতে, তারা সোভিয়েত উৎখাতে তারা লড়তে পারে – এমনই এক লঞ্চিং প্যাড বা ভুমি হয় পাকিস্তান। শেষে ১৯৮৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত বাহিনী হেরে যায়।  হার স্বীকার করে সোভিয়েত বাহিনী চোখের জলে কাবুল ত্যাগ করেছিল, ঠিক যেমন গত ১৫ আগস্ট ২০২১ আমেরিকা কাবুল ত্যাগ করেছে।

ফিরে আসি একালে। “ওয়াশিংটন পোস্টে” ইমরানের ওই মতামত-কলামের মুখ্য তাৎপর্য হল তিনি আমেরিকাসহ পশ্চিমা মন ঠিকমত পড়তে পেরেছেন বলে তাদের ওপর ঠিকমত সওয়ার হয়ে এলেখাটা লিখতে পেরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকা কিভাবে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে একেবারে একান্ত নিজস্ব স্বার্থে বারবার পাকিস্তানকে ব্যবহার করে গেছে। যদিও সেটা বলার চেয়ে ‘ব্যবহৃত হতে পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে’ বলা সঠিক হবে। পশ্চিমা মন পড়ে তাদের মনের ভাষায় কথা বলাতেই ইমরানের এ’লেখা আকর্ষণীয় হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের প্রপাগান্ডাসহ পশ্চিমা মন যারা ওয়ার অন টেররের প্রপাগান্ডায় “মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী”- এব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠায় ২০ বছর ধরে কসরত করে গেছেন; এদের মুখের উপরই ইমরান এক কড়া জবাব দিয়েছেন। কারণ পাকিস্তান শুধু এই শতকের ২০ বছর নয়, গত শতকেরও ২০ বছর ধরে আমেরিকার স্বার্থে বলি হয়ে গেছে বারবার। যেন আমেরিকা নয় (তার স্বার্থ বা নীতি নয়), পাকিস্তানই ‘সন্ত্রাসবাদ’ আবিষ্কার করেছে আর চর্চা করে গেছে।

জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানে সামরিক ক্ষমতা দখল করেছিলেন ১৯৭৭ সাল থেকে। এই জিয়াউল হক, আমেরিকা তাঁর ঘাড়ে সওয়ার হয়েই সোভিয়েত তাড়ানোর কৌশল হিসেবে এক ইসলাম প্রচার শুরু করেছিলেন। আর তাতেই পাকিস্তানকে আরো কথিত ইসলামী করে গড়ে তুলতে পুরনো বৃটিশ আমলের পেনাল কোডের ২৯৫ ধারাকে নতুন করে ব্লাসফেমি আইন বলে একে ঢেলে সাজিয়ে প্রচারে আনা হয়েছিল। আর ওদিকে নতুন নতুন মাদরাসা খোলার জন্য অঢেল অর্থ দেয়ার এক কর্মসূচির পুরোটাই আমেরিকান কর্মসুচী ছিল যা সোভিয়েত তাড়ানোর  আমেরিকান ততপরতার অংশ। সৌদি আরব ও কিছু বিশেষ পাকিস্তানি মাওলানার তত্ত্বাবধানে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। অথচ এখন মুসলমান মানেই জঙ্গি আর পাকিস্তান তাদের আঁতুরঘর যেন- এটাই আমেরিকান থিংকট্যাংকের প্রধান বয়ান ও অভিযোগ। আর এখান থেকেই ভারতের কথিত জঙ্গিবাদের বয়ানও শুরু হয় [সাথে অবশ্য ভারতীয় কাশ্মীরের ভোটচুরি করে এই ব্যবস্থা অকেজো করে দেওয়ায় দায়ী]। বাংলাদেশেও এরা বলে, কথিত পশ্চাৎপদ বলে মুসলমানরা নাকি ব্লাসফেমি আইন চায়, মাদরাসাগুলো হলো জঙ্গি গড়ার আস্তানা প্রভৃতি প্রপাগান্ডা। ভারতকে সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ-ব্লেয়ার  আর আমেরিকান থিংকট্যাংকের এই যে বয়ান, একেই ইমরান খান চ্যালেঞ্জ করেছেন, ঐ লেখায়।

কেন এসময়ে তিনি করতে গেলেন?
সাম্প্রতিককালে আফগান সেনা প্রত্যাহার-উত্তরকালে আমেরিকান কংগ্রেসে (সংসদে) এনিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে শুনানি চলেছিল। আমেরিকা লবিংয়ের দেশ, লবিং করার কাজ বৈধ।  কংগ্রেস সদস্যের কাছে  খাতির জমিয়ে লবিং করে দিবে বলে কারো কাছে থেকে অর্থ নিতেও সমস্যা নেই। কেবল বিচার মন্ত্রণালয়ে রাখা একটি ফরম পূরণ করে রাখতে হবে। তা করার সময় স্ব-উদ্যোগে অর্থ নেওয়ার কথা আগাম তা উল্লেখ করে আসতে হবে। তবে এই লিখে স্বীকার করে নেয়া কোনোই অপরাধ নয়। তাই কোনো সমস্যা নেই। তবে ভবিষ্যতে এ কাজের ভেতরে অন্য কোনো আইনভঙ্গ করার বিষয় যুক্ত বলে প্রমাণিত হলে তখন সেই আইন ভঙ্গের কারণে এটা অপরাধ হতে পারে। নইলে না। এই কংগ্রেস বা সিনেটরদের লবিংয়ে ভারত লবিং খুবই শক্ত। কারণ তারা মেরিকান ব্যবসায়ীদেরকে নানান ব্যবসা দিয়ে কংগ্রেস্ম্যানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। ফলে ভারতও এদের দিয়ে এই শুনানিতে পাকিস্তানের ওপর সব দায় চাপিয়ে বাইডেনকে মুক্ত করতে লেগে পড়েছে। আর এ কারণেই ইমরান নিজের হাতে ও নামে মতামত কলাম লিখেছেন।

ইমরানের ওই লেখায় প্রথম প্যারাটা এরকমঃ “সাম্প্রতিককালের কংগ্রেসনাল শুনানি দেখে আমি আসলেই বিস্মিত হয়েছি। গত দিনগুলোতে (প্রায় ৪০ বছর, ইমরান কম করে কেবল চলতি শতকেরটা ধরে দুই দশক বলেছেন) আমেরিকার সহযোগী দেশ হিসেবে পাকিস্তানিরা আমেরিকার ওয়ার অন টেরর কর্মসূচিতে যে আত্মত্যাগ করেছে, এর কোনো উল্লেখ নেই দেখে বিস্মিত হয়েছি। অথচ এর বদলে আমরা দেখছি  আমেরিকার যেসব ক্ষতি হয়েছে, এই শুনানিতে এর কারণে আমাদেরকে দায়ী করা হয়েছে”।

“Watching the recent Congressional hearings on Afghanistan, I was surprised to see that no mention was made of Pakistan’s sacrifices as a U.S. ally in the war on terror for more than two decades. Instead, we were blamed for America’s loss.” – Imran Khan

অথচ “আমি বারবার বলে এসেছি আফগানিস্তানে বিজয়-সম্ভব-নয় [unwinnable], এটা এমন একটি যুদ্ধ। আফগানরা এমন এক লড়াকু জাতি, যারা কখনো নিজ ভূমিতে বিদেশী উপস্থিতি সহ্য করেনি। এমনকি সেই বিদেশী পাকিস্তান হলেও এই বাস্তবতা বদল হবে না”। এরপর ইমরান ওই সব বিগত বছর পাকিস্তানের কী কী ক্ষতি হয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে, এসবের পরিসংখ্যানগত লম্বা বর্ণনা সাথে জুড়ে দেন।

এসবের বর্ণনাযুক্ত বয়ান পাঠকরা ঐ  মতামতকলাম থেকে নিয়ে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিতে পারে। ঘটনাচক্রে প্রথম এ’ব্যাপারটা  আমার নিজের নজরে এসেছিল পাকিস্তানের ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে। আমার হাতে আসে ইমরানের দলের ঘোষিত মেনিফেস্টো, যা সম্ভবত ২০১৬ সালে তৈরি করা; কারণ তাতে ওবামা আমলে ব্যাপক ড্রোন বোমা হামলা ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়ে নিন্দা জানানো হয়েছিল। আমি ওবাক হয়েছিলাম এ জন্য যে, এই প্রথম আমেরিকান ওয়ার অন টেররকে একেবারে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানে পাকিস্তানকে কিভাবে বাধ্য করা হয়েছে আর এতে পাকিস্তানের স্বার্থে কিভাবে বিঘ্ন হয়েছে – এই বয়ান দাঁড় করানো হয়েছে।

কিছু ব্যক্তি অভিজ্ঞতাঃ
গত ২০১৩ সালের দিকে বিদেশে মানবাধিকার ইস্যুতে এক প্রোগ্রামে অংশ নেয়ায় অনেক দিন পর কিছু পাকিস্তানি নারী-পুরুষের সান্নিধ্যে সাথে দু-তিন দিনের সেশনে কাটাতে হয়েছিল। ফলে সেসময় একালের পাকিস্তানের তরুণ-যুবাদের সম্পর্কে নতুন অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছিল। এমনিতে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিদেশী চাকরি সূত্রে অনেক পাকিস্তানি আমার কলিগ ছিলেন, কখনো বাসা পাওয়ার সমস্যায় তাদের সাথে একই বাসায় বসবাস বা শেয়ার করেছি; স্বভাবতই অফিসরুমও শেয়ার করেছি।  বিশেষত সেটা আফ্রিকা বলে আমরা এশিয়ান পাকিস্তানি, আফগানি, ভারতীয় বা ভুটানিরা যেন আপন আত্মীয় হয়ে গেছিলাম।  দে্শিভাইয়েরা তো আছেই, সাথে ভারতীয় ব্যাটেলিয়ন আর বিশেষত পাকিস্তানি ব্যাটেলিয়ান অফিসারেরা; কারণ তারা  মাসে অন্তত দুদিন আসত আর খুব খাওয়াদাওয়া হত।  তবু পাকিস্তানের তারুণ্যে এসব লেটেস্ট পরিবর্তন তখনো তেমন জানা হয়নি। তবে ২০১৩ সাল থেকে আলজাজিরার কিছু রিপোর্ট থেকে প্রথম টের পাই আমাদের চেনা সেই পুরনো রক্ষণশীল পাকিস্তান বদলে যাচ্ছে। তরুণ বা নয়া প্রজন্ম আগের আমেরিকান বয়ানে আর আগ্রহী নয়। খুঁড়িয়ে হলেও পাকিস্তানে এক নয়া প্রজন্ম, এক নয়া এডুকেটেড মধ্যবিত্ত একালে হাজির হয়ে গেছে। আমার রিডিং ও অনুমান এই নয়া প্রজন্ম পাকিস্তানকে বদলে দিচ্ছে।  পাকিস্তানের জন্য তারাই সম্ভবত আগামী দিনের বিরাট ভরসা! যেমন আসলে আর কত? – দোষ মূলত আমেরিকার অথচ দেশ-বিদেশে প্রপাগান্ডা চলছে যে সব দোষ পাকিস্তানের, আর পাকিস্তানই জঙ্গি ইত্যাদি বয়ান শুনতে শুনতে তারা হতাশ ও বিরক্ত। ফলে আমার মনে হত ইমরান আগামিতে তাদের সম্ভাব্য নেতা হবেন হয়ত। আর এরই কিছু ২০১৩ সালের শেষের নির্বাচনে এর কিছু আলামত দেখেছিলাম। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে এসে এর সরাসরি ফল দেখলাম।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বদলঃ
ইমরানের সাথে তুলনা করলে অপর দুই দল ও নেতা ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফের দল, এদের ব্যর্থতা হল – তারাও নিঃসন্দেহে প্রচণ্ডভাবে যা-ইচ্ছা তাই ভাবের আমেরিকান চাপ সয়েছেন আর পাকিস্তানের উপরেই ড্রোন-বোমাবাজিসহ যা ইচ্ছা আমেরিকা করতে চায়, তা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তারা এখান থেকে বের হওয়ার পথ না খুঁজে বরং সে সময়-সুযোগটাতে আমেরিকার নামে দোষ চাপিয়ে রাষ্ট্রীয়-সম্পদ নিজের নামে দখল বাড়ানো  ও লুটের দিকে কাজে লাগাতে গেছেন। এটা অকল্পনীয় যে, আমাদের মত দেশের কোন নেতা দুই বিলিয়ন ডলার সম্পদ গড়েছেন। দুই বিলিয়ন কী ব্যক্তির একাউন্ট বা পকেটে থাকার মত অর্থ? অথচ এটাই পাকিস্তানে হয়েছে।
আর ওদিকে সেনাবাহিনীও প্রচণ্ডভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল বিশেষ করে ট্রাম্প আমলের শুরু থেকেই।  ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে প্রতিদিন গড়ে আমেরিকাকে নিয়মিত ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় থেকে আমেরিকায় নিজ প্রশাসনকে বাঁচানো; কিন্তু তিনিও  পাকিস্তানকে এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দায়ী বলে মনে করে তাতে ভারতকে সাথে নিয়ে প্ররোচনায় তার প্রপাগান্ডা শুরু করতে থাকেন।
গত ২১ নভেম্বর ২০১৮ ট্রাম্প বলেন,  “ওরা (মানে পাকিস্তান) আমাদেরকে সাহ্যায্য করতে কিছু করে নাই” – আর এই অজুহাতে তিনি মোট প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রত্যাহার করেছিলেন [“Done Nothing To Help Us”: Trump On Stopping $1.3 Billion Aid To Pakistan]। এই প্রপাগান্ডা নিউজটা ভারতের। তবে সবচেয়ে বড় হৈচৈ পড়েছিল যে খবরে সেটা হল, ৩০০ মিলিয়ন ডলার যা Coalition Support Funds  হিসাবে যা পাক-আর্মিকে দেয়ার কথা তা প্রত্যাহার করে নেওয়ায়।  কিন্তু আমেরিকান [VOX News] ভক্স নিউজ জানায় ঘটনা কিছু অন্য। তারা লেখেছিল,  It’s all part of a broader strategy to have Pakistan help defeat regional militants — but it’s unclear if the strategy is working. কিন্তু এই কৌশল কেন নেয়া হয়েছে তা অস্পষ্ট।

ফলে সারকথায় ট্রাম্প পাকিস্তানকে আরো ঠেকিয়ে ধরেছিলেন। কারণ ডলার আয়ের অভাব তখন এমনিতেই পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ছেয়ে বসেছিল। যদিও তাতে  ততদিনে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত সেনাবাহিনী আমেরিকান “অস্পষ্ট” অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্পকে আর তোয়াজ করতে যায় নাই, সম্পর্ক এতই নিচে নেমে গেছিল। ফলে আর আমেরিকাকে আবার আপার হ্যান্ডে যাবার সুযোগ দেয় নাই বা আসে নাই। ফলে তখন থেকেই রাজনীতিবিদদেরও আগে পাকিস্তান সেনারা নতুন বন্ধু খুজতে গিয়ে চীনের কোলে গিয়ে উঠেছিল। চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক বহু আগের কমপক্ষে ১৯৬৮ সাল থেকে, তা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু তা সত্বেও পাকিস্তানের কাছে আমেরিকা গুরুত্ব বা ঘণিষ্ঠতা চীনেওরও উপরে।  ফলে ভারত যতই প্রপাগান্ডা করুক প্রথমত চীন নয়, পাকিস্তানের কাছে আমেরিকা গুরুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা ছিল চীনের চেয়েও উপরের।  আর দুইঃ আমেরিকাই পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক একেবারেই দুর্বল করে ফেলেছিল।  বাধ্য হয়েও সে চীনকেই নিজ সম্পর্কের শীর্ষে নিয়েছিল। আসলে আফগানিস্তানে খরচ ও ব্যর্থতায় ডুবে আমেরিকার বেপরোয়া আচরণই সব সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। একেবারে ভাঙ্গে নাই, কিন্তু মর্ম দুর্বল হয়ে গেছে স্থায়ীভাবে।
শেষে, ২০১৮ সালের শেষ থেকে ট্রাম্প বুঝতে পারেন, তাঁর এই মিথ্যা কৌশল অকাজের; এটা তাঁর নিজের স্বার্থের পক্ষেই কাজ করবে না।  মুল কারণ, আমেরিকাকে  আফগানিস্তান ফেলে বের হতে যেতে গেলে – কোন পুতুল গণি সরকার তাকে সাহায্য করতে পারবে না। আমেরিকার একমাত্র পথ ও ভরসা যদি তারা তালেবানদের সাথে একটি চুক্তি করতে পারে। কারণ যুদ্ধের ময়দান পরিত্যাক্ত ফেলে কারো ভেগে যাওয়ার পরিকল্পনার মানে হল পালানোর সময় কেউ আক্রমণ করলে সে্টা থেকে কাভার মানে ঐ হবু আক্রমণ থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করবে কে? এর ব্যবস্থা করতেই – টানা বিশ বছর যে তালেবান যোদ্ধাদের সাথে আমেরিকা যুদ্ধ করল  ট্রাম্প  বুঝে যান যে এই তালেবান যোদ্ধাদের সাথেই তাকে চুক্তিতে আসতে হবে। কিন্তু এই সমস্যা আরো জটিল কারণ ট্রাম্প টের পেলেন যে, পাকিস্তানই একমাত্র দেশ যে  আমেরিকানদের সাথে একটা চুক্তি করতে তালেবানদেরকে রাজি করাতে আমেরিকাকে সাহায্য করতে পারে।

তাই ট্রাম্প তালেবানদের সাথে আপসনামা রচনায় তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে এক আফগান অরিজিন আমেরিকান ডিপ্লোমাট [Zalmay M. Khalilzad] জালমে খলিলজাদকে নিযুক্ত করার পরই ট্রাম্প পাকিস্তানের সাথে দ্রুত সব  বিবাদ মিটিয়ে ফেলেন। তবে ২০১৮ সালে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে তালেবান আলোচনা গতি পায় যদিও;  কিন্তু ততদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমেরিকা থেকে বহু দূরে সরে গেছে। বলা যায়  মূলত গত প্রায় বিশ বছরের গভীর সামরিক সম্পর্ক, নির্ভরশীলতার  সম্পর্ক পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেকটাই গুটিয়ে ফেলেছিল।  আর ততই চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করে নিতে এগিয়ে যায়।  খুব সম্ভবত এটাই পাকিস্তান সেনা প্রশাসনের ইমরানের দলের সাথে  নয়া এক ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলার ভিত্তি হয়ে যায়। যেটা একেবারেই মাঠে কার্যকর হয়ে যায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে।

আমেরিকা যে সারাজীবন একান্ত নিজের স্বার্থে পাকিস্তান ব্যবহার করে গেছে অথচ এর সব আবর্জনার ও দায় উলটা পাকিস্তানের উপর ঢেলেছে – আর এর বিপরীতে ইমরানের দলের নয়া বয়ান পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শুধু ছুঁয়ে যায় তাই না,  হুঁশের এই বয়ান পাকিস্তানে সবচেয়ে কার্যকর এক নয়াপথ হিসাবে হাজির হয়েছিল।  আসলে  অতি-নির্ভরশীলতা ত্যাগ না করলে, কষ্ট না করলে স্বাধীনতা ভোগের যোগ্য হওয়া যায় না – সেটাই ঘটেছিল।  আর তা পেরেছিল বলেই তারা ইমরানের সাথে সম্পর্ক গড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। বরং এখন উলটা পাকিস্তানের ওপর আমেরিকান নির্ভরশীলতা এখনো বর্তমান। আফগানবিষয়ক বা ইরান ও সেন্ট্রাল এশিয়ার ওই অঞ্চলে আমেরিকার সব ধরনের স্বার্থের জন্যই আমেরিকার পাকিস্তানকে দরকার। এ কারণে ভারত যতই চেষ্টা করুক, মার্কিন কংগ্রেসকে দিয়ে পাকিস্তানবিরোধী চাপ সৃষ্টি করবে ইত্যাদি যাই করুক; কিন্তু বাইডেন প্রশাসন জানে পাকিস্তানকে তার কেন দরকার।

ওদিকে ভারতের হাহাকারঃ
এরই মধ্যে দোহায় (২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০) দেড় বছর আগের আমেরিকান-তালেবান চুক্তিতে ভারত কী কী হারিয়েছে বা কী কী নেই, তাদেরকে জানানো হয়নি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভারত এখন আপত্তি তোলা শুরু করেছে। কোথায় আর এখন কেন?

জয়শংকর বলেছেন, দোহা চুক্তির বহু বিষয় নিয়ে ভারতকে অন্ধকারে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রঃ
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল ওয়াশিংটনে ভারত-আমেরিকা ‘কৌশলগত পার্টনার’ ফোরামের চতুর্থ বৈঠক [US-India Strategic Partnership Forum (USISPF)] । যদিও হিন্দুস্তান টাইমসের নিউজটা জয়শঙ্করের  ভনেকটা ঘুরিয়ে বলা ভাষ্যটা। বলা সেই ভাষ্যটা এরকম, ট্রাম্প-তালেবান কথা চালাচালির অনেকগুলো থেকেই ভারত বাইরে পড়ে গেছিল ‘India wasn’t fully in the loop on US-Taliban deal’: Jaishankar explains concerns]।
সেখানে ভারতে আমেরিকার এক সাবেক রাষ্ট্রদূত ফ্রাংক জি উইজনারের প্রশ্নে এসব মতভিন্নতা বাইরে চলে আসে [During the question and answer session, former US ambassador to India Frank G. Wisner quizzed him on the “dramatic” developments in India.]। ফলে যদিইও সেটা ভারত-আমেরিকার দুই সরকারি বৈঠক নয়। তবু উইজনারের প্রশ্নের জবাবে নিজের অনুযোগ জয়শঙ্করকে সেখানে হাজির করতেই হয়েছিল।  সেখানে ভারতের ক্ষোভ হল – “ভারতকে জানানো হয়েছিল যে, এক ইনক্লুসিভ সরকার হবে (ভারতের কাছে এর ব্যাখ্যা সম্ভবত, গণি সরকারেরও প্রতিনিধি তালেবান সরকারে থাকবেন)। এ ছাড়া নারীদের কী হবে? আর সর্বোপরি ভারতের প্রশ্ন, তালেবানের আমলে কি ভারতীয় কাশ্মিরের মুসলমানরা তালেবান সহায়তা পাবে?” তবে কথাটা অন্য ভাষ্যটা হল, যেমন বলা হচ্ছে যে, তালেবানের মাটি কি অন্য দেশে সন্ত্রাস চালানোর কাজে ব্যবহৃত হবে? কিন্তু এই একই প্রশ্নের অন্য দিক আছে, আগে যেভাবে গনি সরকারের আমলে আফগান মাটি ব্যবহার করে ভারত-আমেরিকার সমর্থনে  চীন ও পাকিস্তানে  অন্তর্ঘাতমূলক
আক্রমণ চলত, প্রজেক্টে হামলা চলত, চীনা প্রকৌশলী নিহত হতেন, সেসবের কী হবে? অর্থাৎ সেই একই গান?  ভারত-আমেরিকার সমর্থনে যে চীন ও পাকিস্তানেও সন্ত্রাসী আক্রমণ চলছে তা নিয়ে তিনি চুপচাপ।  বে ওই স্ট্র্যাটেজিক সভা শেষ হয়েছে ভারতের এ মর্মে অসন্তোষে যে, আংশিকভাবেই গনি সরকারের আমলের কোনো সুযোগ-সুবিধা ফেরত আসছে না কেন!

এব্যাপারে আমেরিকান ব্যাখ্যা হল, আমরা ৩০ আগস্টের আগেই সব অস্ত্র ও রসদ নিয়ে ফিরে চলে আসব, কোনো কিছু আর আফগানিস্তানে ব্যবহার করব না – চুক্তিতে এমন কথা ঢুকিয়েই আমরা বিপদে পড়ে গেছিলাম।। চুক্তির এই ফেরে পড়েও তালেবানরা চুক্তির কোনো অংশ বাস্তবায়ন না করলেও আমরা চিপায় পড়ে গেছি। মানে এখন কিছুই করার নেই, ‘মাফ চাই’ ধরনের।

আর ভারতের ততই গোসসা। এতদিন কংগ্রেসের শুনানি চলাবস্থায় বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের সাথে তাদের অনেক কথা বলা দরকার হলেও তা করতে যাননি। অবশেষে আমেরিকান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরমানের ভারত সফরে গত ৬ অক্টোবর ফরমালি ভারতের গোসসা শোনা হয়। ভারত এবার সুযোগ পেয়ে আফগান হাক্কানি নেটওয়ার্কের আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। দ্যাপ্রিন্টের নয়নিমা বসু তার আর্টিকেলের শিরোনাম করেন “India raises concerns over Haqqanis, ISI in Afghanistan with visiting US Deputy Secy of State”]। এই আর্টিকেল পাকিস্তানের মুন্ডপাত করা ভারতের আভ্যন্তরীণ দেশপ্রেমিক জনগণ তা পছন্দ করতে পারে। কিন্তু একাজ নিঃস্ফলা।

ট্রাম্প কি জানতেন না যে তালেবান বলতে তাদের সাথে হাক্কানি গ্রুপও থাকবে?
এ বিষয়ে আসলে কিছু কড়া কথা বলতেই হয়। বিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার পর বাজনা বাজাতে দেখলে মানুষের বিরক্তই লাগবে। ট্রাম্প কি জানতেন না যে তালেবান বলতে তাদের সাথে হাক্কানি গ্রুপও থাকবে?  এমনকি ট্রাম্পের জানা না  থাকলেও নিজে থেকেই হাক্কানি গ্রুপ প্রসঙ্গে আগাম তাদের আপত্তির কথা বরে রাখা যেত। যা তিনি বলেন নাই। তা তিনি বলে নেননি কেন? এফবিআই কিংবা ইউএনের খাতায় হাক্কানি নেতা সিরাজুদ্দিনের মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে নাম আছে তো! তাতে কী?  কারণ, ট্রাম্প যখন দোহা চুক্তি করেই ফেলেছেন যেখানে সিরাজুদ্দিন বা ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ নেতাদের সম্পর্কে কী হবে এ নিয়ে আমেরিকার কোনো আপত্তি করে রাখা হয় নাই। তাহলে সিরাজুদ্দিন বা হাক্কানি প্রসঙ্গে এখন আমেরিকানদের কিছুই বলার নাই। আবার থাকলেও আমেরিকার কিছু করর থাকত না। কেন?  আমেরিকানদের পক্ষে কিছু লেখা থাকলেই তা বাস্তবায়নে তালেবানদের বাধ্য করার জন্য আমেরিকার হাতে কোনো উপায় রাখা হয়নি। তার সব উপায় ও অস্ত্র ৩০ আগষ্টের পরে প্রতাহার করে নিয়ে যেতে বাধ্য ছিল আর আমেরিকানেরা তাই করেছে। কাজেই হাত ধুয়ে ফেলা ছাড়া আমেরিকার কী করার আছে এখন! – এর সোজা অর্থ, এখন এসব ফালতু আলাপ। এখন আমেরিকা চুক্তি করেছে মানেই তারা তালেবানদের সরকারে থাকতে পরোক্ষে হলেও অ্যাপ্রুভাল দিয়ে দিয়েছে। কাজেই ভারতের এখন এখানে সেখানে হাক্কানিদের “তালিকায় নাম আছে’, তালেবান সরকারে হাক্কানিরা আছে – বলে এসব নিয়ে কিছু দিনের প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কোনো মূল্যই নেই।

আর পাকিস্তান নিয়ে নালিশের ব্যাপারে মার্কিন উপপররাষ্ট্র-মন্ত্রী শেরমান ওয়েন্ডি ভারতকে বহু কিছু বলে দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, তিনি বলছেন তা হল, সেই রাধাও নেই আর তার নাচের মন-মর্জিও নেই। মানে ওই সব বাদ দিতে হবে। তিনি সোজা করে বলেছেন, দেখুন  সেই আফগানিস্তান আর নাই এটাতো একুশ শতক আর গত ২০ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে [we live in the 21st century and that things have changed over the last 20 years. ]। এখন যতটুকু যা হতে পারে তা হলো, আমরা সবাই (ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি) যদি এক থাকতে পারি, একসাথে চেপে ধরতে পারি তা হলে কিছু হতে পারে। এরপর তিনি সরাসরি স্বীকার করে নেন যে, ‘সেই আফগানিস্তান আর নেই যেমনটি কেউ কেউ চাচ্ছে।’ মানে কথা সোজা, ও দিন গত, আমাদের সেই মুরোদও আর নেই। কাজেই বিরক্ত কইরেন না…।’

“And I think what I hope is that everyone engaged with the Taliban, I have no problem, and the United States has no problem with people engaging with the Taliban, and telling them what needs to happen, that we live in the 21st century and that things have changed over the last 20 years. It is not the Afghanistan that they want to, and that it will be very hard to try to go all the way backwards and the international community has to stand as one,”

শেষে ভারত বোবা হয়ে গিয়ে আর কিছু না পেয়ে এবার শেরমানকে চেপে ধরেছে। কেন? কী নিয়ে? কারণ ততক্ষণে আপনাতেই প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি ভারত থেকে পাকিস্তান যাচ্ছেন। এখন ভারতীয় ছেচড়ামো শুরু হয়েছে, আপনারা তা হলে ভারত-পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মাপছেন? এটি বলে ‘সে কী কান্না’! মানে ভারত বলতে চাচ্ছে আমরা তো পাকিস্তানের চেয়ে উঁচু জাতের ছিলাম তোমার কাছে। আর তার কী হলো?  কথাটা ইংরাজিতে তারা বলে বলে হাইফেনেটেড করা। মানে ভারত-পাকিস্তান শব্দ দুটো মাঝখানে একটা ড্যাশ দিয়ে লেখা!

এখন সমস্যা হলো, এই কান্না দেখেও আমেরিকার হাতে কিছুই করার নেই! তবে একটি সান্তনা বাক্য দিয়েছেন ওয়েন্ডি, বলেছেনঃ বিশ্বাস করো বেশি মিশব না, খালি অল্প একটু করে মিশব [It’s for a very specific and narrow purpose]!

তবে ভারতকে এখন ভান করেই যেতেই হবে যে, আমেরিকার কাছে অনেকের চেয়ে দামি সে!
তবু খুশি থাকুক, এ আমাদের কামনা!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ০৯ অক্টোবর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “ভারতের গোসসা, আমেরিকার অসহায়ত্ব– এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s