এবার জয়শঙ্করের ‘ভেটো’ আলোচনা!


এবার জয়শঙ্করের ‘ভেটো’ আলোচনা!

গৌতম দাস

২২ আগষ্ট  ২০২২   ০০ঃ০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-4dq

 

    EAM Jaishankar

কেন শিরোনামটা এমন? ভেটো মানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (UNSC) ১৫ সদস্যের যার ১০ আসন অস্থায়ী এবং বিভিন্ন মহাদেশের কোটা থেকে দুবছরের জন্য নির্বাচিত করে নেয়া হয়। আর পাঁচ টা আসন এগুলো স্থায়ী-আসন বলা হয় শুধু তাই না এই পরিষদে আলোচনার  জন্য হাজির করা যেকোন প্রস্তাবের উপর আলোচনার আগেই এই পাঁচ সদস্যের যেকোন একজন ভেটো বা আপত্তি দিতে পারে। আর তা দিলে ঐ প্রস্তাব পাশ হওয়া দূরে থাকে ঐ প্রস্তাবই বাতিল বলে গণ্য হবে।  এই পাঁচ ভেটোধারী ও স্থায়ী সদস্য হল আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া আর চীন।  গত ২০ বছরে ভারত অনেকবার এমন ভেটোধারী সদস্য হবার চেষ্টা করেছে, আমেরিকার দ্বারা সমর্থিত হবে বলে আশ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু বারবার সে আলোচনা চাপা পরে হারিয়ে গেছে। এবার জয়শঙ্কর যিনি এখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী – তার মুখ দিয়ে আবার প্রসঙ্গটা আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে তাঁর এক বক্তৃতার ইউটিউব ক্লিপ ভারতের মিডিয়ায় অনেক ছড়িয়েছে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে (এরপর থেকে এ’লেখায় শুধু পরিষদ লিখব) ভারতের স্থায়ী আসন বা ভেটো ক্ষমতা পাওয়ার স্বপ্ন বহুদিনের। কিন্তু স্বপ্ন দেখনেওয়ালাদেরও দুইটা ধরণ দেখা যায়। এক হল যারা স্বপ্ন দেখতেই থাকে, পেলে কী করবে সেই হিংসাতেও তাদের বুক জ্বলে কিন্তু যোগ্যতার অভাবে স্বপ্ন বাস্তব করতে পারে না।  ফলে ধান্দাবাজ লোক ধরে যাদের মিথ্যা প্রলোভনের পিছনে তারা বছরের পর বছর ঘুরেই চলে, বেখবরে। কিছু আগালো কিনা সে মুল্যায়নও করে না।
আরেক দল আছে যারা স্বপ্ন কিভাবে বাস্তবায়িত করা যাবে এজন্য বাস্তবিক সমস্যা, বাধাগুলোকে স্টাডি করে আর একটা করে বাধা অপসারণ করে করে আগায়। তবে এরা অবশ্যই সবার আগে দেখে নেয় সেটা বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্ন কিনা। যদি হয় তবেই সে আগায়। এজন্য এদেরকে বলে রিয়েলিস্ট; মানে, যারা বাস্তবের চোখে দেখে স্বপ্ন বিচার করে।  কেবল স্বপ্নেই পোলাও খেয়ে চলে না!  এদুই ক্যাটাগরির বিচারে ভারত হল প্রথম ধরণের। তাই, আমেরিকার মিথ্যা আশ্বাসের পিছনের সে ঘুরতেই আছে এই ভরসায় যে আমেরিকা তাকে ভেটোক্ষমতা এনে দিবে।
অথচ একটা সহজ ভাবনা-কল্পনায় যদি দেখি জাতিসংঘের বর্তমান ওরিয়েন্টেশন মানে যেভাবে এটা সাজানো আছে এভাবেই যদি তাকাই তাহলে দেখব একা আমেরিকা নতুন কারও কোন ভেটোক্ষমতা পাইয়ে দিবার ক্ষমতা নাই বা রাখে না। কারণ, একা আমেরিকা না, পাঁচ ভেটোসদস্যই যদি ভারতকে ভেটোক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয় তবেই তা হতে পারে। চীনসহ যেকোন এক ভেটোসদস্য আপত্তি করলেই সব শেষ। তাহলে একা আমেরিকার আশ্বাসের উপর ভারতের অপেক্ষা তো অর্থহীন!! অথচ  গত বিশ বছর ধরে এটাই ভারতের আশ্বাসের  ভিত্তি হয়ে আছে, খামোখা।

একালের হিসাবে যদি বলি তবে প্রণব মুখার্জির আমল এই আশ্বাসের ভরসা শুরু হয়েছে। মোটামুটিভাবে ২০০৭ এর পরে মানে যখন থেকে আমেরিকা বিশেষ করে বুশের আমল শেষে ওবামা চীন ঠেকানো বা China Containment এর ঠিকাদারি ভারতকে দিতে এসেছিল।

তাই ওবামা যখন বুশের চেয়েও বড় করে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল (যে ভারতের স্থায়ী আসনের দাবিকে আমেরিকা সমর্থন দিবে) প্রণবের সরকার তা বেশ জোশের ঠেলায় বাস্তবতার দিকে তাকানোর বদলে স্বপ্নে ভাসতে শুরু করে দিয়েছিল। ভারত কতদুর নিজেকে নিচে নেমেছিল, বোকা চিন্তাশুন্য বানিয়েছিল তা বুঝা যায় যখন,  ২০০৯ সালে থেকে শুরু হওয়া হাসিনা সরকার পরে প্রথম ভারত সফরে গিয়েছিল এক বছরের মধ্যে ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি। সে সফরে প্রণব মুখার্জি লিখায়ে নিয়েছিল যে বাংলাদেশও (যে ঘরকা মুরগি ফলে যত খুশি জবেহ দেয়া যায়) ভারতের স্থায়ী আসনের দাবি সমর্থন করবে! সফরের শেষে যে ‘যৌথ ঘোষণা’ বের হয় তাতে একথা লেখা আছে। অথচ বাংলাদেশের সমর্থন তো কোন রিকয়ারমেন্ট নয়!

জাতিসংঘ কী আর কী নয় তা বুঝাবুঝিতে খামতিঃ
সবকিছুর গোড়ায় আছে আসলে জাতিসংঘ কী আর কী নয় তা বুঝাবুঝিতে খামতি – এই বিষয়টা। জাতিসংঘ এক আজিব জিনিষ; সেটা এই অর্থে যে এটা ঠিকঠাক বুঝলে তো বুঝছেনই। আর না বুঝলে তেজপাতা; মানে সারাজীবন আমি-আপনি সব বুঝিছি ভান করেই কাটিয়ে যেতে পারব। তাতে আপনি প্রণব মুখার্জি বা জয়শঙ্কর যাই হোন না কেন!! আপনার পদ-পদবি অনেক উচুঁতে হতে পারে কিন্তু তাতেও কোন নিশ্চয়তা নাই যে আপনি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানটা বুঝেছেন বা বুঝবেনই! যেমন বেশির ভাগ মানুষের ধারণা এটা একটা ‘গণতন্ত্রী’ প্রতিঠান; অথচ এরা খেয়াল করেন না যে পাড়ার ক্লাবের ক্ষেত্রেও এর মেম্বারেরা সবাই-ই দেখতে সমান মনে হলেও সবাই সমান ক্ষমতার হয় না।

প্রথমত জাতিসংঘ অবশ্যই এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু একটা দেশের পার্লামেন্টের মত সব সদস্যের সমান অধিকার, বা এক ভোট –  না জাতিসংঘ এমনটা নয়। বরং অসম ক্ষমতার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও আবার বড় ক্ষমতার রাষ্ট্রগুলোর কেউ যেন বেশির ভাগকেই নিজ দলে নিয়ে জোট পাকিয়ে অন্য আরেক বড় ক্ষমতার উপর চড়াও না হয়; এটাই জাতিসংঘ গড়ার সময়ের মুখ্য বিবেচনা ছিল। যেমন আমেরিকা যেন কমিউনিস্ট স্তালিনের সোভিয়েন ইউনিয়নের উপর কোন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোন কিছু চাপিয়ে না দিতে পারে তা নিশ্চিত করা এমন প্রতিষ্ঠানই হল ভেটোক্ষমতার জাতিসংঘ। এটাই নিশ্চিত করার উপায়ের নামই ভেটো পদ্ধতি। যাদের “এভিন্ন” অন্যভাবে বুঝ থেকে ভুল ধারণা আছে তারা এখনই তা কারেক্ট করে নিতে পারেন। সোজাকথা জাতিসংঘ কোন সাম্যের প্রতিষ্ঠান নয়। ্তাই এর সব সদস্যের ভোটের ক্ষমতা একরকম নয়। যেমন এমন ক্ষেত্রে মানে কোন সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে কোন সিদ্ধান্ত এই পাঁচ ভেটোসদস্যের উপর চাপিয়ে দেয়া অসম্ভব।  যেমন, এমন হলে একা সোভিয়েত-ইউনিয়ন নিজের ভেটোটা প্রয়োগ করতে পারবে।  যার মানে হল, স্টালিন যা চায় না তেমন প্রস্তাব নিয়ে পরিষদে কোন আলোচনাই হবে না। সেক্ষেত্রে, আমেরিকা তখন আনা আগের প্রস্তাব চাইলে আবার তা সংশোধন করে হাজির করতে পারবে। তবে কীভাবে প্রস্তাব লিখলে পরে সোভিয়েতরা আর ভেটো দিবে না সেভাবে জেনে প্রস্তাব সংশোধন করে আবার তা উপস্থাপন করতে পারে। এভাবেই ভেটোক্ষমতা কার্যকর আছে।

মুখ্য বুঝাবুঝির জায়গাটা হল জাতিসংঘ গড়ার উদ্দেশ্য কী ছিল, সেখানে ফোকাস করাঃ
তাহলে জাতিসংঘ গড়ার উদ্দেশ্য কি ছিল? উপরের কথা থেকে পরিস্কার এটা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কোন ‘সাম্যের’ পার্লামেন্ট ধরনের কিছু নয়ই। এর উদ্দেশ্য ছিল ‘নেতা’ রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা ও নানাবিধ চিন্তায় বিভিন্নতা থাকা সত্বেও তারা একটা ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ কায়েম করতে পারে কিনা সেই চেষ্টা। এবং কোনমতে তারা সেতা পেরেছিল। আর এরই উদ্যোগ ও মুখ্য আইডিয়াটা ছিল মূলত আমেরিকার মানে ততকালীন টানা চারবারের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট-এর।

তাঁর মূলকথাগুলো খুব সিম্পল। সেকালে (১৬০৭-১৯৪৫) দুনিয়া মানে চার-পাঁচটা রাষ্ট্র তারা দুনিয়ার বাকি দেশ-ভুখন্ডকে কলোনি করে রেখেছিল – আর জবরদস্তিতে শাসন ও লুট করে সম্পদ নিজ দেশে নিয়ে চলছিল। আমেরিকা এই স্টাইলে চলা দুনিয়াটার অবসান চেয়েছিল তবে নিজ স্বার্থে; মানে “দুনিয়ার ভাল হবে” ঠিক এমন কোন কারণে না। তাই এনিয়ে আমেরিকার মূল ভাষ্যটা হচ্ছে – দেশভুখন্ড ও তার বাসিন্দা কেন্দ্রিক; যেখানে আবার বাসিন্দারাই মূল ফ্যাক্টর ও নির্ণায়ক। বলা হয়েছে, “কোন ভুখন্ডের বাসিন্দারাই একমাত্র নির্ধারক হবেন যে তাদের বসবাসের ভুখন্ড কার হাতে শাসিত হবে” 

Third, they respect the right of all peoples to choose the form of government under which they will live; and they wish to see sovereign rights and self government restored to those who have been forcibly deprived of them;

স্বভাবতই বাসিন্দারা কেউ বিদেশি কলোনি শাসক বা লুটেরা শাসক চাইবে না। অর্থাৎ এই মূল বাক্যটাই দুনিয়া থেকে সব কলোনি শাসন উতখাত করার রাস্তা খুলে দিয়েছিল। আর এই মূল বাক্য বা শর্ত মানলে তবেই আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পক্ষ ও অংশগ্রহণ করবে; এই ছিল আমেরিকান অবস্থান। কবে থেকে কতদিন?  এখানে বলে রাখা ভাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সালে শুরু হলেও ১৯৪২ সালের জানুয়ারির আগে আমেরিকা তাতে কোন অংশ বা পক্ষ নেয় নাই। এনিয়ে যদিও কমিউনিস্টদের না-জানা এক প্রপাগান্ডা ব্যাখ্যা আছে। সেই অনুমিত প্রপাগান্ডাটা হল, আমেরিকা ব্যবসা করার লোভে যুদ্ধে কোন পক্ষ নেই নাই। এটা শতভাগ মিথ্যা অনুমান তা জানা যাবে যখন  পরে ১৯৪১ সালের আগষ্ট থেকে আমেরিকা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সাথে চুক্তি (আটল্যান্টিক চার্টার চুক্তি) করেছিল। এই চুক্তি থেকেই পরিস্কার রুজভেল্ট কেন যুদ্ধে যোগ দিতে দেরি করছিল্বেন। আর এই চুক্তি থেকেই বিশ্বযুদ্ধে জোটবদ্ধ দুই পক্ষ-বিপক্ষ স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। আবার আমেরিকার অর্থনীতিক সক্ষমতা দিকটা যদি দেখি, এর প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই ততদিনে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির বৃটিশ কলোনি সাম্রাজ্যকে আমেরিকা ছাড়িয়েছে । ফলে সঞ্চিত সারপ্লাস সম্পদের কারণে যেকোনদিকে বিনিয়োগ সক্ষমতায় সে আনপ্যারালাল। তাই ঐ যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণে অনেক আগে থেকেই আমেরিকা ছিল নির্ধারক; অথচ ১৯৪২ সালের ১জানুয়ারির আগে সে কোনদিকের হয়ে যুদ্ধে নামে নাই।

তাই প্রথমে ১৯৪১ সালের আগষ্টে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে তিনি তাঁর শর্তে দাসখত দিতে [আটল্যান্টা চার্টার চুক্তির মাধ্যমে] বাধ্য করেন। আর আটল্যান্টা চার্টার চুক্তিই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান মিত্রপক্ষ জয়লাভ করলে পরের সেই  দুনিয়া থেকে কলোনি দখল ও শাসন চির উচ্ছেদের প্রথম দলিল। একারণেই হিটলারবিরোধী যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ সাজানোও আসলে সম্পন্ন করা হয় ঐ একই শর্তে। এরই ফলাফল হল, সাড়ে চারমাস পরে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি, ঐ একই দলিলের ড্রাফটে কিন্তু এবার রুজভেল্ট ও চার্চিল ছাড়াও আরো দুই দেশের প্রধানকর্তা এতে স্বাক্ষর দিচ্ছেন। এরা হলে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টালিন আর চীনের প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইসেক (নতুন দুজন, ব্যক্তি হিসাবে নয় তারা প্রতিনিধি পাঠিয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন)।  আর এই চারদেশের স্বাক্ষরের দলিলটাই হল জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণার দলিল বা ডিক্লারেশন [Declaration by the United Nations, January 1, 1942] । যদিও পরে অন্যান্য প্রায় ২১টা দেশ এতে প্রতিস্বাক্ষর করেছিল।
এদিনে রুজভেল্ট যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের কথা পরিস্কার করেন। তাঁর পক্ষের দেশগুলোর নাম দেন “মিত্র-শক্তি” যা্দেরকে পরবর্তিতে তিনি “ইউনাইটেড নেশন্স” (UNITED NATIONS বাংলায় জাতিসংঘ) বলে চিহ্নিত করেছেন। আর বিপক্ষ অক্ষশক্তি বলতে হিটলারের জর্মানি সাথে ইটালি ও জাপান এভাবে।

কিন্তু তখন থেকেই জাতিসংঘ কী কেন – মানে কী ভিত্তিতে এটা গড়ে উঠেছিল সেসব কথা ক্রমশ পিছনে চাপা পড়ে থেকেছে আর প্রধান হয়েছে হিটলারের বিরুদ্ধে জোট হয়েছে এই খবর। এতে জাতিসংঘের জন্মের খবর যতটুকু পড়ালেখা জানা লোকেরা জেনেছে তাও আবার তারা বুঝেছে একটা বিজনেস এসোসিয়েশন বা সমিতি যেমন [যেন একটা FBCCI] হয় তেমন কিছু এক তবে এটা যেন “রাষ্ট্র  সমিতি” বলে মনে করা হয়েছে। অথচ এর জন্ম ঘোষণা ভিত্তি সবসদস্যই মেনে নেওয়ার ভিত্তিতেই কিন্তু এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি সব সদস্যের সমান একভোট এই ভিত্তিতে নয়; বরং ভেটো পদ্ধতি।
সবচেয়ে কেন্দ্রীয় ঘটনাটা হল, এই  জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণার ভিত্তি হল দুনিয়া থেকে কলোনি উচ্ছেদ।  আর সেই সাথে তা এই অর্থে ও শর্তে তা লেখা হয়েছে যার আরেকটা মানে হয়ে গেছে এতে রাজতন্ত্রের কোন সুযোগ নাই। সদস্য রাষ্ট্রকে রিপাবলিক হতেই হবে। কারণ দেশ-ভুখন্ড এর বাসিন্দা যারা তারা নিজেরাই কথা বলবেন, সবকিছু নির্ধারণ করবেন। ফলে কলোনি দখলদার শাসকের সাথে রাজার ভুমিকাও বাদ হয়ে গেছে। এরা কেউ না হয়ে গেছে।

কিন্তু এত সমস্যার আরেক দিকটা খুবই জটিল হয়েছিল। তা হল সঠিক বুঝাবুঝি। এটা এমনকি জওয়াহরলাল নেহেরু যিনি স্বাধীন  ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী –  তিনিও জাতিসংঘ জন্মানোর ভিত্তিমূলক দিকটা বুঝেন নাই।  না, তাঁকে ছোট করার জন্য এটা বলা হচ্ছে না। যেমন দেখেন, এরই সবচেয়ে ভাল প্রমাণ হল, কাশ্মির ইস্যু। তিনি ভেবেছিলেন কাশ্মির কার – এই প্রশ্নে যেহেতু কাশ্মিরের রাজা হরি সিং নেহেরুর সাথে –ভারতভুক্তির- চুক্তি করেছেন অতএব কাশ্মির নিশ্চয় ভারতের অংশ হয়ে গেছে। এটা মনে করে তিনি এর স্বপক্ষে এই দাবির উপর  জাতিসংঘের সম্মতির সিল-ছাপ্পড় নিশ্চয় পেয়ে যাবেন মনে করে ঐ ভারতভুক্তি-পত্র জাতিসঙ্ঘের মতামত চেয়ে পাঠিয়েছেন। অথচ তিনি জাতিসংঘের জন্মভিত্তিই জানেন না যে সেখানে একটা দেশের হকদার-নির্ধারক কোন রাজা নয় বাসিন্দারা, তাদের গণ-সম্মতিকেই ভিত্তি মানা হয়েছে। ফলে নেহেরুকে ফেরত পাঠানো জাতিসংঘের রায় ছিল “কাশ্মিরে গনভোট আয়োজন করে সিদ্ধান্ত” নেওয়ার।  যা পরে তিনি কখনই এটা করেন নাই। আর সেই নেহেরু থেকে একালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর পর্যন্ত কারও জাতিসংঘ প্রতিষ্টানটা কী বৈশিষ্ঠের, কী উদ্দেশ্যের তা কখনই তাদের পড়ালেখা করা হয়ে উঠে নাই।

সম্প্রতিকালে জয়শঙ্করের বক্তৃতার এক ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়েছে। সম্ভবত তা ভারতের কোন এক একাদেমিক প্রতিষ্ঠানের যেখানে তিনি স্টুডেন্টদের –  ভারত কবে জাতিসঘের স্থায়ী বা ভেটোধারী সদস্যপদ পাবেন – এই প্রশ্নে কথা বলছিলেন। জয়শঙ্কর আমাদের বিসিএস-ক্যাডার দেয়ার মতই ভারতের সমতুল্য ফরেন ক্যাডারের লোক; সেখান থেকে পেশাদার কূটনীতিক জীবনের অবসরে, এখন মন্ত্রী হয়েছেন।  তিনি সম্ভবত নিজেকে স্মার্টভাবে হাজির করতে চেয়েছেন। তিনি এক কড়া শব্দ প্রয়োগ করেছেন সেখানে সমালোচনায়। শব্দটা হল জাতিসংঘের “ক্রেডিবিলিটি” [Credibility] কী আছে, ইত্যাদি। এখানে ক্রেডিবিলিটি বলতে এর বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা কী, এটা বলতে চেয়েছেন। তার মূল অভিযোগ জাতিসংঘ প্রতিনিধিত্বশীল নয়। শব্দটা অনেক কর্কশ এবং একই সাথে তার প্রতিষ্ঠানটার গঠন, উদ্দেশ্য ও ভিত্তি সম্পর্কে যে কোন ধারণা নাই সেটাও প্রকাশ করে দিয়েছে।

প্রথমত জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানের যে অঙ্গের কথা বলা হচ্ছে সেটা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বা সিকিউরিটি কাউন্সিল [UNSC] যেটা মূলত রাজনৈতিক বিষয়াদি দেখাশুনা করে।  শুরুতে বলেছি এটা মূলত ১৫ সদস্যের প্রতিষ্ঠান যার পাঁচটা ভেটোধারী সদস্যপদ আর বাকি দশটা অস্থায়ী (দুবছর) রোটেশনাল সদস্যপদ যা মহাদেশভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বশীল করে বেছে পূরণ করে নেয়া হয়ে থাকে। কাজেই এটা প্রতিনিধিত্বশীল করে সদস্যপদ গড়া হয় নাই এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।

তবে উনি সম্ভবত বলতে চাইছেন পাঁচ ভেটোসদস্যপদ এটা প্রতিনিধিত্বশীল করে গড়া নয় বা বিতরণ হয় না। হ্যা সে কথা সত্য এবং এটা গ্লোবাল জনসংখ্যার ভিত্তিতে বা কোন প্রতিনিধিত্বশীল ভিত্তিতে বেছে পাঁচসদস্যকে দেয়া হয় নাই। আসলে তা হতেই হবে এই অনুমানই ঠিক না, এটা ভিত্তিহীন। যেমন এই পাঁচ স্থায়ীসদস্যের মধ্যে আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার কখনই কেউ নাই। [এই প্রতিনিধিত্বশীল করার দিকটা সম্পন্ন ও নিশ্চিত করা হয়েছে অস্থায়ী সদস্যপদ নেয়া বা বিতরণের বেলায়। ] আবার চীনকে নেয়া হয়েছে এর জনসংখ্যা ভারতের চেয়েও অনেক বেশি একারণেও না। কাজেই জাতিসংঘের জন্ম ইতিহাস না জেনে এমন অনেক কথাই বলা যায়।
মূলত ভেটোসদস্যপদ দেয়া হয়েছে কারা ততকালীন সময়ে সামরিক সক্ষমতার দিক দিয়ে বড় বা পরাশক্তি এদের কথা ভেবে (তাও চীনের বেলায় সেটাও নয়)। সামরিক বা পরাশক্তি বলে বিবেচনা করতে হয়েছিল রুজভেল্ট-কে। সেটা এজন্য যে পুরা জাতিসংঘের আইডিয়াটা রুজভেল্টের। তার এই আইডিয়াটা বাস্তবায়নে এরা যাতে বাধাগ্রস্থ না করে সেকথা ভেবেই।

সাধারণভাবে বললে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে খরচ (সোভিয়েন ইউনিয়ন-সহ সকল পক্ষশক্তিকে) এককভাবে যোগানো এমনকি যুদ্ধপরবর্তি পুনর্বাসনের শিল্প ও অবকাঠামোতে অর্থবিনিয়োগ এবং তা যুদ্ধের হেরে যাওয়া পক্ষের দেশগুলোকেও সহায়তা দেয়া সহ – দিয়েছিল আমেরিকা। সেকালের আমেরিকার একক সামর্থ ছিল বলেই তা থেকে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য সব বিবেচনার উপরে উঠে যায় যা একটা কঠিন বাস্তবতা হয়ে দাড়িয়েছিল।

আরও আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তো বটেই দুই বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই আমেরিকা দুনিয়াকে যুদ্ধের বাইরে নিয়ে যাওয়া মানে, – যুদ্ধ এড়িয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধগুলো মীমাংসার কোন উপায়, কোন রাজনৈতিক মৌলিক বক্তব্য অবস্থানের ভিত্তিতে – এক প্রতিষ্ঠান – গড়ে তুলে তা করা যায় কীভাবে এটা আমেরিকার মাথায় সবার আগে এসেছিল। তখনকার আমেরিকান সমাজ এধারণা প্রচলিত হয়ে উঠেছিল যে কোন যুদ্ধই মূলত দেশের পুঁজি বা সঞ্চিত সম্পদ ধংস করে দেয়; তাই এটা এড়ানোর উপায় খুঁজতে হবে। মনে করা হয় যে আমেরিকানরাও মূলত সাদা ককেশীয় হলেও তাঁরাও এশিয়ায় আমাদের মত এক শ্রেণীর বৃটিশ কলোনি শাসকের অধীনে শাসিত নিষ্পেষিত। আমেরিকান ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা বলতে বৃটিশসহ অন্যান্য ইউরোপীয় কলোনি শাসকের থেকে সামরিকভাবে লড়াই করে মুক্ত হওয়া ছিল।  ফলে অন্য কাউকে কলোনি করার বিরুদ্ধে এক শক্ত অভ্যন্তরীণ জনমত পরবর্তিতে আমেরিকান-সমাজে কাজ করত, সক্রিয় ছিল। তাই ল্যাটিন আমেরিকান অনেক ছোট দেশ দুতিন বছরের বেশি পরবর্তিতে আমেরিকা সেখানে কলোনি দখল চালিয়ে রাখে নাই, বা পারে নাই। এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের আমেরিকাি আবার  প্রচুর সঞ্চিত সারপ্লাস (আজকের চীনও যেদিকে আগাচ্ছে) ছিল বলে এটাই বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকাকে নেতৃত্বের আসনে বা কমান্ডের পজিশন সহজেই পেতে সাহায্য করেছিল।

তা সত্বেও যে জাতিসংঘ আমেরিকা প্রস্তাব করছিল তা না মানতে চাওয়ার সামর্থ তো কেবল তখনকার বিচারে তখনও যারা সামরিকভাবে সক্ষম এমন রাষ্ট্রগুলোকেই বুঝতে হবে। এই বিচারে এদের জন্য ভেটোসদস্য পদ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন রুজভেল্ট। যাতে সামরিকভাবে সক্ষম বা পরাশক্তি দেশগুলো প্রস্তাবিত জাতিসংঘের ভিতরেই ধরে রাখা থাকে। নইলে জাতিসংঘ আইডিয়া কখনই কার্যকর হতে পারত না।
মানে রাখতে হবে স্তালিন ছিলেন রজভে্লটের জাতিসংঘ আইডিয়ার প্রথম বিরোধিতাকারি। তাকে ঠান্ডা করতে বা তার ভয় দূর করতেই রুজভেল্ট ভেটো আইডিয়াটা আনেন। যার মূলকথাটা হল, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আমেরিকা যেন পরাশক্তি অন্য দেশগুলোর উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার মতলবে জাতিসংঘ গড়ার কথা বলছেন না, সেটা স্পষ্ট রাখা যায়; তাদের আস্থা আসে। এই বিচারে এই পাঁচ সদস্যপদ কোন বিজনেস এসোসিয়েশন সমিতি বা এফবিসিসিআই এর মত নয়; সাম্যও নয়। বরং একেবারেই বিশেষ। এদিকটা না বুঝলে জাতিসংঘ কেন বা কীরকম তা জানা যাবে না।

এমনকি আগামিতে জাতিসংঘের সংস্কার বা পুনর্জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক না; বিশেষ করে গ্লোবাল নেতৃত্ব (শুধু গ্লোবাল অর্থনৈতিক না রাজনৈতিকও) বদল এলে সেটাই একমাত্র জাতিসংঘের অন্তত ওরিয়েন্টেশনে তো বটেই আরো বহু খোলনলচেও বদল আসাটা অসম্ভব নয়।  তবে ভারত সবসময় যে কল্পনাটা করে এসেছে তাতে ধরে নেয়া থাকে যে আমেরিকা আজীবন যেন নেতা আছে থাকবে। ফলে জাতিসংঘের (কোন সংস্কারেও) আসন বন্টনের ক্ষমতা যেন আমেরিকার একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে থাকবে!!! যেটা এখনও না, আগামিতেও হবে না।
সে যাই হোক, জাতিসংঘের কোন নিয়মটা কেন ওরকম বা সেরকম তা বুঝতে চাইলে জাতিসংঘ জন্মকালীন পটভুমিতে রূজভেল্ট কী কী ব্যবহারিক সমস্যার মোকাবিলা করে আগাতে হয়েছে তা বুঝতেই হবে। নইলে কোনকিছুই বুঝা প্রায় অসম্ভব! এমনকি আগামিতে জাতিসংঘের কোন পরিবর্তনে কী কী হতে পারে সে তা ইমাজিন করা সহজ হবে!!
আবার পুরানা কথায় ফিরে যাই।  মুলকথা, সেকালে রুজভেল্ট ভেটোসদস্যপদ দিয়েই রাশিয়া, বৃটেন, ফ্রান্সকে রাজি করিয়েছিলেন। ফলে আগামি দিনেও এমন কতকিছু দিয়ে হয়ত চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বি বা সহযোগীদেরকে সামলাতে হতে পারে।
আবার লক্ষ্য করতে হবে সেকালে আমেরিকাকে মানে রুজভেল্টকে  চীনের ব্যাপারটা  আলাদা করে বিশেষ সুবিধা দিতে চেয়ে আলাদাভাবে চেয়ে নিতে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে রুজভেল্টের যুক্তি ছিল তিনি এশিয়ায় হিটলারের একমাত্র বন্ধু  জাপান যে পরাজিত করেছেন বটে তা হয়ে গেলেও এর পুনরুত্থান ঘটতে পারে বলে আমেরিকা ভীত ছিলেন। আর কলোনি দখলদার জাপান ছিল উভয় কোরিয়া আর চীনের (কিছু অংশের) দখলদার। তাই বিশ্বযুদ্ধ পরের পরিস্থিতিতে জাপানের বিপরীতে চীনকে এক বিশেষ শক্তি হিসাবে উঠিয়ে আনতে রুজভেল্ট  এশিয়ার একমাত্র চীনকে ভেটোসদস্যপদ দিতে বাকিদের রাজি করিয়েছিলেন। যদিও কাজটা কঠিন ছিল না কারণ –  রাশিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স এরা নিজেরা নিজেদের ভেটোসদস্যপদ পাবার পরে আর কোনদিকে আপত্তি তুলতে আর আগ্রহি ছিল না।

তাই জন্মগঠন ইতিহাস সে সময়ের পরিস্থতি ও বিবেচনার ফ্যাক্টরগুলো কী কী ছিল তা না জেনে একালে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে তো অনেক কথা বলাই যায়। তাতে জয়শঙ্করের মত দেশের ভিতরের  অনেক হাততালিও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এগুলো আসলে নিজেরই অজ্ঞতা আর ইতিহাসবোধের অভাবই নির্দেশ করে এমন হয়ে যেতে পারে।

তবে, এককথায় বললে, আমেরিকা বা রুজভেল্টের সঞ্চিত সম্পদ ব্যয় করার সক্ষমতা মূলত এটাই আমেরিকার হাতে দুনিয়া নতুন করে উঠে দাড়াতে ও আমেরিকান বক্তব্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

তাই আজকের মোদির ভারতের জয়শঙ্করের জন্য একটাই বিকল্প হল, ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখানো। এটাই একমাত্র তাদের ভারতের ইচ্ছামত এক নয়া জাতিসংঘ তারা গড়ে নিতে পারলে হয়ত পারতেও পারে। আবার তখনকার “বাকিরা” তাতে রাজি হবে কিনা তাদেরকে রাজি করাতে ভারতকে কী কী নয়া প্রস্তাব দিতে হবে সেজন্যও ভারতকে বা জয়শঙ্কদেরকে রেডি থাকতে হবে। এরপরে তখন হয়ত তারা বুঝতে পারবেন কেন স্থায়ী ভেটোসদস্যপদগুলো দেশের ‘জনসংখ্যা আনুপাতিক’ ভাবে বেছে নেওয়া হয় নাই।

আবার ধরেন,  না-বুঝা লোকেদের নিয়ে চলতে সমস্যা অনেক। জয়শঙ্কর অনেকবার ঐ বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন ভারত তৃতীয় বড় অর্থনীতির দেশ। একবার বলেছেন “এমন একদিন আসবে”। সেটা আসুক আগে, তাই না!!! এপর্যন্ত ইকোনমিক বা স্টাটিস্টিক্যাল ডাটা নিয়ে স্টাডির ফোরকাস্ট হল সেটা ২০৫০ সাল নাগাদ হলেও হতে পারে। তাহলে এর ত্রিশবছর আগেই এজন্য হুড়োহুড়ি কেন?

আবার মোদির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সর্বনিম্ন। এটা ভারতের মুসলমান কুপিয়ে কতটা কী ঢেকে রাখা যাবে? ভারতের “হিন্দুত্ববাদ” এই রাজনীতিই এটা চলতে থাকলে তা ভারতকে যতটুক্তু সম্ভাবনা আছে সেতাও হতে দিবে না।  বারবার এমন কোন অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণ হতে দিবে না।

আবার এটাকে তামাসাই বলতে হবে যে, জয়শঙ্করেরও ধারণা আমেরিকার সমর্থনে তিনি ভেটোক্ষমতা পেতে চান বা পাবার উপায় দেখেন। এটাও জাতিসংঘ না বুঝার আরেক প্রমাণ। কারোণ বর্তমান এই জাতিসংঘের মধ্যে চীনের হাতে ভেটোক্ষমতা আছে ফলে আমেরিকার যেকোন সমর্থনের বিরুদ্ধে চীনা এক ভেটো ভোটই সব আশা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এটা তো জয়শঙ্করের না বুঝার কিছু নাই?? যার মানে  ভারতকে কেবল আমেরিকাই না অন্তত চীনের কাছেও প্রিয়পাত্র হতে হবে। কিন্তু ভারত তো মনে করে নিজেকে নিজে নিজেই “পরাশক্তি” ঘোষণা দিয়েই সব সমস্যা মোদি মোকাবুলা করতে পারবেন।

অতএব জয়শঙ্করের ভারতের প্রথম কাজ হল, জাতিসংঘের জন্ম উত্থান নিয়ে স্টাডি করা। সাথে অন্তত ১৯৩৩-৪৫ এই সময়কালে পাশ হওয়া আমেরিকান আইন যেগুলো গ্লোবাল প্রভাবের জন্য তৈরি হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে স্টাডি করা। এর আগে চাপাবাজির মুখ খুললে বারবার বেইজ্জতি হতে হবে!!

গ্লোবাল নাকি জিওঃ
এটা আসলে হল, গ্লোবাল ফেনোমেনাকে না বুঝতে পেরে একে জিও বলে ডাকাডাকি!!
এলেখায় অনেকবার “গ্লোবাল” শব্দটা ব্যবহার করেছি। এর অর্থ-তাতপর্য বুঝতে হবে। এই শব্দের উত্থান হয়েছে ১৯৪৫ সালের পরে।  আর ব্যতিক্রম কিছু ছাড়া প্রায় সবাই গ্লোবাল শব্দটার (যেমন গ্লোবাল পলিটিক্স বা গ্লোবাল ইকোনমি ইত্যাদির) বদলে ব্যবহার করে জিও (geo) যেমন জিও পলিটিক্স  শব্দটা ব্যবহার করে থাকে। আবার বুঝা যায় তারাও এই ব্যবহারে সন্তুষ্ট না, এক অস্বস্তি আছে তাদের মধ্যে।
এক। উতপত্তি কাল হিসাবে দেখলে জিও-এই ধারণার উদ্ভব ও চর্চার শুরু (১৯১৮-৩৯) মানে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টাতে। এটাই ব্রিটানিকার ধারণা অনুসারে।
আর এর বিপরীতে আইএমএফের জন্মের (১৯৪৪) পরেই কেবল সম্ভব হয়েছে গ্লোবাল পলিটিক্স বা গ্লোবাল ইকোনমি ইত্যাদি ধরণের ধারণাওগুলোর।

জিও দিয়ে যেকোন ধারণা (যেমন জিও-স্ট্রাটেজি বা জিও-পলিটিক্স) এদের মুল বক্তব্য জিও মানে কোনদেশের ভৌগলিক অবস্থান যখন ফ্যাক্টর, নির্ধারক উপাদান। এজন্যই জিও [Geo-, জিওগ্রাফি থেকে]এসবই হল জিও+ ।
আর আইএমএফ এর জন্ম মানে হল গ্লোবাল বা দুনিয়াব্যাপী যখন বাণিজ্য সম্ভব হয়েছে – ফলে গ্লোবাল অর্থনীতি বলে কোন ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। শুধু তাই না। যখন গ্লোবাল অর্থনীতির কারণে সবকিছুর গ্লোবাল ভার্সান দেখতে পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

কাজেই গ্লোবাল ধারণার বিকল্প কখনই জিও+ (জিও-পলিটিক্স)  হতেই পারে না।

আর সবশেষে আসল সত্যি কথাটা বলে ফেলা যাক। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকান নেতৃত্বের কারণে সবকিছু গ্লোবাল হয়ে উঠতে চাচ্ছে। ততদিন এর বাধা ছিল দুনিয়াজুড়ে থাকা কলোনি দখল-শাসন সম্পর্ক। যেটাকে একমাত্র আমেরকাই উচ্ছেদ করে দিয়েছে; বাধ্য করেছে। আসলে (১৯১৮-৩৯) মানে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টাতে – এটাই ছিল আসলে দুনিয়া গ্লোবাল হয়ে উঠা, গ্লোবালি সম্পর্কিত হয়ে উঠার (গ্লোবাল বাণিজ্যের মাধ্যমে) আগমন বার্তা দেওয়ার কাল। আর সেটাকেই না বুঝতে পেরে ভুল করে জিও বা ভৌগলিক অবস্থান ফ্যাক্টর বলে মনে করা হয়েছিল। এককথায় তাই,  জিও বা ভৌগলিক অবস্থান ফ্যাক্টর বলে অনুমান এটা এক ভুল ধারণা। “গ্লোবাল” ফেনোমেনাকে বুঝতে না পারার খামতি। ভবিষ্যতে বিষয়টা নিয়ে আরো বিস্তার করে লিখার আগ্রহ রেখে আপাতত শেষ করছি।

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s