চীন-ইন্ডিয়া সম্পর্ক কী ঘনিষ্টতা দিকে; এর কী কোন ভবিষ্যত আছে?


চীন-ইন্ডিয়া সম্পর্ক কী ঘনিষ্টতা দিকে? এর কী কোন ভবিষ্যত আছে?
গৌতম দাস
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫   রাত ২৩ঃ ৪৩
https://wp.me/p1sCvy-6wP

 

A united front at Beijing’s massive military parade as Xi, Putin and Kim meet for first time

 

শেষের কথাটা আগেই যদি বলি তবে এই শিরোনাম-প্রশ্নের ছোট জবাব হল, না। সম্পর্ককে গভীর ঘনিষ্ঠতা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া মোদির ইন্ডিয়ার পক্ষে সম্ভব হবে না। এত পিছনের মূল কারণ, ইন্ডিয়ার নিজ দোদুল্যমানতা। আসলে বলতে গেলে ইন্ডিয়া এমনই। যেমন তারা বলে বা মনে করে থাকে (সেই ২০১৩ সাল থেকে) যে চীন আর আমেরিকার মাঝে দোল খেয়ে কখনও চীন আর কখনও আমেরিকা এভাবে ভাব ধরে এদের দুদিক থেকেই মাখন খেয়ে যাওয়াই হবে ইন্ডিয়ার কৌশলগত নীতি। এটা তো তাদের ২০১৩ সালের সিদ্ধান্ত, যখন ইন্ডিয়া চীনে অনুষ্ঠিত প্রথম বেল্ট-রোড সম্মেলনে দাওয়াত পেয়েছিল, কিন্তু অংশ না নিয়ে নিজেদের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; তখন থেকেই ইন্ডিয়া এরকমই দায়দায়িত্বহীন সুবিধা চোষা! ঠিক এ কারণেই এখনকার ট্রাম্পের শুল্ক-বোঝায় পর্যুদস্ত ও মার খাওয়া ইন্ডিয়া এতকিছুতে নাস্তানাবুদ হয়েও আবার ইতোমধ্যেই ওই ট্রাম্পের কোলেই ফিরে গিয়ে আবার আশ্রয় খোঁজা শুরু করেছে; আর তাতে বলাই বাহুল্য, এতে এই ইন্ডিয়া এখন চীনের আস্থা অর্জন পর্যন্তই উঠতে পারছে না, পারবে না।

এবার আস্তে আস্তে ঘটনাবলির ভিতরে প্রবেশ করা যাক। এটা একদম ঠিক যে এখন চীন- ইন্ডিয়া সম্পর্ক-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা তুঙ্গে। এর একটা অন্যতম কারণ হল, ঠিক এখনই এবারের বার্ষিক SCO এসসিও (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন) সম্মেলনের সময়কাল এটা। ফলে  ট্রাম্পের আমেরিকার  সদ্য ছুড়ে ফেলে দেওয়া মোদির ইন্ডিয়াকে, একেও চীন এবারের এসসিও-তে আন্তরিকভাবেই দাওয়াত দিয়ে কাছে ডেকে নিয়েছিল।

পাশাপাশি সেই সঙ্গে এই ট্রাম্পও প্রায় সব দেশের ওপর কঠোর শুল্কনীতি প্রয়োগ করেছেন। শুরুতে তা চীনের ওপর ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনকে শুল্ক-আরোপ করে পর্যুদস্ত করে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তাতে বাস্তবে ফলাফল উল্টা আসায় আর সঙ্গে আমেরিকার নিজস্ব সরকারি বন্ড বিক্রির ক্রেতা সংকট বা বাজারে ক্রেতা উধাও হওয়া শুরু হতেই ট্রাম্পকে পিছে হটতে হয়। তিনি বাধ্য হয়ে গত জুন মাসেই অনেক ইস্যুতে সরাসরি চীনের সঙ্গে এক ধরনের আপস করে ফেলেন।

অনুমান করা যায়, এ ঘটনা থেকেই চীন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবারের এসসিও সম্মেলনটি বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ এক সামরিক শো-আপ করে করবেন!


SCO তে এবার সামরিক শো-আপ কেনঃ
অনেকেই খেয়াল করেছেন যে এই সামরিক শো-আপে সম্ভবত ২৬ দেশের প্রধান ব্যক্তিত্বদের (রাষ্ট্রপ্রধান নয়ত প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী অথবা ন্যূনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের) একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি হেঁটে যাচ্ছেন, যার দুপাশে হাঁটছেন একদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আর অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম-জং-উন!

এসবের মধ্যে আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রেসিডেন্ট শির ‘পোশাক’। তিনি পরেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ড্রেস, যেটা মাও – কেই সবসময় পরতে দেখা যেত। প্রেসিডেন্ট শি একালে নিয়মিত নরমাল পোশাক পরলেও সেদিন ছিলেন একেবারেই পার্টি ড্রেস-কোডে সজ্জিত! এসব থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, বিশেষ ‘অর্থ ও প্রতীকের’ মাধ্যমে এবারের এসসিও সম্মেলন পালন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল চীন।

গত বিশ বছর চীন সামরিক দিক থেকে কী কী খাতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে নিজেকে সজ্জিত করে চলছিল তা জনসমক্ষে আনেনি; এদিনটা ছিল আসলে সেটারই প্রদর্শনী ও মহড়া। যে মহড়ায় আবার বেশির ভাগ অস্ত্র-সরঞ্জামই হলো নিউক্লিয়ার এনার্জি-সংশ্লিষ্ট!

এখানে একটা কথা আশা করি অতি-উক্তি হবে না যে, এর ফলে এসসিও পারমাণবিক অস্ত্রের প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছিল ওদিনে। কিন্তু এমন কেন? বিশেষ করে অনেকেরই অজানা হয়ত যে চীন-চীন সাগর/দুই কোরিয়ার উপকূল এলাকাকে অ-পারমাণবিক জোন হিসাবে ঘোষণা করা যায় কিনা এরই একক প্রস্তাবক হল চীন নিজেই!

তাহলে এখানে এমন চীনা আচরণের ব্যাখ্যা কীঃ
মনে রাখতে হবে, কোনো রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ (যেখানে গ্লোবাল অর্থনীতির নয়া একালের অভিমুখ হল শুল্ক কমানো, ৮ শতাংশের মধ্যে রাখা) মানেই এটা হল আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য যেটা আসলে গ্লোবাল বাণিজ্যের বিকাশ মেন-স্ট্রিম অভিমুখ সেটাকে পাথর চাপা দিয়ে গ্লোবাল বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির পিঠে সরাসরি ছুরিকাঘাত! যেটা অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদিতা বা অর্থনৈতিক উগ্র-জাতীয়বাদিতা! সর্বোপরি এটা আত্মঘাতী! গত ১৯৮০ সাল থেকে পথচলা শুরু এই বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থায় এখন আর পিছনের দিকে ফেরা বা যেটা অর্থনৈতিক উগ্র-জাতীয়বাদিতা সেদিকে গন্তব্য ঠাউরানোর আর সুযোগ নেই। এতে সবার আগে নিজ রাষ্ট্রের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি!

ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কনীতির খাঁড়া – প্রত্যক্ষ অর্থ এটাই! যদিও ট্রাম্প ভাবছেন, আমেরিকাকে ছাড়িয়ে শীর্ষ উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ হিসাবে উঠে আসা চীনের অগ্রগতি এভাবেই তিনি ঠেকায় দিতে পারবেন! অথচ তিনি খেয়াল করছেন না, আমেরিকার পিছিয়ে পড়া বা একঘরে হয়ে যাওয়ার পথেই হাঁটছেন তিনি!

আর এ থেকে চীনের অনুমিত ভয় হল, ট্রাম্প হেরে গিয়ে শেষে পাগলামি করে না  যুদ্ধ লাগিয়ে দেন; অথবা ব্যর্থতা ঢাকার অন্য কোন ব্যর্থ চেষ্টা!

ফলে আমার অনুমান পাগলা ট্রাম্প যেন সেদিকে যেতে প্ররোচিত না হয়ে যান, তাই আগেই চীন নিজ সামরিক প্রস্তুতির প্রদর্শন করে রাখলেন। বিশেষ করে চীন যেন বোঝাতে চাইল, সামরিক দিক দিয়ে ট্রাম্প ও তার সহচররা পরিচালিত হতে যেন উৎসাহী না হয়ে যায়। আর সেটারই একটা কসরত – এক ইনডাইরেক্ট ফ্রি কিক – যেন মেরে রাখল চীন! যেমন প্রেসিডেন্ট শি নিজের দুপাশে রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়া নিয়ে দলবদ্ধ হাঁটার প্রতীকী অর্থ আমার কাছে এমনই মনে হয়েছে। যারা দুদেশ মূলত পারমাণবিক দিক থেকে খুবই সামরিক সজ্জিত!

এক কথায় এর প্রতীকী সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হল, পাগলা ট্রাম্পকে ডিসকারেজ (নিরুৎসাহিতার প্রভাব) করে ফেলা!

এবার এই আলোচনার দ্বিতীয় অংশঃ
অথচ চীন সেই সম্মেলনে ভারতকেও আদর করে ডেকেছিল আর তাতে গলে গিয়ে দীর্ঘ সাত বছর পরে এই ওছিলায় খোদ মোদি এবার চীন সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শির ওই দলবদ্ধভাবে প্রতীকী হাঁটার মিছিলে শির আশপাশে মোদির স্থান হয়নি।

বরং বিপরীত পর্দার কথা আমরা এখন জেনে গেছি। আমরা দেখেছিলাম মোদির বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গোয়েলকে! কী করেছেন তিনি?

ভেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি, ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী

তিনি আমাদের জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সঙ্গেই ইন্ডিয়ার শুল্ক আলাপ নাকি এখনো চলছে। আর তিনি আশা করছেন, মোদির ইন্ডিয়া আবার সেই ট্রাম্পের কোলেই মুখ গোঁজার পরিকল্পনা করছে। আর তাতে তিনি দাবি করেছেন, নভেম্বরের মধ্যেই আমেরিকার সঙ্গেই আবার একটা রফায় পৌঁছাতে পারবেন!

এই হলো ভারতের মোদি! তিনি ট্রাম্পের কোলে উঠে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে চীনের কাছে সুবিধা চাইবেন, আবার পরক্ষণেই চীনের কোলে উঠে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ট্রাম্পের কাছে সুবিধা ভিক্ষা করবেন। এভাবেই তিনি এখনো চলতে চান, এটাই আসল ইন্ডিয়া! গত ২ সেপ্টেম্বর ভারতের ‘ফরচুন ইন্ডিয়া’ পত্রিকার রিপোর্টের শিরোনাম পীযুষ গোয়েল আশা করছেন, আগামী দুমাস নভেম্বরের মধ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে একটা রফাতে নয়া শুল্ক-চুক্তিতে পৌঁছানো যাবে!

কিন্তু বাস্তবতা কি তাই হবে? মনে হচ্ছে না। মূল কারণ এটা ২০১৩ সাল নয়, ২০২৫ সাল! চীন-আমেরিকা দুদিক থেকেই সেকালের মতো মাখন খেয়ে ভারত উপরে উঠে যাবে – সেই তত্ত্ব, এখন আর এত সহজে খাটবে না। এটারই প্রথম প্রতিফলন হল,

মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রীর ভারত দুই মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ক্ষমা চাইবে

আর দ্বিতীয়তঃ
প্রেসিডেন্ট শি দুপাশে পুতিন আর কিমকে নিয়ে হাঁটছেন অথচ আশপাশে মোদির কোনো ছায়াও দেখা যাচ্ছে না- এই প্রতীকী দৃশ্যে!

 

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

আপডেটঃ   ১১  সেপ্টেম্বর ২০২৫    রাত ১১ঃ ৫৪

[এই লেখাটা এর আগে প্রথম ভার্সানে ছাপা হয়েছিল দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমারই লেখা এক কলাম হিসাবে, গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫।  আজ এখানে সে লেখাটারই  আরেক বর্ধিত এক নয়া এডিটেড ভার্সান এখানে আমার নিজ সাইটে ছাপা হল। বলাই বাহুল্য এখানে শিরোনামটাই শুধু নতুন নয় বরং এমন অনেক প্রসঙ্গই নয়া এখানে যোগ করা হয়েছে যেটা পত্রিকার ভার্সানে ছিল না। আসলে পত্রিকার কলাম ভার্সান মানে যেটা যুগান্তরের এডিটরিয়াল পলিসি সঠিক মনে করে সেই ভার্সান; এভাবে দেখাটাই সঠিক হবে। আর তুলনায় এটা আমার নিজ পরিবর্ধিত-এডিটেড ভার্সান মনে করলেই সঠিক হবে বলে আমার বিশ্বাস! ]

Leave a comment