বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনায় …………


বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনায় …………
গৌতম দাস
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, মঙ্গলবার

http://wp.me/p1sCvy-2ah

বাংলাদেশ সর্বপ্রথম দুটা সাবমেরিন কিনে নিজের প্রতিরক্ষা নৌবহর সক্ষমতাকে কিছুটা ওপরের স্তরে উন্নীত করেছে। এগুলো চীননির্মিত। বাংলাদেশ তুলনায় ছোট অর্থনীতির মানে, তুলনা বিচারে স্বল্প রাজস্ব আহরণের রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্র যে বিপদে থাকে, তা হল নিজের  প্রাকৃতিক সম্পদ ও সীমানা সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করতে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম স্থায়ী সেনাবাহিনীর চাহিদা-খরচ পূরণে সব সময় টানাটানির মধ্যে থাকে। একারণে অর্থনীতি বড় ও সমৃদ্ধ হবার সাথে সাথে রাজস্ব আয় বাড়ে আর বহু জট খুলার রাস্তা দেখা যায়। সামরিক বাজেট বড় করার সক্ষমতা বাড়ে, পুরানা চাপাপড়া অভাব মিটানোর সক্ষমতা হাজির হয়। এছাড়া অর্থনীতি বড় হলে শত্রুও বাড়ে – সযন্তে রক্ষা করা মত নতুন অনেক স্টাটেজিক স্বার্থ (যেমন,  সমুদ্রপথে পণ্য আনা-নেয়ার প্রবেশপথ সুরক্ষা, সমুদ্র চলাচলের খোলা-জলরাশি (blue water) অবাধ রাখা ইত্যাদি) জলন্ত হাজির হয়ে যায় ফলে নতুন অর্থনীতিক সক্ষমতাসহ সবকিছুর সুরক্ষা এক বাড়তি প্রতিরক্ষা চাহিদা উপস্থিত হয়। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ইন্টেলেক্ট বা চিন্তাভাবনার জগত আস্তে আস্তে লায়েক হচ্ছে। আগের মত “আমাদের সেনাবাহিনীর কী দরকার” ধরণের  যে যেটা বুঝে না তা নিয়ে ফালতু কথা বলার চেষ্টা একেবারেই বন্ধ হয়ে না গেলেও অন্তত নিজেদের অযোগ্যতা খামতি অনেকেই বুঝতে পারছে বলেই মনে হয়। আবার সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে এই বয়ান যে কোল্ড ওয়ারের কালে আমেরিকার বিরুদ্ধে সোভিয়েত প্রপাগান্ডা বৈ অন্য কিছু ছিল না, বিষয়টা যে নিজের বিচারবুদ্ধি খরচ করে বুঝবার বিষয় তা সম্ভবত অনেকেই ইদানিং হুশে আসছেন। যদিও ব্যারাক-ভিত্তিক বাহিনীই প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তার একমাত্র উপায় নয়, জনগণ ও সেনাবাহিনীর দূরত্ব ঘুচানোর ভালো উপায় কী অথবা প্রতিরক্ষায় খরচ কতটা করা উচিত, তা কী কাজে লাগে ইত্যাদি নিয়ে প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় এখনও তর্ক-বিতর্ক আছে। তা পাশে সরিয়ে রেখেও বলা যায়- বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ ও সীমানা রক্ষার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জামনির্ভর একটা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করবেন। ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোয়, যাদের তা দেখে বোঝার কথা, তারা বুঝে গিয়েছিলেন- বিশেষ করে বিগতকালে বার্মা বা মিয়ানমারের সাথে আমাদের স্থলসীমান্তে টেনশন এবং সমুদ্রসীমানায় আমাদের অংশে ২০০৮ সালে মিয়ানমারের তেল অনুসন্ধানের কার্যকলাপে বাংলাদেশে বাধা দেয়ার সময় থেকে। ফলে অন্ততপক্ষে মিয়ানমারের সাথে পেরে ওঠার পর্যায়ে আমাদের বাহিনীগুলোকে উন্নীত করা একটা তাগিদ তখন থেকে ছিল। ইতোমধ্যে সমুদ্রসীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বিরোধ জাতিসঙ্ঘে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে এখন বলা হচ্ছে, এতে স্থলভাগের চেয়েও দ্বিগুণ বড় সমুদ্র-অঞ্চল এখন বৈধ আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবেই আমাদের ভাগে এসেছে। এগুলো বুঝেশুনে নেয়ার ও অন্তত ধরে রাখার কাজ সম্ভব করতে গেলে উন্নত নতুন স্তরে সশস্ত্রবাহিনীগুলোকে সাজানো খুবই প্রয়োজন। আরেক তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখযোগ্য দিক – বিকশিত হওয়া নতুন ঘটনা হল, বঙ্গোপসাগর নিয়ে আমেরিকা-চীন-ভারতের কাড়াকাড়ির টেনশন দিন দিন বাড়ছে। অনুমান করা যায়, সামনে আরো বাড়বে। এতে কারো দিকে ঝুঁকে না পড়া, কোনো পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষ থাকতে হলেও আর শুধু নিজের সীমানা রক্ষা করতে গেলেও ন্যূনতম সামরিক সক্ষমতা থাকা জরুরি। ফলে অনুমান করাই যায়, এসব প্রয়োজন পূরণের পরিকল্পনার অংশ হল সাবমেরিন কেনা। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি তা যতই অস্পষ্ট থাক না কেন তা আসলে কাউকে যেচে আক্রমণাত্মক নয়, নিজেকে সুরক্ষামূলক।
কিন্তু ভারত-চীনের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মিডিয়া সব সময় আধা সত্য-মিথ্যা মেশানো তথ্য আর উগ্র দেশপ্রেমের সুড়সুড়ি দিয়ে সবসময় ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে খামাখা উত্তেজিত করে রাখে। কারণ এগুলোই তাদের ভোটের বাজারকে প্রভাবিত করার দিক থেকে খুবই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উপাদান। অনেক সময়, এই ভোট-বাজারে দেখিয়ে বেড়ানোর নির্বাচনী স্বার্থে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বহু মন্ত্রী পর্যায়ের সফরও ঘটানো হয়। সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার ভাব টেনশন তৈরি করা হয় ইত্যাদি। ঠিক তেমনি, আমাদের সাবমেরিন ডেলিভারি পাওয়ার পর এর সাথে সম্পর্কিত ঘটনা নাকি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পাররিকর এর এবার বাংলাদেশ সফর। ভারতীয় বিশ্লেষকেরাই বলছেন, এমন সফর নাকি স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম। অনলাইন বাংলাট্রিবিউনে গত ১৬ নভেম্বর ভারতের সাংবাদিক রঞ্জন বসুর এ নিয়ে একটি আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। টিপিক্যাল আনন্দবাজারি প্রপাগান্ডা স্টাইলের এক রিপোর্ট এটা। পড়লে মনে হবে যেন, যা মনে চায় এমন মিথ্যা আর বাড়ানো-চড়ানো কথা বলে হাটে গামছা বেচতে এসেছেন। এর একটা নমুনা দেখুন, ঐ লেখার প্রথম বাক্য হল, “চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের নৌবাহিনী দুইটি সাবমেরিন হাতে পাওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে নতুন করে ঝালিয়ে নিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পাররিকর এ মাসের শেষে বাংলাদেশ সফরে যাবেন”। মনে হচ্ছে, পাররিকর আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোকে বকা দিতে আসছেন। আর যেন বকা দিয়ে বলবেন – ‘কী, তোমরা আমাদের না জানিয়ে সাবমেরিন কিনে ফেললে কেন?’। সেজন্য সাবমেরিন হাতে পাওয়ার ঠিক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পাররিকর এ দেশে আসতে হচ্ছে। আচ্ছা, এটা কি শিশুদের বাজারে  গিয়ে চুপে চুপে চকোলেট কেনা? তাই বড় ভাইয়ের বকা দিয়ে আসা? রঞ্জন বসু সাবমেরিনকে শিশুর চকোলেট কেনা ভেবেছেন! অথচ এটা সাবমেরিন – তাই কিনতে চাইলে অনেক আগে অর্ডার দিতে হয়। সে মোতাবেক ২০১৩ সালে এর অর্ডার দেয়া হয়েছিল। ফলে তখন থেকে দুনিয়াসুদ্ধ লোক যারা জানতে চায় সবাই প্রকাশ্যেই জানে এটা। তাই এ সাবমেরিন কেনা নিয়ে বাংলাদেশকে যদি জেনুইন কনসার্নে ভারতের কিছু বলার থাকে, তা তিন বছর আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশের সাবমেরিন হাতে পাওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছু নেই এখানে। তাহলে, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ বলে রঞ্জন বসু কী বোঝাতে চাইলেন? যেন বোঝাতে চাইলেন, ভারতের হুকুম ছাড়া বাংলাদেশের গাছের পাতারও নড়ার কথা নয়। সেই পাতা নড়ল কেন, এর জবাব চাইতে পারিকর এসেছিলেন।
রঞ্জন বসুর বোঝাবুঝির দৌড় হাস্যকর বললেও কম হবে। এ যেন রাস্তার ধারের চা দোকানে বসে আদার ব্যাপারীর আলাপের চেয়েও নিচু মানের। তিনি লিখছেন- “কিন্তু এ সপ্তাহের গোড়ায় চীন যেভাবে তাদের লিয়াওনিং প্রদেশের ডালিয়ান সমুদ্রবন্দরে সফররত বাংলাদেশের নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন আহমেদের হাতে দু’টি ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন তুলে দিয়েছে, তাতে ভারত মনে করছে পাররিকর এর সফর নিয়ে আর এতটুকুও দেরি করার কোনো অবকাশ নেই”। এখানে চীন ‘যেভাবে… সাবমেরিন তুলে দিয়েছে’- এই ‘যেভাবে’ কথার মানে কী? তাহলে, চীন সাবমেরিন বিক্রি করায় ভারতের অসুবিধা হয়নি; শুধু ‘যেভাবে… সাবমেরিন তুলে দিয়েছে’ তাতেই আপত্তি? ব্যাপারটা কি এ রকম? কিভাবে সাবমেরিন তুলে দিলে আপত্তি হতো না? এ ছাড়া পারিকরের আর ‘এতটুকুও দেরি করার কোনো অবকাশ নেই’- এ কথাটিরও মানে কী? চীন সাবমেরিন বিক্রি করে ভারতের নাকি ক্ষতি করে ফেলেছে, তাহলে পারিকর ‘এতটুকুও দেরি করার কোনো অবকাশ’ না রেখে বাংলাদেশে এলে কী হবে? বাংলাদেশ বকা খাবে? সাবমেরিন ফেরত দিয়ে দিতে ধমক দেবে? লেনদেন বিষয়ে একজন মুদি দোকানদারও যতটা বাস্তবজ্ঞান রাখেন, দেখা যাচ্ছে রঞ্জন বসু সেটাও রাখেন না।

সবাই জানে, এমনকি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরাও বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মনোবল বাড়ানোর জন্য বলে থাকেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে আজও ভারতের সমর্থন তাদের সরকারের পিছনে আছে; সেই সমর্থনে সরকার টিকে আছে ইত্যাদি। কিন্তু সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের সমর্থন লেনদেন এক জিনিস, আর তাকে বাংলাদেশের সামরিক ক্রয় সিদ্ধান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বলে বোঝানো, আরেক জিনিস। বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি বা বড় ধরনের সামরিক কেনাকাটা- এসব বিষয়ের পরিকল্পনা করা বা প্রস্তাব তোলা, এটা এখনো সিভিলিয়ান বা রাজনীতিকেরা করার, অভ্যাস বা চর্চা বাংলাদেশে শুরু হয়নি। কাজেই ভারতের ইচ্ছামত যদি আমাদের সামরিক ক্রয় সম্পন্ন হতে হয়, এর ফলাফল হবে জটিল ও মারাত্মক। বুদ্ধিমান মানুষ এ কথা মনে রেখে মুখ খুলার কথা। জনগণের ভোট বা সমর্থনে নয় ভারতের সমর্থনে সরকার টিকে আছে এর মানে তারা প্রতিরক্ষা ক্রয়ে হস্তক্ষেপ করা পর্যন্ত ক্ষমতাবান – এটা নিজেকে ওভার-এস্টিমেট করা। ফলে অতি-মুল্যায়নের বিপদ তাদের অজানা থাকার কথা নয়।
আরেক কঠিন সত্য হল, সাবমেরিন আমাদের (ভারতের কথিত জান-ই দুশমন) চীন থেকেই কিনতে হবে, ব্যাপারটা মোটেও সে রকম ছিল না। রাশিয়াও এর সাপ্লায়ার হতে পারত। কিন্তু রাশিয়ান কিলো সাবমেরিনের মূল্য এক বিলিয়ন ডলার চাওয়াতে এবং তার বিপরীতে চীনা অফার ৪৫০ মিলিয়ন হওয়াতে এটাই কেনা হয়।
তবে খুশির কথা, ভারতের সবাই রঞ্জন বসু নন। বাস্তব জ্ঞানবুদ্ধির লোক ভারতে কম থাকার কথাও নয়। তেমনই একজন এম কে ভদ্রকুমার। গত প্রায় ৩০ বছরের কেরিয়ার কূটনীতিক ভদ্রকুমার ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত। এখন অবসরে গিয়ে, বিভিন্ন দেশী-বিদেশী পত্রিকায় কলাম লেখেন। তিনি অনলাইন স্ক্রোল (Scroll.com) পত্রিকায় বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা নিয়ে এক আর্টিকেল লিখেছেন। বলা ভাল মন শয়তানিতে ভরপুর এমন কিছু ভারতীয় ডিপ্লোম্যাটকে তিনি যেন চাবকে দিয়েছেন। কথিত এসব পণ্ডিতদের চিন্তাভাবনার দুরবস্থাকে তিনি তুলোধুনা করেছেন। এদের বেশির ভাগই আসলে আমেরিকার ফান্ডে চালানো প্রতিষ্ঠানের কর্মী। এই ক্যাতাগরিতে আছে কিছু আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্কের ভারতীয় শাখা অথবা ভারতেই রেজিষ্টার্ড আমেরিকা ফান্ডেড এনজিও, অথবা আমেরিকার উচ্চ শিক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইত্যাদি ধরণের। এককথায় বললে এগুলো আসলে বেশির ভাগই ভারতের স্বার্থের কোন থিঙ্কট্যাঙ্ক নয়। এদের পিছনে আমেরিকা পয়সা খরচ করে ভারতের কিছু ইন্টেলেক্টদেরকে আমেরিকার চওখে চীন-বিরোধী করে সাজানো যাতে ভারতীয় নীতি আর শহুরে মধ্যবিত্তকে প্রভাবিত করা যায়। একই কথা বলতে বলতে তিতা করে ফেলা আমেরিকার শিখানো এদের ক্লিশে বয়ানটা হল – “চীন ভারতকে ঘিরে ফেলেছে”,  “মুক্তামালার মত চীন ভারতকে ঘিরে ফেলছে”। সব জায়গায় এরা ঘিরে ফেলা দেখে। যেমন মুক্তমালার মত ভারতের চারদিকে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে (পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও সম্ভাব্য বাংলাদেশ) চীন নাকি ভারতকে ঘিরে ধরার পরিকল্পনা করছে। এ’এক মহা আবিস্কার! এরা নিজের বোধশক্তি বুদ্ধি ব্যবহাস্র করা ভুলে আমেরিকার শিখানো চীন-বিরোধী বয়ান আউড়াচ্ছে। মনে মনে প্রবোধ নিচ্ছে তারা আমেরিকান স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষা করছে। কত রাজা উজির মারছে। একএকটা গভীর সমুদ্র বন্দর গড়তে আর নুন্যতম অনুষঙ্গি বিদ্যুতগ্যাস টার্মিনাল রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো  মিলিয়ে বিনিয়োগ লাগে কমপক্ষে ৫ বিলিয়ন থেকে ৫০ বিলিয়ন। সে খবর এদের আছে। তো এই বিনিয়োগ কী সামরিক স্টাটেজিক প্রজেক্ট নাকি পুরাপুরি বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক প্রজেক্ট? যেমন বাংলাদেশের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর কী  সামরিক স্টাটেজিক প্রজেক্ট? এমন স্বপ্ন-দোষ! এটা তো স্বপ্নে বা জ্ঞানতও ভাবা কী উচিত? এরা কী ভাত খাওয়া রক্তমাংসের মানুষ? কিন্তু আমেরিকা এমন মানুষই বানিয়েছে। অন্য আর একটা নমুনা দেখাই। এটা আমাদের সাবমেরিন কিনাতে ভারতের এক প্রাক্তন নেভি অভিসারের প্রতিক্রিয়ায় এক ম্যাগাজিন ডিফেন্স নিউজ-এ এমনই এক দিগগজ লিখছে, “নিঃসন্দেহে এই (সাবমেরিন) হস্তান্তর ক্লায়েন্ট রাষ্ট্রকে (বাংলাদেশ চীনের ক্লায়েন্ট মানে ধামাধরা রাষ্ট্র) দিয়ে ভারতকে ঘিরে ফেলারই চীনা স্টাটেজি” (“Obviously this transfer is a step further in China’s strategy of encircling India with its client states,” Prakash added.)।

যাহোক অনলাইন স্ক্রোল (Scroll.com) এর ভদ্রকুমারের কথায় ফিরে আসি। তিনি পাররিকরের সফর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এসব দিগগজদের পরোক্ষে জবাব দিয়েছেন। প্রথমত, তিনি পাররিকরের সফরকে ‘বিস্ময়কর’ বলছেন। এরপর বলছেন, ১. “বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেকারণে ভারত-বাংলাদেশ মিলিটারি টু মিলিটারি সম্পর্ক অবশ্যই ভাল হতে হবে এটা মোটেও অবশ্যম্ভাবী কোন ব্যাপার নয়। মুখ্যত এর দু’টি কারণ। “প্রথমত, আমাদের (মানে ভারতীয়দের) এক আজব ভুয়া ধারণা হল, পাকিস্তান আর্মির সাথে বাংলাদেশের আর্মি নাকি এক নাভীমূল নাড়ির সম্পর্কের সুতায় বাঁধা আছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ আর্মিও তাদের দেশের উপর ভারতের কালোছায়া ধরনের ইচ্ছা-মনোভাব সম্পর্কে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ধরণের এক সন্দেহ পোষণ করে”। এটা ফ্যাক্টস। “আসলে দুটা রাষ্ট্রের মধ্যে এ ধরনের মানসিক বাধা বা দূরত্ব কাটাতে সময় লাগে। তাহলে পাররিকরের এই সফরের মানে কি, সেই ‘কালোছায়া’ কেটে গেছে?” – ভদ্রকুমার প্রশ্ন রেখেছেন।
আসলে ভদ্রকুমার নিজ দেশের অনেকের মুখের ওপর অনেক কথাই খাড়াভাবে বলেছেন। এর মূল কারণ সম্ভবত তিনি আমেরিকান সাপোর্টেড কোন থিঙ্কট্যাঙ্কের কেউ নন। তবে  এরপরেও যেসব কথাগুলো কোন কারণে তিনি বলেননি তা হল –

রাষ্ট্রতত্ত্ব বলে, কোন রাষ্ট্র মানেই  তার নিজ জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে ঐ রাষ্ট্রের বাইরের সবার স্বার্থের ওপরে বলে মনে করা হয় যেখানে। ফলে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থ অন্য সব রাষ্ট্রস্বার্থের চেয়ে উপরে প্রাধান্য পাবে – এই ভিত্তিতেই কেবল কোন রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, থাকে। তাহলে দুই দেশের মিলিটারি টু মিলিটারি কোন ভাল সম্পর্ক মানে কী? এটা অ্যাবসার্ড, সোনার-পাথর বাটি ধরণের এক আকাশকুসুম। অথবা বড়জোড় একটা ডিপলোমেটিক (বলে এক মানে হয় আর এক) ধরণের কথা। দু’টি আলাদা রাষ্ট্রস্বার্থের মধ্যে বড়জোর ঘটনাচক্রে, তাও সাময়িক কিছু বিষয়ে মিল হতে পারে। আর যদি তা না ভাল লাগে কারও তাহলে আরেক একমাত্র পথ হল, দুই রাষ্ট্র এক হয়ে যাওয়া- একমাত্র তখন দু’টি আলাদা রাষ্ট্রস্বার্থ বলে আর কিছু থাকবে না। একাকার হয়ে যাবে। অন্তত মুখে দাবি করা যাবে। অতএব, দুই সেনাবাহিনী এই শর্ত-সীমার মধ্যেই কেবল যতটুকু সম্ভব ততটুকুই ‘ভাল’ সম্পর্কের অধিকারী হতে পারে।

২. ভদ্রকুমার তুরস্কে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি নিজ দেশের সহকর্মীদের সমালোচনা করেছেন। ভদ্রকুমার বলছেন, “ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, সাবমেরিন বিক্রি চীনের এক অসৎ উদ্দেশ্যে করা কাজ। তাই পাররিকর ভারতের তিন বাহিনীর উপপ্রধানদের নিয়ে চীনবিরোধী সফরে বেরিয়ে পড়েছেন। অন্ততপক্ষে ভারতীয় বিশ্লেষকের বরাতে বাংলাদেশের মিডিয়া তাই বলছে। এটা খুব দুর্ভাগ্যের যে, আমরাই আমাদের পড়শিদেরকে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে খাড়া করার বুদ্ধি দিচ্ছি। ভারতীয় বিশ্লেষকদেরই সিদ্ধান্ত হল – চীন ভারতকে ঘিরে ধরতেই সাবমেরিন বিক্রি করেছে। এগুলো এক আজব ব্যাখ্যা”। এই বলে তিনি এবার অনেকগুলো কারণ তুলে ধরে ভারতীয় বিশ্লেষকদের এমন সব ধারণা নাকচ করেছেন। আগ্রহিরা সেসব বিস্তারে জানতে পুরা লেখাটা পড়তে পারেন এখানে।  সেখান থেকে তাঁর এমন দুটো পয়েন্ট হল, তিনি বলছেন, ক. সাবমেরিন কেনা চীনের দেয়া কোনো দান-ধ্যান নয়, এটা বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত এবং তারা অর্থ দিয়ে কিনছেন। তাহলে এটা চীনের কাজ আর অসৎ উদ্দেশ্যে করা কাজ হলো কী করে? খ. বাংলাদেশের কাছে সম্ভাব্য বিক্রেতা ছিল রাশিয়া ও চীন। একা চীন নয়। বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে চীনকে প্রধানত প্রায় অর্ধেক দামে দিচ্ছে বলে। আর চীনের বেশির ভাগ অস্ত্র সরঞ্জাম বিক্রির সময় কোন লুকানো শর্ত থাকে না (উটের সঙ্গে বিড়াল নিতে হবে ধরণের)। তাহলে এটা ‘চীনের অসৎ উদ্দেশ্যে করা কাজ’ তা প্রমাণ হয় কী করে?
আমাদের বরং বাংলাদেশ কিসের তাগিদে সাবমেরিন কিনল, সেটা খুঁজে দেখা দরকার”।

অর্থাৎ এর মানেটা সোজা। আগামিতে এই আমেরিকান সাপোর্টেড ভারতীয় দিগগজেরা আমাদেরকে আরও জ্বালাবে। এসব ফালতু ঈর্ষা আর প্রলাপের মোকাবিলায় পালটা বয়ান প্রস্তুতি আমাদের লাগবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা এর আগে ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ অনলাইন দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকা (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আবার তবে নতুন ভার্সান হিসাবে আরও সংযোজন ও এডিট করে এবং নতুন শিরোনামে ছাপা হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s