বাংলাদেশে “গণতন্ত্রমনস্ক অনুভূতি” মাপার ডাক্তার পাওয়া গেছে
গৌতম দাস
২২ মে ২০১৭, ০০ঃ ০৪
প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া “গণতন্ত্রমনস্ক অনুভূতিপ্রসূত” ব্যক্তি কিনা সেই সন্দেহ রেখেছেন। ‘গণতন্ত্রমনস্ক অনুভূতিপ্রসূত’! কী দুর্দান্ত ভাষা! আর সেই বিশেষ ‘অনুভুতি’ মাপার ডাক্তার হয়েছেন মিজান। বাহ! বাহ! এটা কি রাজনীতি পর্যালোচনার ভাষা নাকি যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা জাতীয় মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ? অথবা ‘ব্যাটলিং বেগামস’ এবং ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার ভিত্তিতে প্রথম-আলো-ডেইলি স্টার গ্রুপের এক এগারোর রাজনীতির নতুন ড্রিল? গত ১১ মে ২০১৭ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো মিজানুর রহমান খানের ‘জিয়া-যাদু গোপন চুক্তিটি কি প্রকাশ করবেন খালেদা জিয়া?’ লেখাটি প্রকাশ করে। শিরোনামের স্টাইল খেয়াল করলেই সন্দেহ জাগে এর মতলব ভালো না। যাদু মিয়ার সঙ্গে জিয়াউর রহমান নাকি একটি গোপন চুক্তি করেছিলেন । আর এখন ১০ মেবুধবার খালেদা জিয়া তাঁর ভিশান ২০৩০ পেশ করবার পরপরই দৈনিক প্রথম আলোর একটাই বিশাল রহস্যমিশ্রিত আবদার, সেই ‘গোপন’ চুক্তি খালেদা জিয়া প্রকাশ করুক!
বিএনপি এবং ও তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির যেকোন সমালোচনা পর্যালোচনা হতেই পারে। কিন্তু বলুন তো খালেদা জিয়ার মধ্যে গণতন্ত্র মনস্ক অনুভূতিসম্পন্ন “উপলব্ধি” আছে কিনা সেটা বিচার করবার ডাক্তার কোথায় পাবেন? দ্বিতীয়ত একটি দেশ বা সমাজের রাজনীতি স্রেফ একজন ব্যক্তির উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না। যে সকল রাজনৈতিক বর্গ কেন্দ্র করে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠি নিজ নিজ ক্ষমতা এবং নিজেদের পক্ষে রাজনৈতিক সম্মতি তৈয়ার করে তার সঙ্গে সেই বর্গটি সম্পর্কে সমাজের বিভিন্ন বয়ানের ভূমিকা থাকে। থাকবেই। সেই ক্ষেত্রে ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে যে সকল বয়ান সমাজে হাজির এবং সেই সকল বয়ান কেন্দ্র করে তর্কবিতর্ক সমালোচনা পর্যালোচনা ছাড়া জাতীয় রাজনীতির কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটে না। তার মধ্য দিয়েই জনগণের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটে। এই গোড়ার কথা যখন আমরা মনে রাখি না, তখন হলুদ সংবাদ মাধ্যমগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্দশার সমাধান হিসাবে ‘মাই নাস টু’ ফর্মুলা তৈয়ার এবং তা কার্যকর করবার কাজে অনায়াসেই লেগে পড়তে পারে। গত এক-এগারোর সময় এটাই আমরা দেখেছি। “মাইনাস টু” রাজনীতির মূল তত্ত্ব ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্দশার জন্য দুইজন “ব্যাটলিং বেগাম” – অর্থাৎ খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দায়ী। অতএব করণীয় হচ্ছে এদের দুইজনকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া। চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ পাঠক আপনার নিজের মতো করে বুঝে নিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্দশার জন্য যখন আমাদের বিচারের মানদণ্ড খালেদা কিম্বা শেখ হাসিনার ‘গণতন্ত্রমনস্ক অনুভূতিপ্রসূত উপলব্ধি’ থাকা না থাকার বিচার হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমরা মূলত মাইনাস টুর তত্ত্বই আর এক ভাবে আওড়াই। কিন্তু এবার সুনির্দিষ্ট ভাবে খালেদা জিয়া সম্পর্কে এই বোম্বাস্টিক বিশেষণ প্রয়োগের চেষ্টা দেখে আন্দাজ করা যায় এবার মাইনাস-টু না সম্ভবত মাইনাস ওয়ান এটা।
যাক্, তবুও বাংলাদেশে তাহলে ‘গণতন্ত্রমনস্ক’ এবং গণতন্ত্রের ‘অনুভূতি প্রসূত উপলব্ধি্র’ ধারক মহানুভব একজন ব্যক্তি পাওয়া গিয়েছে। বিএনপি একটা ভাল দল কীনা, ওর রাজনীতি ভাল কীনা এমন কিছু প্রমাণ মিজানুর রহমান খান করবেন আমরা তা আশা করি না। যদিও পর্যালোচনায় ভালমন্দ উভয় দিকটাই তুলে ধারা্র কথা। মুল্যায়নে বসলে বিএনপির একগাদা ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা অনেকেই খুজে পেতেই পারেন। তবে মিজানুর রহমান খান ব্যক্তিগতভাবে একজন বাকশাল-প্রেমি ও ‘বাঙালী জাতীবাদ”-প্রেমিও তিনি বটে। যদিও তাতেও আমাদের সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হয় তখন যখন চরম প্রিজুডিস বা নিজের বাকশালপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিবাদকে পাশে সরিয়ে না রেখে উলটা তা দিয়েই রাজনীতির মুল্যায়ন করতে বসেন। সেটা দৈনিক প্রথম আলোর মতো তথিকথিত সাংবাদিকতার আড়ালে মূলত ‘বাকশালী’ অপপ্রচারের অধিক কিছু হয়ে ওঠে না।
কোন রাজনীতি বা রাষ্ট্রের ভালমন্দ বিচার করবেন কী দিয়ে? সে বিচার কাজে ক্রুশিয়াল বৈশিষ্টগুলো কী কী ? সেগুলো জেনে রাখার বদলে নিজের বাকশালপ্রীতির উপর ভরসা করে বিচারে বসলে তাতে সেটা ঘোরতর অন্ধ দলবাজীই হবে। প্রথম আলোতে প্রকাশ্যে ঘোষিত মিজানসহ তিনজন বাকশাল সমর্থককে এডিটর আমরা দেখে থাকি। বিশেষ করে মিজানের লেখায়, যেমন আলোচ্য এই কলামের শিরোনাম পড়ে যেকারও মনে হবে পাপীতাপী বিএনপির বিরাট এক গোপন দুর্বলতা সামনে নিয়ে এসে মিজান কথা বলছেন। তাই কী? আসেন তাহলে দেখা যাক!
বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীলরা’ কেউ কোনদিন শেখ মুজিবের বাকশাল চতুর্থ সংশোধনীর কোন রিভিউ, সমালোচনা করেছেন জানা যায় না। তবু অনেকের মনে পড়বে হয়ত, একদলীয় শাসন অথবা মাত্র চারটি সংবাদপত্র ইত্যাদির কথা। কিন্তু এগুলো সেই সংশোধনী কার্যকর করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্যগত ত্রুটি ঘটেছে তার আসল বিচার নয়। অর্থাৎ কনষ্টিটিউশানাল বা রাষ্ট্রের গঠনতান্ত্রিক সমালোচনা নয়। অথচ মিজানুর রহমান খান অনবরত নিজেকে মহা সংবিধান বিশারদ জ্ঞান করে আমাদের আলোকিত করে থাকেন!
গঠন প্রক্রিয়া কিম্বা বৈশিষ্ট্য কোন দিক থেকেই বাহাত্তরের সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে গড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র আদর্শ মর্ডান রিপাবলিক রাষ্ট্র নয়। সেটা ইতিহাসের ফলাফল, আমরা তা মেনে নিয়ে যতটুকু পেয়েছিলাম তাই নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। সেই ক্ষেত্রে তার যতটুকু ‘গণতান্ত্রিক’ বৈশিষ্ট্য আছে তা অক্ষুণ্ণ রাখাই ছিল প্রধান কাজ। কিন্তু বাকশাল সংশোধনীর ফলে এরপরের বাংলাদেশ আর কোন রিপাবলিক রাষ্ট্র নয় বরং এক দানব বা স্বৈরশাসন আনয়নকারি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র বা কনস্টিটিউশন বদলানোর ফলে সেই দানবীয় চরিত্র কিভাবে ঘটেছে তা নিয়ে খুব কমই পর্যালোচনা দেখা যায়। তবু বাকশালী মিজানুর রহমান খানের একটা সহজ ফর্মুলা হল অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিয়াউর রহমানকে গালি গালাজ করা। বাকশাল সম্পর্কে টুঁ শব্দ না করে সারাক্ষণ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গালমন্দ পাড়া। সব সমস্যার কারণ হিসাবে সামরিক শাসনকে দেখানো। সামরিক শাসন সামরিকতন্ত্র খারাপ, অবশ্যই। কিন্তু বাকশালকে মহৎ প্রমাণ করবার সুবিধা না পেয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কতো খারাপ ছিলেন সেটা প্রমাণ করে বাকশালের মহিমা গোপনে জারি রাখাই বাংলাদেশের নব্য বাকশালিদের কাজ। মিজানুর রহমানকে তাদের সর্দার বলা যায়। সেটা বাকশালিদের পক্ষে সহজ হয়েছে কারণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল একটি বুদ্ধিজ্ঞানহীন বোকাদের দল, যারা নব্য বাকশালিদের রাজনীতি মোকাবিলা করবার ন্যূনতম হিম্মত রাখে না।
মিজান তাঁর লিখায় নিজেকে বারবার রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের হাতে একক ক্ষমতা পুঞ্জীভুত করার বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরেন। কিন্তু আজীব ব্যাপার হল, আমাদের সংবিধানে সর্বপ্রথম যে সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে প্রায় সব ধরণের ক্ষমতা সঞ্চিত করা হয়েছিল সেটা বাকশাল চতুর্থ সংশোধনী। তা সত্ত্বেও এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে মিজানুরের কলম জাগে না। বরং তিনি কথিত ‘গোপন চুক্তি’ বলে এক রহস্য তৈরি করতে গিয়েছেন, ১১ মে এর ঐ কলামে। কথিত সেই গোপন চুক্তি নাকি অপ্রকাশিত, মিজান জানাচ্ছেন। কিন্তু অপ্রকাশিত হলেও মিজানুর আবার এর পুরাটা জানেন ও এবং সেটা তার আবার মুখস্থ। তাঁর কথিত মতে, শেখ মুজিবের বাকশালী সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের হাতে সীমাহীন যে একক ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিলেন, জিয়া নাকি এরচেয়েও আরও ক্ষমতা চেয়েছিলেন। যদিও মিজান নিজেই জানাচ্ছেন জিয়া শেষে এমন ক্ষমতা নেনই নাই। সেই না নেওয়ার দলিলই হল মিজান কথিত যাদু মিয়ার সাথে ‘গোপন চুক্তি’। তাহলে সেক্ষেত্রে কথিত সেই দলিল বলে যদি কিছু আদৌ থেকেও থাকে তবে তা বিএনপি বা জিয়ার কোন কলঙ্কের দলিল হয় কেমন করে? কিন্তু তবু মিজানুর রহমান খানের দাবি কথিত ঐ গোপন দলিল ‘কলঙ্কিত’ এবং তা “খালেদা জিয়াকেই প্রকাশ করতে হবে”।
মিজানুরের চরম বিনোদনমূলক তামাসাটা হল, তিনিই বলছেন ঐ গোপন দলিল আসলে জিয়াউর রহমানের বাড়তি ক্ষমতা না নেওয়ার দলিল বা রাজনীতিবিদ যাদু মিয়ার সাথে “সন্ধি-পত্র” – অথচ এই কথিত চুক্তি নিয়ে রহস্য সৃষ্টি আর জিয়া এবং বিএনপিকে ‘পাপীতাপী’ ‘অভিশপ্ত’ বলে ইঙ্গিত তৈরি করছেন তিনি। এই সুযোগ মিজানুর কোথায় পাচ্ছেন? বরং মিজানুর যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের হাতে একক সীমাহীন ক্ষমতা সঞ্চিত করার বিরুদ্ধের সোচ্চার প্রবক্তা হতে চান তবে সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবের এবং বাকশাল সংশোধনীর কঠোর সমালোচনা দিয়েই তাকে শুরু করতেই হবে। এক্ষেত্রে যদি তার প্রগতিশীলতা-বোধ, বাঙালী জাতিয়তাবোধ কিংবা বাকশালপ্রীতি বাধা হয়ে দাড়ায় তবে তা তাকেই পেরিয়ে আসতে হবে। এপর্যন্ত যা তিনি কখনও পেরেছেন আমরা দেখিনি।
এই প্রসঙ্গে বলে নেয়া যায় যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাস বিচারে – বিশেষত কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনী কী কী কারণে কালোদাগের এবং ক্ষতিকর এমন কোন একাদেমিক মুল্যায়ন আমরা ‘প্রগতিশীলদের’ ঘর থেকে বের হয়েছে দেখি নাই। রাজনৈতিক দলগুলোর পরিসরেও এবিষয়ে আর যা দেখা যায় সেগুলোকে বড়জোর পার্টিজান বা দলকানাদের সমালোচনা। এই অবস্থায় বাকশালের আসল মুল্যায়ন হল – এককথায় বললে – এই সংশোধনী্র মধ্য দিয়ে আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের খোদ কনষ্টিটিউশনকেই নাই করে দেয়া হয়েছে। সোজা কথায় ভাঙাচোরা হোক বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্য দিয়ে একটা রাষ্ট্র বানানো গঠন হয়েছিল, আর সেটাকেই বাকশালী চতুর্থ সংশোধনী পুরাটাই ভেঙ্গে দিয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনী এই অর্থে রাষ্ট্র নিরাকরণের একটি ঐতিহাসিক দলিল, যে অভিজ্ঞতা থেকে বারবার আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্র নাই অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়ার দলিল এটা।
কেন? এর মূল কারণ এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার বিরুদ্ধে নাগরিকের আদালতে রিট করার ক্ষমতা [আর্টিকেল ৪৪] কেড়ে নেয়া হয়েছিল। শুধু তাই না, জুডিশিয়ারির বা আদালতের রিট শোনার যে আলাদা নিজস্ব ক্ষমতা দেয়া ছিল [আর্টিকেল ১০২ (১)] সেটাও চতুর্থ সংশোধনীতে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। [চতুর্থ সংশোধনীর পিডিএফ কপিতে এখানে দেখুন, সংশোধনীর ইংরাজী অংশে প্রথম পাতায় ৩ নম্বর সংশোধনী আর ১৭ নম্বর সংশোধনী দেখুন হলুদ মার্কার দেয়া আছে।।] আর প্রেসিডেণ্ট জিয়ার সামরিক অধ্যেদেশ বলেই, আবার বলছি ১৯৭৬ সালের সামরিক অধ্যাদেশ বলেই ঐ বাকশাল চতুর্থ সংশোধনীতে বাতিল হওয়া [আর্টিকেল ৪৪] এবং [আর্টিকেল ১০২ (১)] ফেরত নিয়ে আসেন। একথার সবচেয়ে ভাল প্রমাণ এবং কথাগুলো সবচেয়ে সহজে স্পষ্ট বুঝা যায় কনষ্টুটিটিশনের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের আপিল কোর্টের রায়ে। ঐ রায় ১৮৪ পৃষ্টার। ঐ রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল বলে জানানো হলেও একই সাথে পঞ্চম সংশোধনীর যেসব অংশ বাতিল হবে না, বরং ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জীবিত থাকবে সেসবের একটা তালিকা দেয়া আছে ওর ১৮৩ পৃষ্ঠায়। সেখানে লেখা আছে জিয়ার আনা সংশোধনীর কথা। [দেখুন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়, আপিল কোর্ট জাজমেন্ট ২০১০, ১৮৩ পৃষ্ঠায় 3e এর (iii, iv & v)] শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীর ফলে এভাবেই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতার দানব বানিয়েছিল, এর বিরুদ্ধে আদালতে কোন প্রতিকার চাইবার সুযোগ ছিল না। ফলে বাংলাদেশ আর কোন প্রজাতান্ত্রিক বা রিপাবলিক রাষ্ট্র থাকে নাই। যে রাষ্ট্রে রিট করার সুযোগ নাই, সেটা আর রিপাবলিক রাষ্ট্র থাকে না। এই দিকটা নিয়ে কোন জজ-উকিল বা কোন রাজনীতিবিদকে আমরা পয়েন্ট তুলতে শুনি নাই। এটাও এখন প্রমাণিত যে রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র বা কনষ্টিটিউশনের ভাল-মন্দ বিচার কী করে করব, কী করে এটা কাজ করে তা বুঝার ক্ষেত্রেও আমরা এখনও যথেষ্ট লায়েক হই নাই। এখনও কেবল দলবাজি আর প্রগতিশীলতার ভাণ ও ভণ্ডামির মধ্যে আটকে আছি। অথচ আমরা আবার আওয়ামি লীগ বা বিএনপির এবং রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট বুঝার বিচারক হতে চাচ্ছি।
‘৭৫ পরবর্তি সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতা
মিজানুর রহমান খানের আর এক প্রবল পছন্দের বয়ান হল ‘৭৫ পরবর্তি সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতার’ তুলনা। এটাতে তাঁর চিন্তা করার কাঠামোটাও ধরা পরে। অবশ্য এটা তাঁর একার না, বাকশালের পক্ষে সাফাই যারাই দেন তাদের সাধারণ বয়ান এটা। মিজান সে বয়ান পরিপাটি করেন মাত্র। এই বয়ান দিয়ে তিনি বলতে চান বাকশাল দানব ক্ষমতার রাষ্ট্র তৈরি করলেও যেহেতু এটা বেসামরিক শাসন, আর বেসামরিক শাসন মানেই বৈধ শাসন, তাই দানব বাকশাল হলেও এটা বৈধ, ফলে গ্রহণীয়। আর তাই বিপরীত যুক্তিতে সামরিক শাসন অবৈধ। দারুন বাকশালী যুক্তি। বিএপির বিরুদ্ধে এটাই প্রধান বাকশালী অস্ত্র, কিন্তু বিএনপির সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা এই বাকশালী কৌশলের মর্ম ধরতে পারে না বলে এর কোন উত্তর দেবার হিম্মত দেখাতে পারে না।
আসলে এভাবে বৈধ-অবৈধ এর ভাগাভাগির লাইন টানা – এটা নগ্ন শঠতা। মিজান বলতে চান বাকশাল সংশোধনীর ভিতরে যত খারাপ কিছুই থাক তবু এটা বৈধ কারণ তা সিভিলিয়ান ক্ষমতা। এটাই শঠতা। উপরে দেখিয়েছি, কনষ্টিটিউশনে চতুর্থ সংশোধনী এনে নির্বাহী প্রেসিডেন্টের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে চাইলে কোন নাগরিকের আইনিভাবে আদালতে নালিশ জানাতে যাবার সুযোগ কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফলে এরপরের বাংলাদেশ, এটা দেখতে তখনও একই দেশ বা আধুনিক রাষ্ট্র মনে হলেও কার্যত এটা আর তখন মর্ডান রিপাবলিক রাষ্ট্র নয়। এটা আসলে নির্বাহী প্রেসিডেন্ট – নামে “এক সম্রাটের প্রি-রিপাবলিক বাংলাদেশ” হয়ে গেছিল। আমি নিশ্চিত মিজানসহ কোন ‘প্রগতিশীল’, ‘বাঙালী জাতিবাদীর” চিন্তায় এটা ধরা পড়বে না। এভাবে তারা চিন্তা করে দেখতে অভ্যস্ত নয়। এমনকি বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও নয়। বেসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সামরিক শাসন মানেই মন্দ গল্প তারা বাকশালিদের কাছ থেকে ভালোই হজম করে। হয়তো নীরবে মেনেও নেয়। চতুর্থ সংশোধনী যেখানে রাষ্ট্রের রিপাবলিক বৈশিষ্টই নষ্ট করে দেয় এরপর সেই বাকশালী রাষ্ট্রটা বৈধ নাকি অবৈধ – সামরিক নাকি বেসামরিক – সেটা কী আর কোন তর্ক? কিন্তু মিজান মার্কা এই বাকশালী মিথ্যা আর চাতুর্য প্রপাগান্ডার তোড়ে বিএনপিই ঘায়েল হয়ে গিয়েছে। কারণ রিপাবলিক রাষ্ট্রের ‘গণতান্ত্রিক’ বৈশিষ্ট্য সুরক্ষা বিএনপির রাজনীতি নয়। এর ফলে তারা জিয়াউর রহমানকেও স্রেফ একজন সামরিক শাসকের বেশী বুঝতে অক্ষম। অথচ বাকশালী রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব আসলে আমাদেরই এক ঐতিহাসিক অনিবার্যতায়, “পোস্ট-বাকশাল পরিস্থিতিতে আবার ট্রাকে উঠার উদ্যোগ” এটা বোঝার ক্ষমতা বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের নাই।
এমনিতেই বৈধ-অবৈধের তর্ক আর এই ক্রাইটেরিয়া দিয়ে রাষ্ট্রের ভাল-মন্দ বিষয়কে বুঝার চেষ্টা একটা খুবই নাবালকের কাজ। মনে রাখতে হবে একটা কালাকানুন বা কালো আইন – চরম দমনমূলক ও নিপীড়ন আইন হলেও সেটা বিদ্যমান সংবিধানের কারণে ‘বৈধ’ আইন হতে পারে; কোন অসুবিধা ছাড়াই। তাই, এই বৈধ-অবৈধ জাতীয় শঠ প্রশ্ন তুলে বাকশালের কুকীর্তি আড়াল করে বলেই মিজানুর রহমান খানকে বাকশালের দলবাজ সমর্থক বলছি।
আবার বিপরীতে সেসময়ের জিয়ার সামরিক ক্ষমতা সেটাও সামরিক নাকি বেসামরিক সেবিচারে যাওয়াও একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কারণ সেটা যাই হোক না কেন সেসময়ের ঐ ক্ষমতাটা ছিল এক অন্তর্বর্তী ধরণের ক্ষমতা মাত্র। এটাই ঐ ক্ষমতার মূল বৈশিষ্ট। আর ওর ভাল মন্দ নির্ধারিত হবে নতুন যে ক্ষমতা কাঠামো সে তৈরি করবে বা হবে ওর গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে। তাতে যারা নির্বাচিত হয়ে নতুন ক্ষমতায় আসবেন সেসব অনেক কিছুর গ্রহনযোগ্যতার উপরে। আর প্রি-কনষ্টিটিউশনাল সরকার মাত্রই অন্তর্বর্তী সরকার। বাকশাল করে রাষ্ট্র ভেঙ্গে ফেলা এবং শেখ মুজিব খুন হবার পর যা আমরা পেয়েছি তাতে সেটা আবার একটা প্রজাতান্ত্রিক কনষ্টিটিউশনের ফিরে যাবার আগের অন্তবর্তী অবস্থা।
তবু মিজানুরের মনে হতে পারে যে না, “ক্যান্টনমেন্টে বসে” যারা দল বানালো তাদেরকে হাতে নাতে ধরার একটা সুযোগ হাতছাড়া হতে দেয়া যায় না। ওকে নো প্রবলেম, আসুন মিজান তাহলে এবার আপনারই বিচার করি। ১/১১ এর সরকার কী সামরিক সরকার ছিল না? আর এই সামরিক সরকারের সাথে খোদ আপনি মিজান আর আপনার বস মতি-মাহফুজদের সম্পর্ক কী ছিল তা নিজেকে জিজ্ঞাসা করে নিবেন? আপনি মিজান কী তখন সে কালের “ক্যান্টনমেন্টে বসে” রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কারের নামে মহৎ কাজে লিপ্ত হন নাই? ঐ কাজ আর ঐ সামরিক সরকার কী “বৈধ” হয়ে গেছিল আপনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে? আরও ভিতরে যাবেন? আসেন!
১/১১ এর ক্ষমতায় ইচ্ছামত যা মনে চায় করে যে রাজনৈতিক সংস্কার আপনারা করেছিলেন – কী তার পরিণতি? বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ও এর কাঠামো এমন কিছু অথবা কী ছাপ আপনারা রেখে গেছিলেন যার সুফল এই আট বছরের হাসিনা সরকারের থেকে আমরা পাচ্ছি? বলেন, কোনটা আপনাদের অবদান? কোন সে সুফল? আপনাদের সংস্কারের ফসল কী খোদ হাসিনার শাসনটাই নয়? নিঃসন্দেহে এখন কোন দায়ই নিতে চাইবেন না, আপনি। আমরা জানি। কিন্তু ইতিহাস সবাইকে একদিন না একদিন জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। আপনারাও ব্যতিক্রম নন।
কনষ্টিটিউশনের ৭০ অনুচ্ছেদ
মিজান আর এক বিরাট অভিযোগ করেছেন প্রায়ই করেন, “সংবিধানের সবচেয়ে বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ, যা পার্লামেন্টকে একটি রাবার স্ট্যাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেত্রীর বশংবদ করে রেখেছে,সে বিষয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি”। তিনি এটা প্রায়ই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আর এর রাজনৈতিক নেতাদের গায়ে কালি লাগায় দিবার জন্য করে থাকেন। তো মিজানের এই কথা পড়লে সকলেরই মনে হবে হা, তাই তো! মিজান এই মোক্ষম জায়গায় ধরেছেন। হা, অবশ্যই এক মোক্ষম জায়গা। কিন্তু মিজান কাকে ধরেছেন? খালেদা জিয়া? নাকি এখানে অনুল্লেখ থাকা শেখ হাসিনাকে? মোটেও না। মিজান আসলে ধরেছে নিজেকেই। বাইরের মানুষ – হাসিনা, খালেদাকে দোষারোপের আগে মিজান আপনি নিজেকে কাঠগড়ায় তুলার হিম্মত দেখান। পারবে্ন?
যতদিন মিজানুরসহ মতি-মাহফুজের মিডিয়া গ্রুপের মত লোকের সক্রিয় সমর্থনে, ১/১১ ঘটবার সম্ভাবনা আর বিশেষ করে বিদেশী স্বার্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব গ্রুপের লোকেদেরকে ব্যবহারে ভাড়া খাটা মিজানুর রহমান খানেরা লুপ্ত না হবেন ততদিন বাংলাদেশের কনষ্টিটিউশনের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকতে থাকবে। কারণ এই ৭০ অনুচ্ছেদই বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হাসিনা-খালেদাদের কিছু রক্ষাকবজ। মিজানদের মত লোকেদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য হাসিনা-খালেদাদের কিছু রক্ষাকবজ। আমরা বরং মিজানের এসব স্বীকার করার সৎসাহস দেখতে চাইতে পারি। হাসিনা খালেদারা খারাপ রাজনীতির ধারক বাহক, এটা কে না জানে, এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এখান থেকে বের হতে, তা পরিস্কার করতে, পালটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া লাগবে। বিদেশী স্বার্থে সংস্কারের নামে পরাশক্তির স্বার্থরক্ষা নয়। এই স্বার্থ রক্ষার্থে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কলঙ্কের দাগ দেখিয়ে নয়।
মিজান আরও অভিযোগ তুলেছেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রও দলের প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা আছে, আর সেজন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করেছেন। ফলে এরও সংস্কার দাবি করেছেন তিনি। মিজান নিশ্চয় ভুলে যান নাই – মান্নান ভুঁইয়াকে দিয়ে কীভাবে বাধ্য করে সংস্কার ধারার বিএনপি তৈরি করা হয়েছিল। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বেচারা দেলোয়ার হোসেনকে কিভাবে ছেঁচা দেয়া হয়েছিল, এর কষ্ট মৃত দেলোয়ার হোসেনই জানতেন। তবু তার গৌরব, তিনি পতাকা ছাড়েন নাই। শামসুল হুদার ভুঁইফোড় নির্বাচন কমিশন কোনটা “আসল বিএনপি” সেই রায় দিয়েছিল। আর পরে তিনি নিজেই তার এই কাজ অন্যায় হয়েছে বলে স্বীকার করে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এটা যেন আমরা কেউ না ভুলি। তাহলে দাঁড়াল এই যতদিন বিদেশী স্বার্থে আপনি মিজান ও আপনাদের পত্রিকা বাইরে থেকে ইচ্ছামত কোনটা বৈধ দল, কোনটা বিএনপি ঠিক করতে থাকবেন, সে সম্ভাবনা থাকবে, ততদিন হাসিনা-খালেদা কনস্টিটিউশানে ৭০ অনুচ্ছেদ রাখবে এবং অবশ্যই রাখবেন। ‘গণতন্ত্র’ শিখাতে আসবেন না। মনে রাখবেন, হাসিনা বা খালেদা সেসব কম বুঝে না। তাঁরা দলের সব ক্ষমতা সভাপতি হিসাবে অবশ্যই নিজের হাতেই রাখবেন। কোনটা আওয়ামী লীগ আর কোনটা বিএনপি এটা যদি বিদেশীরা নির্ধারণ করতে থাকে তবে এমন ব্যবস্থা ও সুযোগ যতদিন থাকবে ততদিন এই শকুনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাসিনা-খালেদার জন্য ৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষে থাকা এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক অবস্থান। দুনিয়ার হুঁশজ্ঞান ওয়ালা মানুষ মাত্রই এটাই করবে। তাই বাইরে অন্যদের দিকে না, সৎসাহসে নিজের দিকে তাকান। নিজেকেই কাঠগড়ায় দেখতে পাবেন।
অতএব, কনষ্টিটুশনে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকার জন্য আপনারা মিজানেরাই মূলত দায়ী। নিজেরা যা করেছিলেন এর রিভিউ করেন, আবেদন করি ভাল হয়ে যান আগে। এরপর ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আপত্তি তুলেন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা এর আগে গতকাল ২১ মে দৈনিক নয়াদিগন্তের অনলাইনে (প্রিন্টে পরের দিন) ছাপা হয়েছিল। তবে সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত ভার্সান; চল্লিশ ভাগ ফেলে ষাট ভাগ ছাপা ভার্সান বলা যায়। এছাড়া অনলাইন দুরবীন পত্রিকাতেও আর এক ভার্সান ছাপা হয়েছে আজ ২২ মে ২০১৭, তাতে অনেকাংশেই পুর্ণ ভার্সান সেটা। কিন্তু তবু ফুল ভার্সান নয়। এখানে আরও বহু সংযোজন ও এডিটের পর সর্বশেষ ভার্সান এটাই। ]