“আফগানিস্তানে ভারত হারতে যাচ্ছে”


 “আফগানিস্তানে ভারত হারতে যাচ্ছে”

গৌতম দাস

০২ আগষ্ট ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

 

FP.COM   A security officer walks past a mural showing U.S. Special Representative for Afghanistan Reconciliation Zalmay Khalilzad and Taliban co-founder Mullah Abdul Ghani Baradar in Kabul on July 31, 2020. WAKIL KOHSAR/AFP VIA GETTY IMAGES

 

[সার-স্ংক্ষেপঃ   লেখার শিরোনাম “আফগানিস্তানে ভারত হারতে যাচ্ছে” – এটা মূলত এক সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদুতের দেয়া শিরোনাম, সেখান থেকে নেওয়া।  তিনি আফগানিস্তানে ভারতের এক সাবেক রাষ্ট্রদুত,  বিবেক কাতজু [Vivek Katju]। হিন্দুস্তান টাইমসে ছাপা হওয়া তাঁর লেখা  এক কলামের শিরোনাম ছিল – India is losing out in Afghanistan ।  অর্থাৎ এই সাবেক কূটনীতিক মোদী-জয়শঙ্করের ভারতের এক করুণ পরিণতি দেখছেন।  তাঁর পুরা লেখাটাই মোদী-জয়শঙ্করের কঠোর সমালোচনা করে লেখা।
ঠিক তেমনই আরেকজন হলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম আলো তাকে নয়াদিল্লি প্রতিনিধি বলে পরিচয় করায়ে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি তিনি মোদী-জয়শঙ্কর থেকে নিজেকে দুরত্ব তৈরি করে তাদের দায় না নিয়ে এক রচনা লিখে বলেছেন –  “আফগানিস্তান হতে চলেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কূটনৈতিক দক্ষতার কষ্টিপাথর”। অথচ প্রথম আলো তার এই দায় না নেয়া লেখাটা ছেপেছে সৌম্যর ‘মতামত কলাম” হিসাবে।  অর্থাৎ সৌম্য প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সে হিসাবে নয়।
মুলকথাটা হল, তালেবান ইস্যুতে মোদীর নীতি-পলিসিতে বড় গলদ দেখছেন ভারতের কূটনীতিক, একাদেমিক বা মিডিয়াকর্মিরা – তাঁরা মোদী-জয়শঙ্করদের থেকে নিজের দুরত্ব তৈরি করে কথা বলা শুরু করেছেন। তবুও মোদী-জয়শঙ্কর হুশিয়ারি দিচ্ছেন।  জয়শঙ্কর ২৯ জুলাই ভারতের রাজ্যসভায় বলেছেন, আফগানিস্তানে বলপ্রয়োগের সরকার ক্ষমতা দখল করলে (মানে তালেবানেরা ক্ষমতা দখল করলে) ভারত তা মেনে নিবে না [We would never accept any outcome which is decided by force”]। মানে স্বীকৃতি দিবে না। যদিও ভারতের স্বীকৃতির অপেক্ষায় তালিবানরা রয়েছে এমন কথা জানা যায় না। তবে ভারত সফরে আসা আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন তার কথাও ভারতের কাছাকাছি মনে হলেও, কিন্তু এক বড় ফারাকের। তিনি বলছেন সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে তালেবানদের অসুবিধা হবে। তিনি একটা শব্দ ব্যবহার করেছে “pariah” [Afghanistan to become ‘pariah state’ if Taliban seizes power: US] যার সমতুল্য বাংলা মানে হল অছ্যুত বা একঘরে হয়ে থাকা।  দেখা যাচ্ছে আমেরিকা যেখানে হুমকি নয়, অবজেকটিভলি তালেবান্দের উদ্দেশ্যে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন  মুরোদহীন ভারত সেখানে হুঙ্কার দিয়ে বলছে – ভারত মেনে নিবে না। ]

 

এশিয়ায় কূটনৈতিক দৌড়াদৌড়িঃ
আফগানিস্তানকে ঘিরে এশিয়ায় কূটনৈতিক দৌড়াদৌড়ি চরমে উঠেছে। গ্লোবাল পাওয়ারগুলোর সবাই তো বটেই,  এমনকি মুরোদ না থাকলেও যারা আকাঙ্খী, তারাও এতে শামিল হতে চাইছে। কারণ একটাই তালেবান ইস্যু গরম হয়ে উঠছে। মানে আমেরিকার বন্ধুরা যারা গত বিশ বছর ধরে আমেরিকার পক্ষে থেকে কাবুলের পুতুল সরকারের থেকে নানান “প্রজেক্ট” বাগিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের জন্য এখন দুঃখের দিন, হাহাকারদের দিন। বিশেষ করে ভারত তার তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আটকে গেছে সেই দুঃখে তালেবানদেরকে বদ-দোয়া দিয়ে যাচ্ছে – যে তালেবান সরকার টিকবে না।  এতো গেল একটা দিক। অন্যদিকটা  আরেকটু ভেঙে বললে, গত ২০ বছর হিতাহিত ভুলে আমেরিকার এই আফগানিস্তানে চালানো আক্রমণ ও দখলদারির দিন এবারের মত শেষ হবে। কিন্তু শেষ ‘কাফফারা’ দিতে হবে আরো অনেক; এবার সে ‘কাফফারা’ দেওয়ার  এক নয়া জমানায় সম্ভবত প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

SPUTNIKNEWS

গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলের কথা যা আজকাল অস্বীকার-কারীরাও পরোক্ষে স্বীকার না করে পারছে না যে, আমেরিকার বদলে এর জায়গায় চীনের উঠে বসার কথা বা লক্ষণ-ইঙ্গিতও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমেরিকার জন্য এই শাস্তি ডেকে নেওয়ার কারণও মূলত আফগানিস্তান। কারণ আসলে এই যুদ্ধের খরচ জোগাতে গিয়েই, এতদিন সামলে চলা আমেরিকার অর্থনীতি, ২০০৭ সাল থেকেই বেসামাল হয়ে যায়। এই খরচ বেহিসাবি কারণ এই যুদ্ধ অন্তহীন এবং  এতে লোভ ও চরম অপরিকল্পনা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখানে খরচের কোনো রিটার্ন আপাতত আর আসার সম্ভাবনা নাই, এর কিছুই ফেরত আসবে না। সেটা ক্রমান্বয়ে নিশ্চিত হয়ে যাওয়াতে ২০০৮ সাল থেকেই গ্লোবাল মহামন্দা নেমে এসেছিল। আর তাতেই প্রথম সুবিধাটা যায় চীনের ঘরে যে তখন নিজ অর্থনীতির কেবল ডাবল ডিজিট জিডিপির ২০ বছরে পৌঁছাতে যাচ্ছিল। তাই আমেরিকার বদলে সে জায়গায় চীন – এই সুবিধা চীনের জন্য প্রথম উন্মুক্ত হয়েছে আফগানিস্তানে আমেরিকান হামলার পরের পিছু হটা থেকে।

তাই ২০১৪ সালেই আমেরিকাকে প্রথম বড় সেনা প্রত্যাহার ঘটাতে হয়েছিল। কারণ আমেরিকান  অর্থমন্ত্রী বা ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের  খরচ জোগানোর অপারগতায় শেষ টাইমলাইন ছিল সেটা। তাই প্রথম সেই প্রধান সেনা প্রত্যাহার (আমেরিকাসহ ‘ন্যাটো’ ও তার বন্ধুদের সেনা) যা শুরু হয়েছিল তা এবার ২০২১ সালে বাদবাকি সমূলে প্রত্যাহার শেষ হতে প্রতিশ্রুত হয়েছে, যার টার্গেট আগস্টের শেষে। অর্থাৎ এ মাসের মধ্যেই।

এতে  আফগানিস্তানে এতদিন আমেরিকার যা অর্থসম্পদ ক্ষতি হয়েছে তা তো হয়েছেই; কিন্তু সেটাই শেষ নয়। বরং আরেক  বিরাট সম্ভাব্য ওলটপালট সামনে অপেক্ষায়। আর তাতে আমেরিকার এর চেয়েও বড় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকছে। গ্লোবাল ক্ষমতার পালাবদলে যে নতুন  ভারসাম্য আসন্ন, অন্তত এশিয়ার ভারসাম্য এখান থেকেই পুনর্লিখিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

ওদিকে এনিয়ে ভারতের অবস্থান আরও নাজুক, একেবারেই আমেরিকার মুখাপেক্ষি। তাই যদিও আপাতত মোদীর ভারত আমেরিকাকে জাপটে ধরেই থাকছে বটে; তবে পারলে বাইডেনের চেয়ে – ভারতের হিউম্যান রাইট নিয়ে প্রশ্ন না তোলা – ট্রাম্পের মত প্রেসিডেন্টই মোদীর ভারতের কাম্য।  কিন্তু এসব কিছুই ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত। এরপরে সেই নির্বাচনে বিজেপি ফিরে জিততে না পারলে সেই ভারত পথ বদলে চীনের বন্ধু হয়ে যাবার পথে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়। বিশেষত ইতোমধ্যেই ডুবে যাওয়া ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন আওয়াজ ইতোমধ্যেই জোরালো হচ্ছে। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এবং তাতে তালেবানদের ক্ষমতায় ফিরে চলে আসার সম্ভবনা ভারতকে একেবারে অস্থির বেচাইন করে দিয়েছে।
কারণ মূল সে ঘটনা হল তালেবান  – মানে ১৯৯৬ থেকে আমেরিকার ২০০১ সালে দখলের আগে পর্যন্ত যারা কাবুলের সরকারের ক্ষমতায় ছিল, সেই তালেবানরা। নিঃসন্দেহে সেই আর এই – তালেবানের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা এবার আকাশ-পাতাল ফারাক দেখব বলে আশা করতে পারি।  তবুও তালেবানরা এবার “আগের মত একই তালেবান কি না” (ভারত যেমনটা আগেই প্রপাগান্ডা শুরু করে দিয়েছে) – তবু সেটা বড় ফ্যাক্টর নয়।
কারণ মনে রাখতে হবে, ২০০১ সালে আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনের হামলার পর পাল্টা আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা ও দখল করেছিল পরের মাসে ৭ অক্টোবর ২০০১ সালে। আর এরপরই  জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ ভেটোক্ষমতাসহ মোট ১৫ আসনের  সকলে সর্বসম্মতিক্রমে ১৪ নভেম্বর ২০০১, তালেবান শাসন ও সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা প্রস্তাব ও ভোট দিয়েছিল।  মানে গ্লোবাল রাজনীতিতে রুলিং শাসকেরা সেসময় একেবারেই সদলে  তালেবানের বিরুদ্ধে চলে গেছিল।  অথচ  তুলনায় আজকের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন।  এখন একই পরিষদে আমেরিকান কোনো প্রস্তাব নিয়ে যদি ভোটাভুটি হয় তবে এর বিপক্ষে  অন্তত দু’টা (চীন ও রাশিয়া) ভেটো পড়বে আর বিভক্তি ভোট তো হয়ে যাবেই। অর্থাৎ কোন প্রস্তাব পাসই হবে না। এটাই অনেক বড় ফ্যাক্টর।

উপরে যে গ্লোবাল পালাবদলের কথা তুলেছি, আফগানিস্তান-তালেবান ইস্যুর উপর এরই মধ্যে ছাপ পরে গেছে পুরোদস্তুর। যেমন – গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলে ইতোমধ্যেই “আমেরিকা বনাম চীন” এমন দুটো পক্ষের মধ্যে অন্য দেশগুলো কে কোন দিকে সেই পক্ষ-বিপক্ষ প্রতিদিনই আমরা আরো চোখা হয়ে উঠতে দেখছি। গ্লোবাল পালাবদলে ‘আমেরিকা বনাম চীন’ এই পক্ষ-বিপক্ষের ছাপটাই আফগানিস্তানের পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই মেরুকরণে পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে পেছনে কাজ করছে। যেমন- কে কে আমেরিকার ফেলে যাওয়া পুতুল সরকারের পক্ষে আর কে কে তালেবানের (শর্ত সাপেক্ষে) প্রতি সহানুভূতিশীল – এই দুই ভাগেই প্রতিফলিত হচ্ছে প্রথমটা আমেরিকার পক্ষে আর পরেরটা ‘চীনের পক্ষ’। এদিকটাই এখন প্রধান ফ্যাক্টর।

তবে আফগানিস্তানের এখনকার সব ঘটনার শুরু যে ২০০১ সালের আমেরিকান হামলা থেকে সেই আমেরিকার এখন প্রধান টার্গেট ও স্বার্থ হল – আফগানিস্তানে আমেরিকার সব অর্থব্যয় এবার বন্ধের ব্যবস্থা করা যা ড্রেনে পড়ছে; আর, এরপর আমেরিকান টার্গেট সেই আফগানিস্তান ফেলে পালিয়ে যাওয়া। তাই, এরপরে তালেবান আক্রমণের মুখে কাবুলের সরকার টিকে থাকতে পারবে কি না সেটা আমেরিকার কাছে সেকেন্ডারি, তার পারলে ভালো  – এরকম। যদিও আমেরিকা তা মুখে স্বীকার করছে না, ভাবে বলছে। ওদিকে আমেরিকার আরেক কোর-স্বার্থ হল, সেনা প্রত্যাহারের পরে, আল-কায়েদার মত গ্লোবাল সশস্ত্র ইসলামি গ্রুপগুলো যেন আফগানিস্তানে্র আশ্রয়ে থেকে অপারেট না করে। আর এটাই তালেবানদের সাথে ট্রাম্প ও বাইডেনের মুখ্য ডিলিং পয়েন্ট, যা অপ্রকাশ্য রাখা আছে। যদিও তালেবানেরা সেই আশ্বাসও দিয়েছে [The Taliban has also assured the US that it would not allow global terrorist groups to operate from Afghanistan.] বলে জানা যাচ্ছে।

তিনটা আলাদা মিটিং কিন্তু প্রায় সমান্তরালেঃ
আমেরিকান সেনা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের সময় তেমন আর বেশি নাই, মাত্র আগস্ট মাসটাই। তাই আমরা অস্থির কূটনৈতিক ব্যস্ততা দেখছি যার মধ্য থেকে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের তিনটা মিটিংয়ের কথা এখানে তুলে ধরব।

এক.
সময়ের হিসাবে ধরলে তিন মিটিংয়ের সবশেষেরটা হল ২৮ জুলাইয়ে, ৯ সদস্যের তালেবান প্রতিনিধিদের চীন সফর ও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ওয়াং ই-এর [Wang Yi] সাথে বৈঠক।

আফগান তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার [Mullah Abdul Ghani Baradar] বুধবার চীন সফরে গেছেন, আর সেখানে পৌঁছেই উত্তরাঞ্চলীয় তিয়ানজিং শহরে তিনি বৈঠক করেছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সাথে।

বলা যায় ভারত ও সমমনা যারা এতদিন আফগানিস্তানের পুতুল সরকারের হাতে গত বিশ বছর মাখন খেয়ে গেছে, তাদের জন্য চীন-তালেবান এই বৈঠক এক মহাজুলুনি তৈরি করেছে। সেই ঈর্ষা আর জলুনি কত তীব্র তা দেখা যাচ্ছে বিবিসি বাংলার নিচের এই রিপোর্টে।

চীন-আফগানিস্তান: ঘনিষ্ঠ হচ্ছে কমিউনিস্ট চীন ও সুন্নী তালেবান, তৈরি হচ্ছে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ

এতে তালেবানদের দিক থেকে এই প্রথম আমেরিকার বিরুদ্ধে তাদের ‘কাউন্টার ওজন’ প্রকাশ করা মানে পাল্টা-পাল্লায় বাটখারার ভার দেখানো হল। আর তাতে চীনের পেছনে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলো আর (হবু ছয় দেশীয় জোট দেখানোর কারণে) সম্ভবত বাংলাদেশও – তাদের সবাই যে আছে সেই অনুমান ছড়িয়ে দেয়া হল। এরই পাল্টা হিসেবে আমেরিকার বগলে এক ভারত ছাড়া আর কেউ আপাতত দৃশ্যমান নয়। আমেরিকা-ভারতের বিপরীতে তালেবানের এই বাটখারার ভার দেখানো তাৎপর্যময় অবশ্যই। এটা আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কিছু মন্তব্যে। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং বলেছেন, তালেবানরা ‘এখন আফগানিস্তানে এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি” [“Wang Yi pointed out, the Afghan Taliban is a crucial military and political force in Afghanistan,” ]।’ আবার রয়টার্স রিপোর্টের শিরোনাম করেছে, চীন বলছে, তালেবানদের কাছে চাওয়ার আছে যে, তারা আফগানিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠায় মিলমিশ ও পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক!’ [China told a visiting Taliban delegation on Wednesday it expected the insurgent group to play an important role in ending Afghanistan’s war and rebuilding the country,] এই কথায় ভারতসহ সমমনাদের জলুনি উঠলেও বলার কিছু নাই। কারণ চীনের একথা সবচেয়ে ইতিবাচক এক স্টেমমেন্ট।
এছাড়া আরেক তাতপর্যপুর্ণ দিক আছে। চীনের উইঘুরে (মানে জিনজিয়াং প্রদেশ যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে আমেরিকা) ‘পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামী আন্দোলন’ [East Turkestan Islamic Movement বা সংক্ষেপে ETIM] নামে সশস্ত্র সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে বা রুখতে তালেবানরা চীনকে সাহায্য করবে – চীন এই আশাবাদ রেখেছে। ঐ মিটিং শেষে তালেবান মুখপাত্র মোহাম্মদ নাঈম জানিয়েছেন, ‘তারা চীনকে আশ্বস্ত করেছেন, আফগান-ভূমি চীনের বিরুদ্ধে কাউকে ব্যবহার করতে তারা দেবেন না [“(The) delegation assured China that they will not allow anyone to use Afghan soil against China,” Naeem said. ]।’ তালেবানদের আরেক মিডিয়া মুখপাত্র সুহেল শাহীন অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, চীন আফগানিস্তানের অবকাঠামো পুনর্গঠনের ‘welcome friend’  বা ‘স্বাগত-বন্ধু’;  [Taliban spokesman Suhail Shaheen says the group welcomes Chinese investments in reconstruction and would guarantee the safety of investors and workers]।
সার কথায়, তালেবানেরা সশস্ত্র এবং অ-দায়িত্বশীল এক রাজনৈতিক শক্তি বলে পশ্চিমে ও বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে যে প্রচার আছে বা খারাপ ইমেজ করে রাখা আছে, একালে সেসব কাটানো ও লঘু করার দিক থেকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এই বৈঠক তালেবানদের অনেক সুবিধা দেবে, ইমেজ বাড়াবে।

দুই.
আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন [Antony J Blinken] ২৭-২৮ জুলাই ভারত সফর করে গেলেন। এক কথায় বললে এটা ছিল আফগানিস্তান-তালেবান ইস্যু পরিস্থিতিতে বেদিশা ও একা হয়ে পড়া ভারতকে আশ্বাস দিয়ে পিঠ-চাপড়ে দেয়ার সফর।
প্রথমত, আফগানিস্তান-তালেবান ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদী তাঁর অভ্যন্তরীণ জনগণ, কূটনীতিক, একাডেমিশিয়ান ও মিডিয়াকর্মীদের কাছেই আস্থা একেবারে হারিয়েছেন। তারা লেখা শুরু করে দিয়েছেন, “আফগান প্রশ্নে দিল্লি বন্ধুহীন“। অথবা এখানে দেখেন,  Indian experts are wondering why New Delhi has been sidelined in Afghanistan. ।  আর উল্টা পাকিস্তানের ভেতরে আমেরিকারাশিয়া নিজ নিজ স্বার্থের আশ্রয় খুঁজছে। ওদিকে পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার চীন তো আছেই। জয়েন্ট স্টেটমেন্ট দেখেন এখানে  [Joint Statement on Extended “Troika” on Peaceful Settlement in Afghanistan]।    মনে করা হচ্ছে, ভারতকে বাইরে রেখে মূলত এই ফ্যাক্টসগুলো মিডিয়ায় প্রচার হয়ে পড়াতে মোদি ভীত হয়ে যান। বিজেপির ধারণা, মোদীর ভারতকে ছাড়িয়ে  পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা আগামী যেকোনো ভোটে মোদীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। আর সেটা কাউন্টার করতেই ব্লিঙ্কেনকে এনে যেন দেখিয়ে মোদী সবাইকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। তবে এর ফল তেমন সুখকর হয়নি।

এর অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণ হল, আফগানিস্তান-তালেবান ইস্যুতে ভারত ও আমেরিকার স্বার্থের অনেক মিল থাকলেও কিন্তু অমিল-ভিন্নমতও কম নয়। যেমন – ব্লিঙ্কেনের ফিরে যাওয়ার আগে ভারতে মিডিয়ায় সামনে এসেছিলেন তিনি। ততক্ষণে চীন-তালেবান মিটিংয়ের রিপোর্ট মিডিয়ায় এসে গেছে। তাই, তালেবানের চীন সফরের সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে এর জবাব দিতে গিয়ে ব্লিঙ্কেন প্রকারান্তরে চীনের প্রশংসা করে বসেন।

Asked about the Taliban visit, U.S. Secretary of State Antony Blinken said in New Delhi that it was a “positive thing” if Beijing was promoting a peaceful resolution to the war and “some kind of (Afghan) government … that’s truly representative and inclusive.”

বলেন, এই ‘সফরটা ইতিবাচক’। চীন যদি যুদ্ধাবস্থায় এক শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব ও আফগানিস্তানে কোনো ধরনের সরকারের কথা বলে যা সত্যিই সবাইকে নিয়ে এবং প্রতিনিধিত্বমূলক তবে তা তো ইতিবাচক”। এখন ব্লিঙ্কেনের পক্ষ থেকে চীনের এই পরোক্ষ প্রশংসা তো মোদীর জন্য হজম করা খুবই মুশকিল। এই হল, আমেরিকা ও ভারতের স্বার্থের বেমিল। ওদিকে ভারতের কূটনীতিক, একাডেমিক বা মিডিয়াকর্মীর সবচেয়ে বড় অনাস্থা হলো – আফগানিস্তানে যার যার স্বার্থ আছে সে মোতাবেক সংশ্লিষ্ট এমন সবাই ইতোমধ্যে দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তালেবানদের সাথে কয়েকবার বৈঠক এবং আলোচনা, বুঝাবুঝি বা সমঝোতা করে নিয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইরান মূলত কেউ বাকি নেই এদিক দিয়ে। অথচ ভারত এই পথেই নেই। এটাতে মূলত ভারতের আভ্যন্তরীণ ইন্টেলেজেন্সিয়া  তারা অসন্তুষ্ট ও হতাশ। ভারত কেবল গোপনে একবার তালেবানদের সাথে দেখা করেছে যা আবার প্রকাশ্যে অস্বীকার করে থাকে। আর পাকিস্তান তালেবানদের নাকি ভারতের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করছে বা উসকাচ্ছে বলে ডাহা মিথ্যা এমন প্রপাগান্ডায় ভারত লিপ্ত হয়ে গেছে। অতীতে তালেবানরা কী কী খারাপ কাজ করেছে এর বর্ণনা দিয়ে ভারত এখন প্রচার শুরু করেছে। অথচ ভারতের এক মিডিয়া-মুঘল দা-প্রিন্ট পত্রিকার সম্পাদক শেখর গুপ্তা লিখেছেন ……

“Like them or not, Taliban are a reality. India can deal with them if BJP resets its politics…”

অর্থাৎ তিনি উলটা বিজেপি-আরএসএস কে তালেবান-বাস্তবতা মানতে বলেই থামেন নাই। উলটা পরামর্শ রেখে বলেছেন, মোদীর খোদ নিজেদের রাজনীতিই বদলে নিতে। আসলে একেবারেই কোন সঠিক পলিসিতে মোদীর ভারত নাই বলেই ভারতের কূটনীতিক, একাডেমিক বা মিডিয়াকর্মীদের প্রধান অনাস্থা। এছাড়া আরো ভেতরের খবর হল, ভারত সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মুডে আছে।  খবরটা দিয়েছেন আফগানিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদুত বিবেক কাতজু। লিখেছেন,

Indian policymakers had looked at the Afghan scene dispassionately especially after the US began talking to the Taliban in Doha in 2018. What is strange is that even after the US-Taliban deal in February 2020, Indian strategists, instead of making up for lost time, continued to ignore emerging realities.
Stranger still, Kabul-based senior political personalities, who have recently interacted with the Indian leadership, say that India continues to have a “wait and watch” approach. What they are leaving unsaid is that India has become a bystander in Afghanistan, not knowing which way to turn.
Some analysts are railing against countries which are engaging the Taliban. They believe that these countries will pay a price for not understanding the true nature of the group.

অর্থাৎ ভারত কোন প্রস্তুতিই নেয়নি তাই নয়। শেষের বাক্যটা বলছে তালেবানদেরকে বদ-দোয়া দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে।  তাই আফগানিস্তান-তালেবান ইস্যুতে ভারত কোনোই প্রস্তুতি নেয়নি। কারণ ভারতের ধারণা- তালেবানরা পরাজিত হবে, হারিয়ে যাবে। আর বর্তমান সরকারই থাকবে যা আসলে অনিশ্চিত জেনেও ভারত আমেরিকার ভরসায় বসে থাকতেই চায়। কিন্তু সে দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের পরেই সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে আমেরিকার চাওয়া আর ভারতের চাওয়াও তো এক নয়।

তবে ব্লিঙ্কেনের এবারের সফর শেষের পর থেকে, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া হুমকি ও আক্রমণ শুরু করেছে। দিল্লি ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের নতুন মুখপাত্র অরিন্দম বাগচিকে দিয়ে বলিয়েছে, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে জানাচ্ছে যে, সারা কাশ্মিরই ভারতের অংশ। অর্থাৎ পাকিস্তানের দখলে থাকা কাশ্মির ভারতেরই ভূমি – যেটা নাকি পাকিস্তানের দখল করে থাকা। তাই পাকিস্তান-কাশ্মিরের কিছু অংশের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তানের করিডোর [CPEC] নির্মাণ করা হয়েছে সেটা ‘তথাকথিত’  করিড়োর সহ সব অবৈধ দখল ছেড়ে যেন পাকিস্তান চলে যায় সেই কড়া আহ্বান রেখেছে ভারত [“We call upon Pakistan to vacate all Indian areas under its illegal occupation,” ]।

একই সাথে তালেবানদের চীনে গিয়ে মিটিং করার বিরুদ্ধে ভারত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে [India Thursday also reacted against Taliban leaders visiting China and meeting the country’s leaders there]। আর সবশেষে, ‘আফগানিস্তানে গায়ের জোরে কোনো সরকার কায়েমের বিরুদ্ধে’ মানে, তালেবানদের কাবুলের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে [“Unilateral imposition of will by any party will not be democratic…..] ভারতের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তবে এসব হুঙ্কার মোদীর ভারত মূলত তার অভ্যন্তরীণ জনমত যা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অনুমান, তাকে ফিরানোর লক্ষ্যের বলা হয়েছে বলে দেখেছেন অনেকে। কিন্তু আফগানিস্তানে ভারতের এক সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন বিবেক কাটজু; তিনি খুবই কড়াভাবে মোদি-জয়শঙ্করের নীতি পলিসিকে তুলোধোনা করে হিন্দুস্তান টাইমসে কলাম লিখেছেন।

তিন.
এটা হল – গত ২৫ জুলাইয়ে চীন-আমেরিকার নিজস্ব সম্পর্ক প্রসঙ্গে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক। বাইডেন জানুয়ারিতে মার্কিন ক্ষমতায় শপথ নেয়ার পরে মার্চের ১৮-১৯ তারিখে প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দু’পক্ষের প্রতিনিধির বৈঠক হয়েছিল যা খুবই তিক্ততা দিয়ে শেষ হয়েছিল। এবারের মিটিংটাকে এক দিক থেকে এরই পরবর্তি ও পাল্টা সফর বলে মনে করছেন অনেকে [Why Tianjin? And what’s in store in China for US envoy Wendy Sherman?]। বিশেষত আগের মিটিংটা হয়েছিল আমেরিকার রাজধানীর বাইরে দেশের উত্তরের আলাস্কা শহরে। আর এবারের আমেরিকার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যানের সাথে বৈঠকটা দেয়া হয়েছিল বেজিংয়ের বাইরে তিয়ানজিং শহরে যেটা আসলে চীনা-আফগান সীমান্তের এক শহর।
এবারের এই মিটিংয়ের সার কথা ছিল, নিজেদের মধ্যে যত মনোমালিন্যই থাকুক যুদ্ধ তারা কেউ চায় না- এ কথাটা প্রকাশ করে রাখা। যেমন- এই মিটিংয়ের পরে আমেরিকা মিডিয়াকে জানিয়েছে, তাদের সম্পর্ক খুবই ‘টাফ কম্পিটিশনের’[stiff competition]। তবে একই নিঃশ্বাসে তারা জানিয়েছে যে, ‘আমেরিকা চীনের সাথে যুদ্ধ-সঙ্ঘাত চায় না’ [Price said that in her meeting with Wang, Sherman vowed “stiff competition” with China but also stressed that the US “[did] not seek conflict” with Beijing.] এবং আমেরিকা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতেই থাকবে। এর পাল্টা চীন বলেছে, ‘তিনটা জিনিস দেখতে চাই আমরা।’ [three demands with the second-ranking US diplomat: the United States must not challenge or seek to subvert China’s model of governance; it must not interfere in China’s development; and it must not violate China’s sovereignty or harm its territorial integrity.] আমেরিকা আমাদের মডেলের রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলবে না; চীনা পথের উন্নতি নিয়ে তারা কোনো কথা বলবে না। আর হংকং ও তাইওয়ান চীনের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। ফলে আমেরিকা যেন চীনের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে, এ নিয়ে মন্তব্য করতে না আসে। তবে উভয়পক্ষই পারস্পরিক ডায়ালগ চালিয়ে যেতে চায় বলে জানায়। এক কথায়, না চাইতে কোনো যুদ্ধের শঙ্কা যেন কোনো পক্ষের মনে কাজ না করে তা আগেই মিটিয়ে রাখার মেসেজ তারা আদান-প্রদান করে রাখল।

                                    ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের  মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি

কেন এমনটা হল?
এর কিছুটা হদিস আমরা পাই ভারতের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচিকে দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মনের চরম ক্ষোভ উপচিয়ে প্রকাশ করা বিবৃতি থেকে। এরপর এ নিয়ে ভারতের সামরিক ইন্টেলিজেন্সিয়ার প্রতিক্রিয়া থেকে। যেমন পারভিন শাওনি [@PravinSawhney] নামে এক সাবেক মেজর যিনি একটা ‘ডিফেন্স ম্যাগাজিন’ চালান ও এর সম্পাদক। তিনি টুইট করে লিখেছেন ‘মোদি একেকটা অর্থহীন মন্তব্য করে  যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়ার দিকে ভারতকে নিয়ে যাচছে – যা তিনি কখনো জিততেই পারবেন না, আর এই যুদ্ধ তো এড়ানোযোগ্য!’ [With each mindless remark, India is heading towards war – which it cannot win & is avoidable. ] এ ছাড়াও লিখছেন, এটা ‘মোদির দুর্ভাগ্য যে, তার টপ সামরিক জেনারেল রাওয়াত; অগ্রসর সামরিক ওয়ারফেয়ার সম্পর্কে তার কোনো জানাশোনা নেই!’ [Modi’s misfortune is have Rawat as the top military officer who knows nothing about advances in warfare!]

শেষ দুটা পয়েন্টঃ
আর একমাস পরে আফগানিস্তানে তালেবানদেরকে আমরা কোন ভুমিকায় দেখব? এর সম্ভাব্য দুটা অবস্থান হতে পারে। গত ২০ বছর ধরে তালিবানেরা অনেক কিছু দেখেছে, অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে যা থেকে কী করা যাবে আর কীনা – এসম্পর্কে তারা অনেক ওয়াকেবহাল অবস্থায় এখন তা আমরা অনুমান করতে পারি।।

আমরা পছন্দ করি আর নাই করি এপর্যন্ত দুনিয়া যে জায়গা পর্যন্ত পথ-পরিক্রম করে এসেছে তাতে গ্লোবাল রাজনীতির কিছু ভ্যালুজ তারা তৈরি ও প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা বলছি না সেগুলা সব আদর্শ অথবা দুনিয়ার সকল জনগোষ্ঠিরই স্বার্থ ও কালচারকে তা প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তালেবানেরা যদি আউট-রাইট সেগুলোর বিরোধিতা করে নিজেদের সব ভ্যালুজ নিয়ে চলতে চায় বা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে এটা আগের মতই ব্যর্থ হবে তা বলাই বাহুল্য। এটা হল কো খেলার নিয়ম বদলানোর মত সমস্যা। আপনি গ্যালারিতে বসে থেকে খেলার নিয়ম বদলাতে পারবেন না। বরং প্রথমত তাদের নিয়মেই খেলতে নামতেই হবে। এরপর খেলতে খেলতে খেলার নিয়ম বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে যেতে হবে।

কাজেই একটা পথ হল তালিবানেরা দুনিয়ায় উপস্থিত গ্লোবাল রাজনীতির নিয়ম – পুরান খেলার নিয়ম মেনেই খেলতে নেমে পড়া। এতে সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হবে দায়ীত্বশীল রাষ্ট্রের আচরণ করা। বড়জোর এর সাথে নিজেদের যেসব ভ্যালুজ আছে কোথাও কোথাও এর প্রদর্শনে নেমে পড়া। তবে  আগে ইমেজ তৈরি এদিকটা খেয়াল রাখতে হবে।
আর যেকথা মনে রাখতেই হবে তা হল,  যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সরকারি নানান বাহিনীই কেবল থাকবে। কিন্তু  একই সাথে ঐ দেশ আবার পাশাপাশি কোন সশস্ত্র গ্রুপকেও অপারেট করতে দিতে পারে না।  এক ঘরে দুই পীর হয় না। অথরিটি একজনই বা একটাই হয়।  তবে সাবধান এসব কিছু শুরু হতে পারে আগে দেশে একটা বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল করে নিবার পরেই। কারণ ক্ষমতা দখলের পরেই কেবল একটা কনষ্টিটিউশন আর ওর নানান নিয়ম, আইন-কানুন  তৈরি হতে পারে। এটাই হতে পারে দায়ীত্বশীল পথ। এবার এই পথের সফলতার সম্ভাবনা প্রচুর। প্রধান কারণ  এবার গ্লোবাল রাজনৈতিক শক্তির একটা সফল অংশ তালিবানের পক্ষে আছে।

অন্যদিকে আরেকটা পথ হল, আগের (১৯৯৬-২০০১) বারের মত করে মাঠে নেমে পড়া। যারা গ্লোবাল ইসলামি রাজনীতির সমর্থক তাদের দৃষ্টিতে  হয়ত এটাই সম্ভবত সঠিক পথ। হতে পারে।  তবে এই পথটা আগের বারের মত আপাতত ব্যর্থ হবে, ছিটকে পড়বে। টিকতে পারবে না। এখন যে যেটা পথ পছন্দ করে সে তো সেই দিকটাকেই সহি পথ বলবে!
তবু মুলকথাটা হল, আসলে আমরা যে যেই রাজনীতিই কোন দেশে করতে চাই না কেন –  একেবারেই নতুন বা পুরানা ধারা – এসব কিছুর বাইরে  মূল ফ্যাক্টর হল উপস্থিত গ্লোবাল রাজনীতিতে ও শক্তিতে যারা ক্ষমতাবান থাকে তারা আপনাকে কী চোখে দেখবে! আমরা এটা উপেক্ষা করতে পারি না!
তবু, তালিবানেরা শেষ পর্যন্ত কোন পথ বেছে নিবে সেটা দেখার অপেক্ষা করতে হবে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ৩১ জুলাই  ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “তালেবান ইস্যু ও তিন মিটিং – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a comment