রাশিয়ান ট্রয়কা ভারত নয়, পাকিস্তানকে নিয়েছে


রাশিয়ান ট্রয়কা ভারত নয়, পাকিস্তানকে নিয়েছে

গৌতম দাস

০৯ আগস্ট ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

 

 

India Not Invited to Extended Troika Meeting on Afghanistan

 

তালেবানবিরোধী  প্রচারণা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে।  ফলে তাদের সতর্ক ও বুদ্ধিমান হয়ে পা-ফেলা দরকার। এদিকে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি কখনো কখনো বেশি শক্তি দেখাতে চায়। আটলান্টিক কাউন্সিল [Atlantic Council], এই আমেরিকান থিংকট্যাংকের ফেলো-রা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়েও বুদ্ধিমান দেখাতে চাচ্ছেন নিজেদের। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে হিমশিম খেয়ে, কী বলবেন এখন, কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন তা হাতড়ে অসহায় অবস্থায় মুখ বন্ধ হয়ে আসার দশায় তারা। উপায়ান্তর না পেয়ে তারা এখন আমেরিকাকে সাধুপুরুষ আর মহাভদ্রলোক সাজিয়ে এরপর চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান এমনকি ভারতকেও অভিযুক্ত করে নিজ মান বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করেছেন। বলার চেষ্টা করছেন এসব দেশের স্বার্থের কারণেই নাকি তালেবানেরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফিরে আসার অবস্থা তৈরি হয়েছে।

ঘটনা হল, আমেরিকার আফগানিস্তান দখল কাজটা যে সে সঠিক হয় নাই। এমনকি এর স্বপক্ষে কোনই সাফাই-ন্যায্যতা গত ২০ বছরে একেবারেও সে নুন্যতমও প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই।  কাজেই  এখনও তালেবানেরা খারাপ, ওরা নৃশংস, ওদের ধর্মটা খারাপ, ওরা নারীর উপর অত্যাচার করে ইত্যাদি ক্যাম্পেইন করে নতুন কিছুই আগাবে না।  অতএব,  আটলান্টিক কাউন্সিল – এই আমেরিকান থিংকট্যাংকের ফেলোদের এখন এসব পুরান প্রপাগান্ডায় খ্যান্ত দেয়া, ত্যাগ করা উচিত।  আমেরিকা হেরে গেছে এটাই বাস্তবতা। কাজেই নতুন ভাবে তাকাতে হবে; চাইলে তারা নিজেদেরকে রিভিউয়ে নিতে পারে।  দেখাই যাচ্ছে, রাশিয়ার উদ্যোগে চীনও পাশে দাড়িয়েছে। বাইডেনও যোগ দিয়েছেন। কাজেই নতুন ও ইতিবাচক চোখে  এসব কনসালটেন্টদের সামনে তাকানো উচিত।  বাইডেনের চেয়ে বুদ্ধিমানের ভান করা অপ্রয়োজনীয়।

ঘটনা হল, আমেরিকার আফগানিস্তান দখল কাজটা যে সে সঠিক করেছে এমন কোনই সাফাই-ন্যায্যতা গত ২০ বছরে একেবারেই নুন্যতমও প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই।  কাজেই সেটা এখনও তালেবানেরা খারাপ, ওরা নৃশংস, ওদের ধর্মটা খারাপ, ওরা নারীর উপর অত্যাচার করে ইত্যাদি ক্যাম্পেইন করে নতুন কিছুই আগাবে না।  কাজেই আটলান্টিক কাউন্সিল, এই আমেরিকান থিংকট্যাংকের ফেলোদের এখন এসব ত্যাগ করা উচিত।  আমেরিকা হেরে গেছে এটাই বাস্তবতা। কাজেই নতুন ভাবে তাকাতে হবে; চাইলে তারা নিজেদেরকে রিভিউয়ে নিতে পারে।  আবার ওদিকে ফ্যাক্টস হল, তালেবানদের আইডিয়া মর্ডান না হতেই পারে। কিন্তু সেটা তো তাদের প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে তা কোন সমাধান নয়, এটা তো প্রমাণিত। একমাত্র ডায়লগ চালিয়ে গেলে, এনগেজমেন্ট এটাই পথ।  আর মূলত দরকার আফগানি স্টাবিলাইজিং ফোর্স। যেটা অবশ্যই পুতুল সরকারের কেউ নয়। এটা আপন ভাগ্যন্বেষণের লোক।  তুলনায় তালেবানদের নিয়ে যত আপত্তি আমরা মিডিয়ায় দেখি তবু তাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি।

২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে আমেরিকা তালেবানবিরোধী পুতুল সরকার বসিয়ে যা খুশি তাই করার সুযোগ নিয়ে চলেছিল। অথচ এই কনসালট্যান্ট ফেলো এরাই এখন প্রশ্ন তুলে বলছেন, “কেন আফগানিস্তানে এমন রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি, যেখানে তালেবানের বিকল্প শক্তি তৈরি হয়, কেন তালেবানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকল?” এখন এই প্রশ্ন তাদেরকেই আমরা জিজ্ঞাসা করব। তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে। তাই তারা বুদ্ধিমানের মত আগে নিজেই প্রশ্ন তুলে জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন, কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। এরাই আবার পাকিস্তানকে দায়ী করছেন যে পাকিস্তান হল তালেবানের “আশ্রয়দাতা”। যেন সে জন্য আজকের আফগানিস্তানে তালেবানরা ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ ঘটনা হল আফগানিস্তান বা তালেবানরা কেউই পাকিস্তানের শত্রু বা বিরোধী ছিল না, স্বাভাবিক পড়শি ছিল। আমেরিকানরাই জবরদস্তিতে পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে, আমেরিকার আফগান-শত্রুতাকে যেন পাকিস্তানও নিজের শত্রু জ্ঞান করে। আর যাতে আমেরিকা পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে সেখান থেকে উড়ে গিয়ে আফগানিস্তানে বোমা ফেলে আসতে পারে। অথচ সেই আমেরিকাই (ইন্ডিয়াকে বগলে নিয়ে ) উল্টো পাকিস্তানকে “জঙ্গি আশ্রয়দাতা” দেশ বলে প্রপাগান্ডা করে গেছে।  অথচ কার্যত এভাবে পাকিস্তান তো আমেরিকান হুকুমে চলে যাওয়া এক দেশ হয়েই ছিল। তাহলে এই পাকিস্তান আবার আমেরিকানদের শত্রু তালেবানদের নিজ দেশেই আমেরিকানদের পাশাপাশি আশ্রয় দেয় কেমন করে!

আবার একালে আফগানিস্তান সব খোয়ানো আমেরিকার সেই আফগানিস্তানকে ফেলে পালানোর ইচ্ছা বহুদিনের, সেই ওবামা আমল থেকে। এ কারণে তারাই সে সময় চীনকেও আফগানিস্তানে সংশ্লিষ্ট হতে বলেছিল। গ্লোবাল নেতা হতে চাওয়া চীনেরও কিছু কিছু দায়-দায়িত্ব  নেয়া শুরু করুক এই উদ্দেশ্যে আমেরিকা তার কিছু ভার হাল্কা করতে চেয়েছিল, ফলে চীন তালেবানদের সাথে কথা বলুক মূলত এ লক্ষ্যে।  ফলাফলে  এক থার্ড পার্টি দেশ কাতারে  – তালেবানরা যেন অবাধে যেতে-আসতে ও যে কারো সাথে মিটিং করতে পারে; এ ব্যবস্থা ওবামা আমলেই ২০১৫ সাল থেকে চালু করা হয়েছিল। অরিজিনালি ‘সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশন’ বা এসসিও জোট গঠন করার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এটিই। যে কারণে সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশ আর চীন ও রাশিয়াকে নিয়েই গঠন করা হয়েছিল এসসিও। অথচ আজ আমেরিকান ফেলোরা প্রপাগান্ডা শুরু করেছেন যেন চীন-রাশিয়া নিজ স্বার্থেই তালেবানদের ফেরত আনছে। আর ওদিকে বিবিসি খবর দিচ্ছে কাতারের আলোচনা আরো পুরানা ২০১৩ সালের উদ্যোগ।

আবার ওবামার পরে ট্রাম্প আরো জব্বর উদ্যোগী যেন পারলে এখনই আফগানিস্তানকে ফেলে নিজ সেনাদের নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু তিনিই তো সেনা প্রত্যাহারের আলোচনা আফগান পুতুল সরকারের সাথে করেননি; বরং সরাসরি কেবল তালেবানদের সাথেই কথা বলেছিলেন, ‘ডিল’ করেছিলেন। সেনা প্রত্যাহারের শেষ দিন কী হবে, তাও পর্যন্ত ঠিক করেছিলেন; যা বাইডেন ক্ষমতায় এসে পুনঃঅনুমোদন দিয়ে সেটি ‘তারও চুক্তি’ বলে স্বীকৃতি দেন। অথচ ট্রাম্প তালেবানদের সাথে কিসের বিনিময়ে কী ডিল করে গেছেন, সেটা প্রকাশ্য নয়। তালেবানরা নিজ উদ্যোগে ক্ষমতা দখল করুক আর এতে ট্রাম্পই অনুমোদন দেয়ার বিনিময়ে- এ শর্তেই আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার বাধাহীন করে দিয়ে যাননি, তা আমরা কি নিশ্চিত? সে জন্যই কি থিংকট্যাংক ফেলোরা আমেরিকা বাদে বাকি সবাইকে আগাম দায়ী করা শুরু করেছেন যেন তাদের জন্যই তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে এসে যেতে পারে বলে – প্রপাগান্ডা শুরু করেছেন। মানে তারা কলসালট্যান্ট এই পরিচয় ধুলায় লুটিয়ে একেকজন ‘প্রপাগান্ডিস্ট’ পরিচয় নিতে চাইছেন! অথচ কী চুক্তি হয়েছে অন্তত ইনফরমালি কিছু তাদের অজানা থাকার কথা নয়!

রাশিয়ার পুতিনের ট্রয়কাঃ
অরিজিনালি ট্রয়কা (troika) শব্দের আক্ষরিক অর্থ সেকালের রাশিয়ান তিন ঘোড়ায় টানা গাড়ি; অর্থাৎ তিন শক্তির সমন্বয়ে কোনো একশন। আর এখন এখানে  শক্তি বলতে এরা হল রাশিয়ার পুতিনের উদ্যোগের তিন শক্তি   – রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন। হ্যাঁ, অবশ্যই তারা পরস্পর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি হলেও এরা আফগান-তালেবান ইস্যুতে একসাথে কাজ করতে নেমেছে। আর একাজে মানে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর যেন আফগানিস্তানে কোনো বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা বা সশস্ত্র তৎপরতার ঢল নেমে না আসে, অতীতে যেমন আফগানিস্তানে অনেকবারই ঘটেছে। সেটা ঠেকানোর কাজ।  কিন্তু সেটাই বা ট্রয়কা চাচ্ছে কেন?

খুবই সংক্ষেপে বললে, সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিবদমান পক্ষ ও স্বার্থগুলো একত্রিত হয়ে একটি রাজনৈতিক নেগোশিয়েশনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি থিতু সমাজ, একটি ফাংশনাল সরকার আর ন্যূনতম আইনশৃঙ্খলা স্থাপন করতে যেন সক্ষম হয়, সে কাজে সহায়তা করা এই ট্রয়কার উদ্দেশ্য।

গত ২০১৮ সালের শেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তালেবানদের সাথে কথা বলার, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেনা প্রত্যাহার। কারণ তার সরকারের অর্থ আফগানিস্তানে ঢালার অপচয় চলছিল, কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল ছাড়াই। তাই তিনি এক আফগান অরিজিন আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট  – জালমে খলিলজাদেকে [Zalmay Mamozy Khalilzad, an Afghan-American diplomat]  সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে তাঁর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন, যাতে তিনি তালেবানদের প্রধান আলোচক বা নেগোশিয়েটর মোল্লা আবদুল গনি বারাদরের সাথে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার নিয়ে কথা শুরু করতে পারেন। আর মূলত প্রথম থেকেই তালেবানদের শর্তানুসারে আফগান পুতুল সরকারের কোনো প্রতিনিধিই তাদের দুপক্ষের কোনো সভাতেই না রাখার নিয়ম চলে আসছে। কারণ এতাই তালেবানদের শর্ত ছিল। শেষে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে একটি চুক্তিতে তারা পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছিল আমেরিকার নির্বাচনের বছর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে; যদিও এর বাস্তবায়নের মূল উদ্যোগের মাঠের কাজ গড়িয়ে যায় পরের বছরে। অর্থাৎ তত দিনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শপথ নিয়ে নিয়েছেন।

কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরে অনেক স্থানে বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তালেবানদের সশস্ত্র তৎপরতা। এ ঘটনায় তাই উদ্বিগ্ন হয়ে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল পুতিনের রাশিয়া। কেন? সুনির্দিষ্ট করে রাশিয়ান স্বার্থ কী?

২০০৮ সালে সেকালের জি-৮ গ্রুপ থেকে রাশিয়াকে বের করে দেয়ার পর (আবার তা জি-৭ হয়ে যায়) রাশিয়া-আমেরিকার সম্পর্ক একেবারেই নিচে নেমে গিয়েছিল। তা কখনোই ভালো হয়নি। কিন্তু আফগানিস্তানের যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা আজো রুশ স্বার্থের জন্য অনেক কিছু যায়-আসে, তাই গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল কারণ, সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশগুলোর স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই রাশিয়ার স্বার্থ। এসব দেশ অতীতে জার সাম্রাজ্যের অধীনে দখলে গিয়ে প্রথম রাশিয়ান শাসিত  অঞ্চল হতে শুরু করেছিল।  ফলে সেই থেকে পরে (১৯১৭-১৯৯১) কমিউনিস্ট আমলেও শুরু থেকেই এই সেনট্রাল এশিয়া কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে যায়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে সেন্ওটাল এশিয়ান দেশগুলো আলাদা আলাদা দেশ হয়ে যায় তবুও তা বড় পাহারাদার বা রাশিয়ান বলয়ের দেশ হয়েই থেকে যায়। আসলে এখনও পর্যন্ত আশপাশের রাষ্ট্রগুলোর ভিতর কোন র‍্যাডিক্যাল ইসলামী সমাজ-রাজনীতির চিন্তার প্রভাবে যেন সেন্ট্রাল এশিয়ায় সাজানো রুশ ভারসাম্য নষ্ট না হয়ে যায়, এ দিকে পরের রাশিয়ার সব শাসকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল, এখনো আছে। এটাই কোর রুশ স্বার্থ।

এমনকি যেমন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে খোমানির ইরান বিপ্লবের পরে এর প্রভাবে না সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ আন্দোলন-বিপ্লবের ছাপ পড়ে যায় বা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে; এই ভয়ে ভীত হয়েই ছয় মাসের মধ্যে ব্রেজনেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরেই আগাম আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। কারণ কার্যত আফগানিস্তান হল ইরান থেকে সেন্ট্রাল এশিয়াকে [The region consists of the former Soviet republics of KazakhstanUzbekistanTajikistanKyrgyzstan, and Turkmenistan.] বেশির ভাগ জায়গায় আলাদা করার এক ভুখন্ড ও দেয়াল। তাই সেই ইরান বিপ্লবের পর শুরু হয়ে আফগানিস্তান আজো এক হট স্পট ও আন্তর্জাতিক ইস্যু।

এ কারণে রাশিয়া-আমেরিকা সম্পর্ক যতই নিচে থাকুক না কেন, পুতিনের রাশিয়া আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা দেখতে পাওয়ার উদ্দেশ্যে ও স্বার্থে রাশিয়াকে অনেক কিছু করতেই হয়। তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে আমেরিকা ও চীনকে সাথে নিয়ে ট্রয়কা গড়ে নিয়েছেন পুতিন। সেই পুরনো উদ্দেশ্য, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা বা কোন রেডিক্যাল ইসলামি চিন্তার ছাপ বা আঁচ যেন মধ্য এশিয়ার দেশে না পড়ে যায়। এদিকে চীন এখন আমেরিকার বদলে গ্লোবাল নেতা হওয়ার দাবিদার। ফলে তারও দায়-স্বার্থ আছে। ফলে রাশিয়া ঢাকলে তাকেও অংশ নিতেই হয়েছে। এছাড়া আফগানিস্তান, ইরান ও সেন্ট্রাল এশিয়ার সাথে চীনের খোদ সীমান্তই আছে।

তাহলে মুলকথা, এই ট্রয়কায় চীন ও রাশিয়া এই দুই রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতা থাকলেও মিলের ভিত্তিটা ঠিক কী? কেন?
এই ভিত্তিটাই হল, এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডার, যার কেন্দ্রে আছে জাতিসঙ্ঘ। ১৯৪৫ সালের পরে যে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা জাতিসঙ্ঘকে কেন্দ্র রেখে তৈরি করা হয়েছিল, সেটাই এর ভিত্তি। কেন?
এই জাতিসঙ্ঘকেন্দ্রিক গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা  – যেটা গত ৭৫ বছর ধরে ফাংশনাল হয়ে আছে, এটি নিয়ে অজস্র অভিযোগ এবং এর নানান খুঁত ও ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তা সত্ত্বেও এটাই দুনিয়াতে একমাত্র গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডার কায়েম করা এক সিস্টেম। আর এটা না থাকার মানে ১৯৪৫ সালের আগের সময়ে ফিরে যাওয়া, যখন যুদ্ধ করারও কোনো নিয়মনীতি মানার বালাই নেই; আইনকানুন  বা প্রটেকশন নাই।  চাইলে যেকোনো জনগোষ্ঠীকে ‘নির্মূল’ করে দেয়াও ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। জর্মানিতে হিটলারের হাতে ইহুদি নিধন ও নির্মুলের চেষ্টা এর সবচেয়ে ভাল প্রমাণ। রেসিজমও কার্যত বৈধ ছিল মানে কোনো বাধা ছিল না – যা খুশি, জোর যার রাজ্য তার এবং সর্বোপরি কাউকে কোন ভুখন্ড দখল নেয়া বা কলোনি করে রাখাও ন্যায্য ছিল।  শুধু তাই না  কলোনিদখল করে রাখা এটাই সেকালের  প্রধান ফেনোমেনা ও প্রচলিত ঘটনা ছিল। সারা অখন্ড ভারত বৃটিশ কলোনি হয়ে ছিল।   কাজেই সেই পরিস্থিতির বিপরীতে  জাতিসংঘ – এটাই সবেধন নীলমনি, এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেমের ভারকেন্দ্র। আর এটি দাঁড়িয়ে আছে যে ভিত্তি-অবস্থানের  উপর তা হল, কোনো ভূখণ্ডের নাগরিক বাসিন্দারা হল আসল ক্ষমতার উৎস;  তারাই একমাত্র নির্ধারক যে কোনো ভূখণ্ড কার দ্বারা শাসিত হবে। ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণ এই নির্ধারণের একমাত্র হকদার – এ ভিত্তিতে। তাই এটা মূলত অন্য কারো দেশ দখল বা কলোনি করে নেয়ার বিরুদ্ধে এক রক্ষাকবজ। যেকারণে কাশ্মীরের রাজা কাশ্মীর  নেহেরুর ভারতের সাথে যুক্ত করে দিয়ে গেছে, এই দাবি ভিত্তিহীন। কারণ একথা বলবার হকদার একমাত্র কাশ্মীরের জনগণ, কোন রাজা নয়।  আর সেখান থেকেই, এই আইনিভিত্তি – পরোক্ষেও রাজা-বাদশাহদের কোন ভুখন্ডের শাসন ক্ষমতাকেও বৈধতা দেয় না। তবে একটা ছাড় আছে যে, আগে থেকে চলে আসা কোনো রাজতন্ত্র বা বাদশাহতন্ত্রকে জাতিসঙ্ঘ অবৈধ বলতে চায় না, যতক্ষণ না ওর অভ্যন্তরীণ জনগণ সংগঠিত হয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ চায় বা দাবি করে। অর্থাৎ জাতিসংঘের ফর্মুলা হল গণভোটে চলে যাওয়া ও সে রায়ের ভিত্তিতে দাবির ফয়সালা করা।

ঠিক এ কারণে ট্রয়কার কাজের ভিত্তি জাতিসঙ্ঘ ও একে কেন্দ্রে রেখে তৈরি হওয়া গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডার-টা। আর ২০১৯ সালের মার্চ থেকে এই ট্রয়কা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মিটিং করে আসছে, আর সেখানে জাতিসঙ্ঘের পাশ হওয়া বিভিন্ন প্রস্তাবকে ভিত্তি করেছে এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিকেই সংশ্লিষ্ট করেছে। আর তাই সেখানে ৩০ নভেম্বর ২০২০ এক রেজ্যুলেশনের তিন নম্বর সিদ্ধান্ত হল এরকমঃ [কথাগুলো ট্রয়কার এক বিবৃতি থেকে নেয়া]

3. As stated in the UNSC resolution 2513 (2020), we do not support the restoration of the Islamic Emirate and we call on the Government of the Islamic Republic and the High Council for National Reconciliation to engage openly with their Taliban counterparts regarding a negotiated settlement.

অর্থাৎ, ট্রয়কা জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের (UNSC) ২০২০ সালের এক সিদ্ধান্ত অনু- সমর্থন করছে। আর যেখানে বলা হয়েছে, তারা ‘তালেবানদের ইসলামিক আমিরাতকে পুনঃস্থাপন সমর্থন করছে না”। বরং আহ্বান রাখছে যেন আফগানিস্তানের বিবদমান সব পক্ষকে সাথে নিয়ে সবাই সংশ্লিষ্ট হয়ে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছায় এবং বিবাদের একটি শান্তিপূর্ণ সুরাহা যেন হয় এবং তা করতে উতসাহ ও সহায়তা দিতে চায়।

এসব প্রস্তাবকে কিভাবে দেখব ও বুঝব?
প্রথমত শুরুতে যেমন বলেছি আমেরিকান থিংকট্যাংক ফেলো যারা সব দোষ তালেবানের বলে তালেবানবিরোধী প্রপাগান্ডায় নেমে গেছেন, অথচ এরা জানেন একটি  ট্রয়কা-উদ্যোগ কাজ করছে ফাংশনাল; যেখানে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন এই তিন শক্তি সক্রিয়। অথচ এরা তালেবানদের এক  শত্রুজ্ঞান করে আগাম কোন ক্যাম্পেইন করতে বসেনি। কেবল ডায়লগে সবাইকে নিয়ে বসে একটি পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট করে নিতে বলছে, সাহায্য করতে চাইছে। অথচ এই থিংকট্যাংক ফেলোরা তালেবানবিরোধী প্রপাগান্ডায় আগাম নেমে গেছেন, যা আসলে ভারতের অবস্থান! এমনকি এ্টা আমেরিকার অবস্থানও নয়। উপরের ট্রয়কার বিবৃতিটা আমেরিকান সরকারি ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া যার শিরোনাম – Joint Statement on Extended “Troika” on Peaceful Settlement in Afghanistan.।

এখন অনেকে মনে করতে পারেন যে এই সেট হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া গ্লোবাল পলিটিক্যাল ব্যবস্থাটা আপনি পছন্দ করেন না, তা হতেই পারে। জাতিসঙ্ঘ এর একটা গ্লোবাল পলিটিক্যাল ব্যবস্থা দাঁড় করানোই শেষ কথা নয়। বরং কেবল শুরু যাকে অনেক পথ হাঁটতে হবে, বদলাতে হবে, অন্য অনেক ‘অপরকে’ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, ডায়লগ করতে হবে। যেমন ধরা যাক, আপনি এক ইসলামিস্ট অথবা কোনো কমিউনিস্ট, যিনি গ্লোবাল পলিটিক্যাল ব্যবস্থাটাকে পছন্দ করেন না বা এটা আপনার ফেভারে বলে দেখেন না। সেক্ষেত্রে কী করণীয়?

আসলে এ ব্যাপারটা অনেকটা আগে থেকে গড়ে থাকা একটি শহরের মত, যেখানে ওই শহরের ভেতরে বাসিন্দাদের বসবাস ও থাকা বা চলাচল ইত্যাদির জন্য সেখানে প্রচলিত নিয়মকানুন আইন কনভেনশন সবই আছে। ধরা যাক, আপনি এখন বাইরে থেকে এসে ওই শহরেই বাস করতে চাইছেন। কিন্তু আপনার দাবি ওদের সব নিয়ম আইনের কিছুই আপনি মানেন না; কারণ এগুলো তৈরির সময় আপনার মতামত নেয়াই হয়নি। এখন – এমন কথা বলে যদি ওই শহরে ঢুকতে যান এতে ফলাফল হতে পারে এই যে, ওরা উল্টো আপনাকেই আউটকাস্ট, কী বাইরের লোক বা গোঁয়ার, গাঁইয়া অভব্য আনকুথ কিংবা ধরেন জঙ্গি বলেই বের করে দিতে পারে। আইনের শাসন না মানা লোক বলে ‘অমার্জিত’ ট্যাগ দিয়ে আপনাকে একা করে দিতে পারে; আর এমন ইমেজের কারণে হয়তো আপনি আর কারও কোনো সহানুভুতি বা আপনার কী হয়েছে, তা শুনানোর মত কাউকেই পেলেন না- এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে রাখার দশায় পড়ে যেতে পারেন।

তা হলে এদেরকে মোকাবেলার উপায় কী?  আছে। একারণে ঐ শহরে ঢুকতে গেলে আপনাকে পরিকল্পনা-কৌশল নিয়ে এগোতে হবে। তাই সম্ভবত এর চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে প্রথমত আপনি তাদের নিয়ম মানেন বলে প্রবেশাধিকার তো নিয়ে নিবেন আগে। এরপর ওদের নিয়ম মেনেও চলেন। আর এবার কেউ আপনার পাল্টা নিয়মটা যা আপনি চালু করতে চান, সেটা কেন বেশি ভালো সেটা দেখান ও এই প্রচার চালান আশপাশে। ওই শহরের বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটে নিজের ভালো চিন্তাগুলো তুলে ধরার চেষ্টাও করতে পারেন। এরপর সময়ে আপনার দলে ভারী বুঝলে এবার তখন ঐ শহরের পুরানা সব নিয়ম বদলানোর চেষ্টা বা উদ্যোগ নেন।

অর্থাৎ এর মূল কথাটা হল – খেলার পুরনো নিয়ম বদলাতে চাইলে দূরে গ্যালারিতে বসে থেকে তা বদলাতে পারা যাবে না। উল্টো আপনাকেই এরা উপড়ে তুলে ফেলে দিতে পারে। এর চেয়ে বরং খেলায় অংশ নিয়ে খেলতে খেলতেই এমন পুরনো নিয়ম বদলাতে চেষ্টা করতে পারেন। এর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই পথ না ধরলে কী হবে?

সেটা একটি উদাহরণে বলা যাক। গত ৩০ জুলাই আমাদের স্থানীয় প্রথম আলো দৈনিকের খবরের শিরোনাম – “ফজলের ‘কৌতুক’ চিরতরে স্তব্ধ করল তালেবান”। ফজল, তিনি আফগান পুতুল সরকারের এক পুলিশ অফিসার ফজল মোহাম্মদ। তিনি অনলাইনে হাস্যরসাত্মক নানান ভিডিও পোস্ট করার জন্য আফগানদের কাছে তার পুলিশ পরিচয়ের চেয়ে ‘কৌতুক অভিনেতা’ বলে বেশি পরিচিত। কিন্তু তালেবানরা নাকি প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তিনি বাড়ি ফেরার পর তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে হত্যা করে। এ ক্ষেত্রে হত্যার কথা শুরুতে অস্বীকার করলেও পরের সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তার পরই তাকে হত্যার কথা স্বীকার করে তালেবান। এ হলো খবরটার সারকথা। তবে অবশ্য আফগানিস্তানে অনেক সময় এসব হত্যা প্রকাশ্যেও ঘটে থাকে।

এখানে তালেবানদের জন্য খবরটার  সবচেয়ে খারাপ দিকটা  হল, এটা তার ইমেজ ধ্বংস করেছে। সেটা তালেবানেরা আইনের শাসন মানে না আর জঙ্গি ট্যাগ লাগানো ধরণের ইমেজ সৃষ্টির প্রচেষ্টা অবশ্যই। তাই খবরটা যতটা সত্যি তাতে তালেবানদের এমন স্টাইলের তৎপরতা আত্মঘাতী!

কোনো যুদ্ধের মাঠে আপনি বা আপনার শত্রু খুন হয়ে যাওয়ার একটা আলাদা অর্থ হয়। সামরিক ইস্যুতে এর ক্রিমিনাল আইনে মামলা হয় না। তবে এর বিপরীতে তুলনামূলক শান্ত এক জনসমাজে আপনি ঘর থেকে কোনো জেনুইন অপরাধীকেও যদি উঠিয়ে এনে জনসমক্ষে মেরে ফেলেন এর ফল হবে উল্টো। আপনি অপরাধী হবেন। এছাড়া নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ, ওই সময়ে অসহায় যে মানুষটা খুন হচ্ছে, তা যারা দেশে-বিদেশের লোক দেখবে  এরা প্রায় সকলে নিজেকে আবিষ্কার করবে ঐ খুন হওয়া নিরস্ত্র লোকটার ভিতরে। ফলে খুন হয়ে লোকটার প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে উঠতে পারে। আর এটাই আপনার জন্য বিরাট নেতি-ইমেজ তৈরির উপাদান হয়ে উঠবে। বলাই বাহুল্য এই ইমেজের জন্য এবার আপনিই হেরে যাবেন।  আপনি নৃশংস খুনি, কিংবা আপনার ধর্মটাই খারাপ এমন বয়ান উঠে আসতে পারে। তা হলে করণীয়?

এমন ঘটনা যুদ্ধের মাঠের খুনোখুনি কিনা সেটা এক বড় প্রশ্ন। যদি তা হয় বুঝাতে চান, তবে আগে যুদ্ধ ঘোষণা করে নেয়া হয়েছে সে প্রমাণ হাজির দেখান।  নইলে অপর বিপরীত পথ হল,  কাউকে (সে অপরাধী হলেও) হত্যা করার আগে তার বিচার হতে হবে। এখন বিচার মানে কিন্তু অনেক কিছু। যার শুরু সেই কনস্টিটিউশন থেকে। এরপর রাষ্ট্র সরকার আইন, বিচারব্যবস্থা সেটআপ ইত্যাদি অনেক কিছু। মানে আসলে সবার আগে ক্ষমতা দখল করে নিতে হবে। এরপর আবার অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে এবং স্থায়ী ও আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত আদালত থাকতে হবে। আর গ্রেফতারকারীই পরে বিচারক এবং তিনিই আবার শাস্তি বাস্তবায়নকারী, তিনি এমন হতে পারবে না। মানে পুলিশিং আর বিচারক একই লোক হতে পারবে না। নইলে তো যে কেউ যে কাউকে অপরাধী বলে মেরে ফেলার অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। আর এখানেই দেশে-বিদেশে আপনার ইমেজ আপনার রাজনৈতিক চিন্তা কেমন, আপনি দায়িত্বশীল ক্ষমতাবান মানুষ কি না – এসব বহু প্রশ্ন ভর করবে। বলাবাহুল্য, আপনি জঙ্গি, আপনি অমানবিক গুণের বা আপনি নৃশংস, কাজেই আপনার ধর্মটাই খারাপ- এই ইমেজ দাঁড় করানোর জন্য একদল লোক অবশ্যই হাজির থাকবে। অর্থাৎ আপনি নিজেই ২০০১ সালের মতো নিজেকে উপড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়ার পক্ষে কাজ করতে পারেন না।  এমন বোকামির অর্থ হয় না।  কাজেই আপনার  দায়ীত্বশীল ও গঠনমূলক ইমেজ অবশ্যই খুবই জরুরি।

সারকথায় একালের দুনিয়াতে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে একটা কিছু আছে, একে অবজ্ঞা করবেন না। একে মানুন আর না-ই মানুন, একে আগে বুঝুন। এরপর এগোনোর পদক্ষেপ কৌশল ঠিক করেন। নইলে বেঘোরে মার খেয়ে উলটা আপনিই হারিয়ে যাবেন।  এরা আপনাকেই উপড়ে ফেলে দিবে!

আফগানিস্তান নিয়ে এত হইচইয়ের কারণ কী?
কথা শুরু করেছিলাম ট্রয়কার গঠন দিয়ে। পরে এই ট্রয়কা নিজেকে প্রথমে নিজেকে বর্ধিত করে, পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আর তাতেই ঘটে প্রথম বিস্ফোরণ। কেন?

প্রথমত, পাকিস্তান হল ল্যান্ডলকড আফগানিস্তান ভূখণ্ডের এক প্রবেশদ্বার, যা সমুদ্রের পর  পাকিস্তানের পেরিয়ে এরপর সহজেই প্রবেশ করা যায়। আমেরিকা এজন্য আফগানিস্তানে হামলা চালানোর আগে পাকিস্তানকে হাত করে, বাধ্য করে, ঘাঁটি বানিয়েই নিয়েছিল। অতএব, আফগানিস্তানে ব্যবহারিক যেকোনো পদক্ষেপের আগে ট্রয়কাকে পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে নেয়া জরুরি ছিল। কাজেই রাশিয়া নিজে উদ্যোগ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে কথা বলে সসম্মানে তাকে ট্রয়কার বাড়তি সদস্যের ভূমিকায় জুড়ে  নিয়েছিল।

কিন্তু রাশিয়া আমেরিকা বা চীনের ত্রয়কার এসব ব্যবহারিক সমস্যার দিকটি ভারতের বুঝার বা আমল করার মত অবস্থান নিলে ভারতের চলে না। এমনকি মনে মনে মানলেও তা স্বীকার করা অসম্ভব। কারণ? ও পাকিস্তান- এটা তো একটা জঙ্গি রাষ্ট্র, ‘তালেবানদের মদদ দেয়া রাষ্ট্র’ ইত্যাদি গত ২০ বছর ধরে ভারত তার দেশের ভিওতরে বাইরে  প্রপাগান্ডা করে এসেছে।  নিজের সেই কথা তো এখন ভারত টিকাতে পারছে না। মানে এখন প্রশ্ন হল, পাকিস্তান যদি জঙ্গি রাষ্ট্রই হয়, তা হলে তো সে রাশিয়া, আমেরিকা বা চীনের পাশাপাশি একই মর্যাদার আসনে বসতে পারে না। আর বাস্তবে যদি বসতে দেখা যায় তার মানে পাকিস্তান জঙ্গি রাষ্ট্রই নয়, দায়িত্ববান রাষ্ট্র। তাই যদি রাশিয়া পাকিস্তানের পাশাপাশি ভারতকেও ট্রয়কায়  সাথে নিত, তাতে  হয়ত ভারতের কিছুটা মুখরক্ষা হত।   মানে ভারত নিজেই এখন আগের ইসলামবিদ্বেষী নিজের ছড়ানো ঘৃণার মধ্যেই নিজেই আটকে গেছে!

ওদিকে রাশিয়া আবার পাকিস্তানকে ট্রয়কার ভিতরে নিয়ে ট্রয়কাকেই পরে ট্রয়কা-প্লাস [troika+] নাম দিয়ে নিয়েছে, ফলে তাতে ভারতের জ্বলুনি আরো বেড়েছে। কিন্তু এই ঘটনা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির আর বাইরে খুবই কম প্রচারিত ঘটনা বলে এত দিন ভারত এই লজ্জা লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল। যদিও তাদের মিডিয়া গত মার্চ ২০২১ থেকেই জানত যে ভারতকে বাদ দিয়ে ট্রয়কার মিটিং চলছে [ India not part of Russian meet on Afghanistan]।  কিন্তু এখন, গ্লোবাল মিডিয়ায় আফগানিস্তানে কী হচ্ছে এটা এক শীর্ষ ইস্যু। তাই মিডিয়া জুড়ে  আগাম ঘোষণা দিয়ে বলা হচ্ছে,  আগামি ১১ আগস্ট হবে ট্রয়কা+ এর পরের মিটিং। আর সাধারণত এসব মিটিং  এতদিন হয়েছে রাশিয়ায় না হলে কাতারে। কারণ কাতার ২০১৫ সাল থেকে আফগান-তালেবান ইস্যুতে নিরপেক্ষ হোস্ট। তাই সেও ট্রয়কার মিটিংয়েও প্রতিনিধি পাঠায়; সাথে ওই মিটিংয়ে থাকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ইরান ও তুরস্ককেও নেয়া হয়েছে। এতে এখন ভারতের মিডিয়াও আর দেশপ্রেমের জোশে মোদি-জয়শঙ্করকে জবাব দাবি করে  পার পাচ্ছে না।  একেবারে সবারই ইজ্জতের সওয়াল হয়ে গেছে।  কারণ এখন ভারতের চেয়ে  (কথিত জঙ্গী) পাকিস্তান রাষ্ট্র এখন গ্রহণযোগ্য আর দায়ীত্বশীল রাষ্ট্র হিসাবে  আমেরিকা, রাশিয়া বা চীনের সাথে সমান মর্যাদার টেবিলে বসেছে কথা বলছে। এটা ভারতে বসে দেখা যায় না! এমনই কঠিন জলুনি!   আর এসব কথা বাংলাদেশেও  ভারত প্রভাবিত মিডিয়ায় বড় করে আসায় বাংলাদেশেও ভারতের এই বেইজ্জতির খবর ছড়িয়ে পড়েছে।

রাশিয়া ভারতকে এমন বিমুখ ও বেইজ্জতিতে ফেলল কেন?
রাশিয়ার সমস্যা ভিন্ন! রাশিয়া মনে করে এই আগস্টের শেষে সেনা প্রত্যাহারের পরে বর্তমান আফগান পুতুল সরকারের আর ক্ষমতায় থাকা ঠিক নয়। ,[However, the Russian side appears opposed to the continuation of the Ghani government and favours an interim set-up ……]   বরং অন্তর্বর্তীকালীন ও সবার প্রতিনিধিত্বমূলক এক সরকারের থাকা উচিত, যার কাজ হবে সবাইকে নিয়ে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। আর এর বিপরীতে ভারতের অবস্থান হলো, বর্তমান পুতুল সরকারে হাত দেয়া যাবে না” [While India has backed the government of President Ashraf Ghani…।]।’ আরো আগিয়ে ভারত বলছে, গায়ের জোরে পুতুল সরকারকে বদলালে ভারত মানবে না। যেন ভারত না মানলে বিরাট কিছু যায়-আসবে!

কথা হল, প্রথমত ক্ষমতা তো মুরোদেই মানে গায়ের জোরেই বদলাতে হয়, বদলায়। যদিও এ্টাই শেষ নয়। এরপর ক্ষমতা নিজের কাছে রেখে কিন্তু  সব পক্ষকে নিয়ে প্রপার সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন গড়তে তো অসুবিধা নেই।
আর তালেবানদের ক্ষমতা দখল না করতে কেউ স্পষ্ট করে তো কিছু বলেনি। ত্রয়কাও কোন আগাম আপত্তি প্রকাশ করে নাই। এমনকি ব্রিটেন আগাম জানিয়েই দিয়েছে, সে স্বীকৃতি মানে কাজ করতে রেডি। কাজেই তালেবানরা ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়ার পর তখন ত্রয়কার কথা শুনে তাদের কনসার্ণ গুলো আমল করে চলতে অসুবিধা হবার কথা না! যেমন তারা সব পক্ষীয় সরকার ইত্যাদির করতে গেলে অসুবিধা কী?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ০৭ আগষ্ট ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “রাশিয়ার ত্রয়কা ভারতের বুকে শেল মেরেছে – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a comment