অবরোধ আলোচনায়ঃ
গিভ এন্ড টেকের ‘বস্তুই’ নাই
গৌতম দাস
২০ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
Recent US sanctions On China, Bangladesh
Bangladesh protests US sanctions against RAB
গত ১০ ডিসেম্বর বাইডেনের আমেরিকার ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের বিশেষ প্যারামিলিটারি বাহিনী ‘র্যাব [RAB] এর চলতি এবং সাবেক সাত অফিসার ও খোদ প্রতিষ্ঠানটার ওপর অবরোধ বা স্যাংশন [sanction] আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এতে সাবেক র্যাব প্রধান ও বর্তমান আইজি পুলিশ বেনজীর আহমেদও আছেন। এদিকে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদেরও আমেরিকান ভিসা বাতিল করে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে বলে দেশের মিডিয়ায় রিপোর্ট এসেছে।
বাংলাদেশে আমেরিকার এই অবরোধ আরোপের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এখন কোথায় কতটুকু পড়বে অথবা এর প্রতিক্রিয়া কী কী, কতদূর হতে পারে অথবা সরকার টিকে থাকতে কোনো সমস্যায় পড়বে কি না – এসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা এখনকার সময়ের প্রধান আলোচনার বিষয়। তবে এটা বলাই বাহুল্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যেকোনো বাহিনীর সদস্যরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে এখন অন্তত এসংক্রান্ত পুরো পরিস্থিতি ও এর অভিমুখ নিশ্চিত ঠাহর করার আগ পর্যন্ত সতর্ক হয়ে থাকতে চাইবেন।
সবচেয়ে বড় কথা, গত ১৩ বছরে নানা অনিয়ম রেজিমে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই ব্যবহারিক রেওয়াজ আবার একটু থমকে দাঁড়াতে চাইবে। “আবার” বললাম এ জন্য, যেমন গত ২০১৯ সালে ক্রসফায়ারে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল চার শতাধিক [……২০১৮-২০১৯ সালে ৪২৪ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন……। ]। কিন্তু পরের বছর তা কমে এর মাত্র ১০ ভাগে নেমে এসেছিল। কারণ, কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড। অনেকের অনুমিত ব্যাখ্যাটা এরকম যে, বাহিনীতে দলাদলি বা সহমত ভেঙে যাওয়ায় রেকর্ড উল্টো হয়েছে। কাজেই এবার অবরোধের ঘটনাতেও এই শক থেকে এবার ডাটা কী আসে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে কর্মি-জনবলের মনোবলের ওপর প্রভাব পড়া যে খুবই সম্ভব তা সম্ভবত সরকার আমল করছে। যেমন ১০ তারিখের পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের প্রধান প্রতিক্রিয়া হল একেবারে ‘ডিনাইয়াল’[denial] বা পুরোপুরি অস্বীকার করা। সম্ভত তাদের অনুমান, গুরুত্বপূর্ণ আমলা ও দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে হলে এটাই পথ।
এই অবরোধের সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এক নির্বাহী আদেশে ইও নং ১৩৮১৮ [Executive Order (E.O.) 13818] হয়েছে এবং বাইডেন প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা পররাষ্ট্র বিভাগসহ আরো অনেক বিভাগের মিলিত তৎপরতার সার ফলাফলে এই অবরোধ আরোপ ঘটেছে। কিন্তু সবশেষে এর পাবলিক ঘোষণাটা দেয়া হয় ট্রেজারি বিভাগ থেকে। কেন?
কারণ বিষয়টা মূলত ফাইন্যান্সিয়াল এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বিষয়ক। আরেকটু খুলে বললে দুনিয়ায় যত বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয় তার ৮৫ ভাগ বা তারও বেশি হয় আমেরিকান ডলারে; যার সোজা মানে সব লেনদেনের একটা না একটা পর্যায়ে তা হতে হয় ডলারে আর এর পরেই তা কনভার্ট হয়ে নিজ নিজ দেশীয় মুদ্রায়। আর ডলারে হওয়া মানে, কোনো না কোনো স্থানীয় (যেমন ঢাকার) কোন ব্যাংকের আবার কোন এক আমেরিকান ব্যাংকে (ডলারে) যে অ্যাকাউন্ট থাকে এর মাধ্যমে তা হয়েছে। তাই ডলারে লেনদেন মানেই আমেরিকান ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের অংশ হওয়া ও তা ব্যবহার করা। মানে ধরা যাক, বাংলাদেশে স্থানীয় ‘ন্যাশনাল ব্যাংকে’ আমার অ্যাকাউন্ট আছে। এই ব্যাংকের আবার কোনো আমেরিকান ব্যাংকে ডলার-অ্যাকাউন্ট আছে। এতে এখন মূলত আমার হয়ে সেই ডলার-অ্যাকাউন্ট কোনো লেনদেন সম্পন্ন করে দিয়ে থাকে। এখানে যদিও আমার হয়ে আমার দেশী মুদ্রার ব্যাংক অনেক লেনদেন করে দেয় বলে আমরা ডলারে লেনদেন ব্যাপারটা টের পাই না। কিন্তু যখন আমার নামে ‘অবরোধ আরোপ’ করা হবে এর অর্থ, আমার জন্য এই ‘আমেরিকান ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমকে’ ব্যবহার ও প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় তখন থেকে।
তাহলে কোন আমেরিকান ব্যাংক যদি আমাকে নিষিদ্ধ বা অবরোধ করার তথ্য, জেনে অথবা না জেনে আমার লেনদেনটাও সম্পন্ন করে দেয় তাহলে কী হবে? বলাই বাহুল্য, এতে এই ট্রেজারি বিভাগ সেই আমেরিকান ব্যাংককে কড়া ফাইন করবে। যেমন- ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধে হংকং ব্যাংকের আমেরিকান শাখা এমনই এক নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে এক লেনদেন ঘটিয়ে দিয়েছিল বলে ওই ব্যাংককে ট্রেজারি বিভাগ থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার ফাইন করা হয়েছিল।
আরেকটা কথা, কেন আমেরিকার হাতেই এমন অবরোধ আরোপের ক্ষমতা দেখা যায়? দুনিয়ার অন্য কোনো দেশ বা সে দেশের মুদ্রাও কী এমন অবরোধ আরোপ করতে পারে না? অবশ্যই করতে পারে। যেমন- চীনও পাল্টা কিছু কিছু আমেরিকান প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর অবরোধ আরোপ করে দেখা যায়। কিন্তু দুইটার ফারাক হল যেহেতু চীনা মুদ্রা ইউয়ানে দুনিয়ায় লেনদেন ডলারের তুলনায় অনেক কম সেকারণ চীনা-অবরোধের প্রভাবও অনেক কম। এ ছাড়াও যাদের লেনদেন চীনের সাথেই কেবল সেখানে কেবল এর কিছু প্রভাব পড়বে।
ওদিকে, আমেরিকা কী কারণ দেখিয়ে এই অবরোধ আরোপ করেছে? তারা দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের র্যাব ও এই প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ওসব ব্যক্তিরা বাংলাদেশে গুরুতরভাবে ‘আইনের শাসন’ ও ‘মানবাধিকার আইন’ ভঙ্গ করেছেন। এখন আমেরিকান প্রশাসনও যদি এমন কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে তাহলে কি আমরা অথবা অন্য কোনো দেশ একই ধরনের মানে আমেরিকার ওপর অবরোধ আরোপের পদক্ষেপ নিতে পারব? আর পারলে তা করি না কেন?
প্রথমে বলে রাখি, এটা তো এখন আশা করি সবার কাছে পরিষ্কার যে, এই অবরোধের শাস্তি দেয়ার সাথে জাতিসংঘ বা অন্য কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা নাই। কেবল আমেরিকান প্রশাসনই এটা করেছে। তাই বলা যায়, আইনত বাংলাদেশ বা আমেরিকাবিরোধী অন্য কোনো দেশও এমনইভাবে কোন আমেরিকান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চাইলে এমন পদক্ষেপ নিতে পারবে। কিন্তু সবার আগে ব্যাপারটায় আমেরিকা আমাদের সাথে খুব তুলনীয়ই নয়, সেদিকটায় নজর দিতে হবে। কারণ আমেরিকার বিচারব্যবস্থা এখনো তাদের সমাজে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রাখে, এছাড়া তারা নিজেকেই নিজে সংশোধন করে নেয়ার এখনো অযোগ্য হয়ে যায় নাই, বরং ক্ষমতাসম্পন্ন; যদিও এর সবই ভাল এমন আদর্শব্যবস্থা নিশ্চয় আমেরিকা নয়। তবে আমাদের দেশের বেলায় এ’ধরনের অভিযোগগুলোর গত ১৩ বছরে কোনো সুরাহা বা প্রতিকার নেই। ফলে এ জায়গায় আমরা আমেরিকার সাথে তুলনীয় নই।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। এখনো পর্যন্ত ডলারের দেশ আমেরিকা বাদে অন্য কোনো দেশ অবরোধ অন্যকোন দেশের উপর আওরোপ করলেও এর কোন শক্ত প্রভাব নাই, এর মূল কারণ কী? মানে অন্য কোনো দেশের অবরোধের তেমন মূল্য নেই। কারণ কিছুটা উপরে বলেছি। বাকিটা হল, অবরোধ মানে, আসলে প্রতিষ্ঠিত কোন দেশের ইকোনমিক ও ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে কাউকে বের করে দেয়া। অনেকটা একঘরে করে দেয়ার মত। যদিও সেটা আমেরিকান ডলারের অবরোধ হলে তবেই সেই চাপ কার্যকর। কারণ দুনিয়ার ৮৫ ভাগেরও বেশি লেনদেন হয় এই ডলারে। আবার সবকিছুই এত বেশি পরিমাণে ডলার-মুদ্রায় কেন? এমন হওয়ার কারণ, গ্লোবাল বাণিজ্য ও লেনদেন ব্যবস্থাটার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ [IMF] হলেও এটা জন্ম (১৯৪৪) থেকেই একমাত্র আমেরিকান ডলারকেই ভিত্তি করে এটা শুরু বা কার্যকর হয়েছিল। ফলে তাতে ডলার আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মুদ্রা হয়ে যায়। কিন্তু তা হলেও তখনো মূলত ডলার আসলে একটা দেশের, আমেরিকার স্থানীয় মুদ্রা। অর্থাৎ আমেরিকার নিজের মুদ্রার ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমরা অন্য দেশের কেউ বাধা দিতে পারি না। আমেরিকার পড়ে-পাওয়া এই বাড়তি সুবিধা প্রাপ্তির শুরু এখন থেকেই। এটা জানা সত্বেও এমনটাই করতে হয়েছিল।
তাহলে আমরা ডলারকে সেকালে আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মুদ্রা হিসেবেও নিয়েছিলাম কেন?
কারণ সে সময় এক আমেরিকান ডলার ছাড়া আর কোনো দেশের মুদ্রা – তার অ্যাকাউন্টে সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত ছিল না। এর মানে আবার কী? মানে হল, দুনিয়ার যত লোককে ডলারে পেমেন্ট দিতে হবে বা আমেরিকার কাছে পাওনা, এর চেয়ে আমেরিকা যাদের কাছে পাবে মানে তারা ডলারে আমেরিকাকে পেমেন্ট দেবে, এর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিটাকে বলা হয় (ডলার) সারপ্লাসে আছে। আবার একটা টেকনিক্যাল পয়েন্ট হলো গ্লোবাল বাণিজ্য লেনদেন ব্যবস্থা কোনো মুদ্রায় চালু করতে গেলে ওর জন্য গ্লোবাল বাণিজ্যের সেই মুদ্রাকে সারপ্লাস মুদ্রা হতে হয়। ১৯৪৪-৪৫ সালে একমাত্র মার্কিন ডলার ছিল সারপ্লাস। এ’ছাড়া বাকি ইউরোপের সব মুদ্রা ছিল মুদ্রাস্ফীতির মুদ্রা। মানে, ভল্টে রাখা সোনার চেয়ে নোট ছাপানো মুদ্রা মান-পরিমাণে বেশি। তাই সেকালে ডলার হয়ে যায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একমাত্র মুদ্রা।
“তারা ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর তালিকাতে রেখেও ভারতের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কোনো ঘোষণার মুরোদ দেখাতে পারেননি। উল্টো ভারতকে ‘গণতন্ত্রী রাষ্ট্র’ বলে দাওয়াত দিয়েছেন আর মোদি সেখানে বক্তৃতা দিয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে আলজাজিরার রিপোর্টে অনেকে ব্লিঙ্কেনের ‘এই চাপাবাজি’র ফাঁদে পড়েছেন। দেখা গেছে, তারা ব্লিঙ্কেনের কথা বিশ্বাস করে নিয়েছেন; আগে যাচাই করেননি”
কাজেই একা আমেরিকা সেকালে পাওয়া সুবিধার জন্য একালেও যে অবরোধ আরোপের সুবিধা নিচ্ছে তা সেকালের সবল অর্থনীতির কারণে। এই বাড়তি সুবিধা যা পেয়েছিল সেটা ওর পড়ে পাওয়া সুবিধা, যা কেবল কুড়িয়ে পাওয়া নেয়া সুবিধা যেন।
এজন্য বেনজীর বা ওই সাতজন শুধু আমেরিকাতেই নয় বিদেশে যেকোনো সম্পত্তি কিনতে চাইলে বাধা পাবেন। আবার, তাদের আগে থেকে কোনো সম্পত্তি থেকে থাকলে টেজারি বিভাগ তা এখন বাজেয়াপ্ত করে নেবে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, এই সাতজনের সংখ্যাটা যেকোনো সময় আমেরিকা আরো বাড়াতে পারে। এনিয়ে আমাদের সরকারি আমলা বা দলীয় নেতারা সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে কাটাবেন, কী জানি কী হয়! যেটা সরকারি কার্যক্রম ততপরতাকে ধীর বা শিথিল করেও দিতে পারে। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার লোক পাওয়ার অভাব দেখা দিতে পারে। সম্ভবত তাই সরকার মনোবল বাড়ানোর দিকে বড় নজর বাড়িয়েছে।
কোনো এক প্রফেসরের পরামর্শ হল (যাকে মনে হচ্ছে পরামর্শক প্যানেলে নিযুক্তি পেয়েছেন), আমেরিকা যেহেতু লবিতে পরিচালিত এক দেশ; ফলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত নিজের পক্ষে লবি ফার্ম নিয়োগ করা। পরে আমরা এর পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনকে দেখতে পাই। ‘মানবজমিন’ লিখেছে – তিনি বলছেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারে অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক আছেন তাদের সাথে আমাদের আলোচনা চলছে, সেটি অব্যাহত থাকবে”। অর্থাৎ সরকার যে আমেরিকান কোনো লবি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়ে সে ভিত্তিতে তৎপর হয়েছে সেটাই তিনি যেন এভাবে আমাদের জানালেন। এর ১২ ঘণ্টার মধ্যে আমরা জানলাম আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ফোন করেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কিন্তু কী কথা হয়েছে সুনির্দিষ্ট করে কেউ এর তেমন ব্যাখ্যা করতে পারলেন না; যদিও একটা শীতল প্রভাব অনেকের মধ্যে দেখা গেল যেনবা সরকারের ভাগ্য কী হয় সে উৎকণ্ঠা যেন এখন থেকে কেটে যাচ্ছে যাবে। কিন্তু একই সাথে সবার এটাও অনুমান এটা এত সহজে যায় না। তাহলে?
যখন কিছুই অফার করার থাকে না, তখন আপোষ চাইলেও কী দিয়ে দেয়া নেয়া হবে?
এবার এ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। বাস্তব বড় কঠিন। বাস্তবতাকে ঢেকে রেখে লাভ নেই বরং দুদণ্ড আবেগকে বাইরে রেখে বাস্তব চিন্তা করলেই যা জানা যায়। সেই কঠিন বাস্তবতাটা হল, আমেরিকার এই অবরোধ আরোপের পরে, “না সরকারের খুব কিছু আমেরিকাকে অফার করার আছে, না আমেরিকার খুব কিছু পাওয়ার সুযোগ আছে”। এমন কাঠামোর মধ্যে আছি আমরা দুইপক্ষ। অনেকে খুঁজে পেয়েছে কিংবা মহাসত্য কোনো কিছু দেখিয়ে দিতে পেরেছে মনে করে বলার চেষ্টা করছেন যেমন আমাদের মন্ত্রী মোমেন বলছেন, “বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অধীনে একাধিক বৈঠক হয়ে থাকে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ফোরাম হচ্ছে পররাষ্ট্র সচিবপর্যায়ে পার্টনারশিপ ডায়ালগ। এ ছাড়াও বিভিন্ন বৈঠকে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়ে থাকে। তারা যেসব বিষয়ে জানতে চায় সেটির উত্তর দেয়া হয়” ইত্যাদি।
কূটনীতি মানে আসল কথা সরিয়ে কথার প্যাঁচাল, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে মোমেনের আসল স্বার্থের কথাটা ছিল, “নিষেধাজ্ঞা শিথিলে বাইডেন প্রশাসনের সাথে আলোচনা চায় ঢাকা”। এটা আসলে মুখ্য গিভ অ্যান্ড টেক। আমরা সরাসরি সে জায়গায় যাবো; এতে সময় ও জায়গা বাঁচবে।
কথা হল, বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দেখতে চায়। কিন্তু বাইডেন কী পেলে তা প্রত্যাহার করবেন? টু দ্য পয়েন্ট বললে এক কথায়, শেখ হাসিনা চীন থেকে সরে এলে। এখন এটা কী সরকারের পক্ষ থেকে করা সম্ভব? না, একেবারে অসম্ভব। তাহলে হাসিনা সরকার এর বদলে কী কামনা করছে? সে চাইছে বৈষয়িক অন্য একটা কিছু যেমন ‘কোনো প্রজেক্ট’ নিয়ে যেন মিটিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সে কথায় আবার সারবস্তুটা হল, সরকারের দেয়ার মত তো এমন কিছু নেই যা পেলে বাইডেন খুশি হবেন; সব মিটিয়ে নিবেন।
কথা হল, বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দেখতে চায়। কিন্তু বাইডেন কী পেলে তা প্রত্যাহার করবেন? টু দ্য পয়েন্ট বললে এক কথায়, শেখ হাসিনা চীন থেকে সরে এলে। এখন এটা কী সরকারের পক্ষ থেকে করা সম্ভব? একেবারে অসম্ভব। তাহলে সরকার এর বদলে কী কামনা করছে? সে চাইছে বৈষয়িক অন্য একটা কিছু ‘কোনো প্রজেক্ট’ নিয়ে যেন মিটিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সে কথায় আবার সারবস্তুটা হলো, সরকারের দেয়ার মতো এমন কিছু নেই যা পেলে বাইডেন খুশি হবেন; সব মিটিয়ে নেবেন।
তবে সেই কথা বলার বাহানাতে সরকারের একটা লাভ হয়েছে যে, বাইডেন সরকারের সাথে তারা ‘গুড টার্মে’ আছে, মিথ্যা হলেও এমন একটা ছবি, এটা বাংলাদেশের পাবলিককে দেখানো গেছে।
কথা হওয়া আর একমত হওয়া এক নয়ঃ
আর বলা হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়েছে। কিন্তু একমত হওয়ার সুযোগ কী আছে? অবশ্যই না। কারণ মূল সমস্যা তো মানবাধিকার মানা না মানাতে নয়। মানবাধিকারের প্রশ্ন তো লংটার্মের পালনীয় শর্ত দিয়ে সবসময় মিটিয়ে নেয়া হয়েছে। গত ২০১৩ সাল থেকে ইউপিআরের [UPR] নামে জাতিসংঘের কর্মসুচি বসলে সেখান থেকে সময় বাড়িয়েই সমস্য দূরে ঠেলা কী চলছে না? আর যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান- বয়ান হল, “বাংলাদেশের গুম-নিয়ে কোনো আইন বা করণীয় নেই। তাই বাংলাদেশে কোনো গুম নাই”। মহা অদ্ভুত এই যুক্তি!!! আসলে এই সরকার পাবলিক রেটিংয়ের ভিত্তিতেতা নিয়ে মাথা না ঘামানো সরকার বলে আর এভাবে সুদীর্ঘ ১৩ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরে এর যা ভিত্তি দাড়িয়েছে তাতে এর পক্ষে কোন ধরণের মানবাধিকার রক্ষার কমিটমেন্ট দেয়া অর্থহীন, সেই কমিটন্টে আস্থা রাখাও অর্থহীন!
যদিও প্রকৃত সমস্যা আরো অনেক গভীরে। আমেরিকা আসলে যা চাচ্ছে হাসিনার বাংলাদেশ তা দিলে তা ধারণ-যোগ্যতা বা পাত্র তো আমেরিকার কাছে নেই। যেমন- আস্থা পাওয়া যায় বাংলাদেশের টিকা পাওয়ার সুরাহা প্রশ্নে চীনা-বিকল্প বলে কী আমেরিকার কোন মুরোদে আছে? যেখানে দুনিয়ার কোথাও আমেরিকা কোনদেশের টিকাপ্রাপ্তির সমাধান করে দিয়েছে – আমেরিকার কাছে এমন কোনো দেশের নাম আছে? বরং উল্টো, সে তো জি৭-এর সদস্য হিসাবে তাদের জাতিসঙ্ঘের ‘হু’ [WHO]কে দেয়া কমিটমেন্টের সব টিকাই দেয়নি। অথচ বাংলাদেশের সমাজে এখন যতটুকু দোকান হাটবাজার গঞ্জ যা যতটুকু যে খোলা আছে কারখানা চলছে তা তো এই চীনা টিকার প্রাপ্যতার জোরেই। ফলে এখনো বাংলাদেশের টিকাদাতা-ওস্তাদ বদলানো – আবার টিকা নেই মানেই হবে, সোজা লকআউট। টিকা নাই মানে হবে, অর্থনীতিও নাই; ডুবে যাওয়া।
যদিও টিকা নেয়া মানে করোনা থেকে একেবারে মুক্তি এমন অবস্থায় দুনিয়া এখনও পৌঁছায়নি, তবু যতটুকু যা ব্যবসা-বাণিজ্য খোলা এবং কার্যকর, তা ঘটতে-চলতে পারছে টিকা দেয়ার জন্যই। আমেরিকার হাতে এনিয়ে চীনের বিকল্প আমাদেরকে কী দেয়ার আছে? বিশেষ করে নয়া ওমিক্রন [Omicron] ভ্যারিয়েন্টের হামলার মুখে? ওদিকে ম্যান্ডেটবিহীন নিশিথ ভোটের সরকার, এটা এখন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প ছাড়া চলতে পারবে না। কারণ এরা পাবলিক রেটিং-এর উপর ভরসা করে চলে না, দাঁড়িয়ে নাই। ফলে উলটা এদের কর্মীদেরকে “প্রকল্প” মানে অর্থের সংস্থান করে না দিতে পারলে তারা থাকবে কেন? এখন বলেন, আমেরিকা কি চীনের মত এই অবকাঠামো ফান্ড জোগাতে সক্ষম? তাহলে কিসের ভরসায় হাসিনার সরকার চীনকে ফেলে ছেড়ে আসবে? কাজেই কোনো ডিলের জায়গাটা কোথায়? ভিত্তিটা কী? বলপ্রয়োগে সরানো ছাড়া সরকারের সরে যাওয়ার জায়গা নেই!
আবার দেখেন হাসিনার বাংলাদেশ চীন ছেড়ে আসবে কোথায়? কোয়াডে? “অসামরিক” কোয়াড কি সক্রিয়? মানে ভারত কি এখন আমেরিকান ক্যাম্পে আছে ? সেটা এখন না ভারত নিশ্চিত বলতে পারবে, না আমেরিকা! এই নড়বড়ে কোয়াডের কোথায় ঢুকবে হাসিনার বাংলাদেশ?
মূল ইস্যু তো একখানেও সেই একই – মানবাধিকার! ভারতের মানবাধিকার প্রশ্নে আমেরিকার যেসব অবরোধ আরোপ করার কথা তা বাইডেনের উচ্চারণের আগেই তো ভারত ভেগে গেছে! মোদির ভারত আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিয়েছে। বাইডেন কী হতভম্ভ নয়? এতে এখন বিশৃঙ্খল ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক বাইডেন সোজা করবেন কী করে? ইমিডিয়েট কোনো পরিকল্পনা কী বাইডেনের কাছে?? মনে হয় না!!
কূটনীতিতে একটা বড় অংশ থাকে বাকচাতুরি, এজন্য কূটনীতির ভাষাই আলাদা; কিন্তু তাই বলে সাবধান এতে সবটাই চাতুরি তা অবশ্যই নয়। কিন্তু ব্লিঙ্কেন ভেবেছেন এটা শতভাগ চাপাবাজির খেলা। ডেমোক্র্যাসি সামিটসহ গত ৯ ডিসেম্বর থেকে বাইডেন কোথাও বলেননি যে, এখন থেকে মানবাধিকার – তার সরকার-প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে। একথা বলতে চাইলে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে তা প্রকাশ করতে হয় তা করেছেন? কেউ জানে না!
অথচ বাইডেনের পররষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন এখন এশিয়ায় আসিয়ান দেশ সফরে, ইন্দোনেশিয়ার পরে মালয়েশিয়ায় সফর শেষ প্রায়। [যদিও বাকি প্রোগ্রাম গুটিয়ে তিনি ফেরত চলে যাবেন কারণ দলে একজনের করোনা-পজিটিভ ধরা পড়েছে।] কিন্তু তিনি প্রতিদিন চাপা মারছেন, মানবাধিকার নাকি তাদের সরকার-প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে!!! ভয়েস অব আমেরিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে তারা বিদেশনীতিতে মানবাধিকারকে ঢুকিয়ে (ইনফিউজ) নিচ্ছে [……to infuse human rights into its foreign policy…]। কিন্তু এটা ব্লিঙ্কেনের নিজের ভাষ্য নয়, রিপোর্টার নিজে যা বুঝেছে বলে তার কাছে মনে হয়েছে সেই ভাষ্য। মানে এই বাক্য ব্লিঙ্কেনের নয়, নিজের বক্তব্য বলছেন রিপোর্টার। তবে আরেক জায়গায় বলেছে, আমরা মানবাধিকারকে বিদেশনীতির কেন্দ্রে নিচ্ছি [……We are determined to put human rights at the center of our foreign policy……]। এই বাক্য ব্লিঙ্কেনের বলা হয়েছে, উপরে কোটেশন চিহ্ন দেয়া আছে!! এরপরেও এটা মেনে নেওয়ার বিরাট সমস্যা আছে। কারণ এই প্যারাগ্রাফেরই শেষ শব্দগুলো হল, ……promote accountability for human rights violations and abuses, no matter where they occur । কিন্তু এই ‘নো ম্যাটার হয়ার দে অকার’ কথাগুলো বিশ্বাস-অযোগ্য। কারণ, ব্লিঙ্কেনের দাবির মানে হল যে ……মানবাধিকার লঙ্ঘন “যেখানেই হোক না কেন” তারা সক্রিয় হবেন – এই কথাটাই তো মিছা! কেন?
এসব শুনে বা পড়ে মনে হতে পারে যে, বাইডেন-ব্লিঙ্কেন খুবই সিরিয়াস এবং একটা নীতিগত অবস্থান নিয়ে তারা মানবাধিকার বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছেন। ফলে এবার আর তারা কে কোন দেশ বা কোন ‘কৌশলগত বন্ধু’ তা দেখবেন না। দেখবেন মানবাধিকারের নীতি কে মানেননি; আর তার ওপর তারা কঠোর হবেন।
তাই কী?
না, এটাই সর্ব্বৃহৎ চাপাবাজি। কারণ তারা ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আমেরিকার অবরোপ আরো সম্ভাব্য তালিকাতে রেখেও সেই ভারতের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কোনো ঘোষণার মুরোদ দেখাতে পারেননি। উল্টো ভারতকে ‘গণতন্ত্রী রাষ্ট্র’ বলে সার্টিফিকেট-সহ দাওয়াত দিয়েছেন আর মোদি সেখানে ‘বক্তৃতা’ দিয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে আলজাজিরার রিপোর্টে অনেকে ব্লিঙ্কেনের ‘এই চাপাবাজি’র ফাঁদে পড়েছেন। যেমন সেখানে এক রিসার্চ ফেলোর বরাতে বলা হয়েছে…told Al Jazeera the US sanctions show that the Biden administration has made a “significant policy shift” not only over Bangladesh, but in the US foreign policy in general,……। অর্থাৎ এটা নাকি বাইডেনের আমেরিকার পলিসি শিফট ঘটে গেছে।
তাহলে ভারত তো আমেরিকার অবরোধ আরোপের সম্ভাব্য তালিকার দেশ – তবু কেন অবরোধ নাই? কাশ্মীর ইস্যুতে, সারা ভারতে মুসলমান নিপীড়ন ধর্মীয় স্বাধীতায় হস্তক্ষেপ মসজিদ ভেঙ্গে বা আগুন দেয়া পাবলিক নামাজে বাধা দেওয়া ইত্যাদিতে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান থেকে বাইডেনকে অবরোধ দেয়ার সুপারিশ দেয়া ছিল ; এছাড়া সর্বশেষ ভারতের খৃশ্চানদের উপরেও তাদের চার্চে হামলায় এবার ক্রিসমাস পালন না করার সিদ্ধান্তের কথা শোনা যাচ্ছে – হিন্দু ছাড়া অন্য কোন ভারতীয় ধর্মপালন করতে পারবে না যেন, এমন অবস্থা দাড়িয়েছে। এই জলন্ত তথ্যগুলো পাশে রেখে যেখানে ভারতের উপর আমেরিকার কোন অবরোধ নাই এটা সত্বেও আমেরিকা “significant policy shift” করেছে এমন দাবি কিভাবে করা যায়? অর্থাৎ এখানে কার্যত দেখা গেছে, এরা ব্লিঙ্কেনের কথা বিশ্বাস করে নিয়েছেন; চোখ খুলে আগে বাস্তবে যাচাই করেননি।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
এই লেখাটা দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ওয়েবে আর পরেরদিন প্রিন্টে “লেনদেনের ‘বস্তুই’ নাই” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]