কেন ভারত সফর


কেন ভারত সফর
গৌতম দাস

১১ সেপ্টেম্বর ২০২২  0৮ঃ৫৫ সকাল

https://wp.me/p1sCvy-4eE

 

Bangladesh PM Sheikh Hasina Arrives In Delhi For 4-day Visit

হাসিনার সদ্য সমাপ্ত ভারত-সফর নিয়ে সফরের আগে থেকেই দেশে হাইপ [hype] বা মিথ্যা উচ্ছ্বাস তোলার চেষ্টায় কমতি ছিল না। মনে করা হয় আওয়ামি যুগ্ম বা সহ-সম্পাদক এর নিচের নেতাকর্মিমহলে ভারতের সাথে হাসিনা সরকারের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট এটা দেখাতে পারলে, এরা বিরোধিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে  নির্দয় মারপিট করতে জোশ পায়, চাঙ্গা হয়ে উঠে। অনেকে তাই হাইপ তোলাটাকে এখান থেকে দেখেছে।  তবে এর আগে বাংলাদেশের কোন প্রধানমন্ত্রীর কোন সফর নিয়ে এমন হাইপ তোলার চেষ্টা আমরা দেখিনি। সেদিক থেকে একটা বাড়াবাড়ি ত অবশ্যই ছিল।

অন্যদিকে, এই সফর কেন, কী এর মুখ্য উদ্দেশ্য এর একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকার বা দল হাজির করার ক্ষেত্রে ব্যাপক খামতি দেখা গেছিল।  এরা কেউ বলতেই পারে নাই বা চায় নাই যে এই সফরের উদ্দেশ্য কী বা মুখ্য ইস্যু কী?  এটা ঢাকতেই যেন হাইপ তোলা হচ্ছে তা মনে হয়েছে। কিন্তু মুল বিষয়,  দেশের সরকার প্রধান কোন সফরে কেন যাচ্ছেন এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে অসুবিধা হবে কেন – এটাই তো আসলে অকল্পনীয় এবং অবিশ্বাস্য! কিন্তু তাই হয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান বা চলমান সম্পর্ক নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে গত ১৪ বছরে ব্যাপক অস্বচ্ছতা ও নিরুত্তর সব প্রশ্ন ক্রমেই তৈরি করে ফেলা হয়েছে।  সরকার এদিকটা কোনই আমল করে নাই অথবা আমল করা অবস্থায় ছিল না। যেমন, “ভারতকে বলেছি শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে” – পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন একথা বলে ১২ ঘন্টাও টিকতে পারে নাই। এই উদাহরণটা আমরা মনে রাখতে পারি। এছাড়া দিনকে দিন ভারতের সাথে আমাদের নানান পাওনা নিয়ে গত ১৪ বছরে (যেকালে ভারত আমাদের চরম বন্ধু সরকার বলে দাবি জারি আছে) অমীমাংসিত ইস্যুর সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমে নাই। আর পানির মত ন্যায্য পাওনার ইস্যুগুলোর সমাধান ভারত আরো জোর জবরদস্তিতে করে তা না দিয়ে চলতে চেয়েছে। আর আমাদের সরকার বরং সেগুলো পাশ কাটিয়ে সবসময় চেষ্টা করেছে উলটা ভারতের খাতিরদারি আর তোয়াজ করে চলতে।  তাই এটা আশা করা অস্বাভাবিক ছিল না যে যেহেতু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ইন্ডিয়া সফর তাই এই সফরের অন্তত প্রধান ফোকাস ইস্যুটা কী এনিয়ে সরকার স্পষ্ট করে বলে রাখবে। কিন্তু তাও এবার সরকার করে নাই।

তুলনায় এর আগে যেমন ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের জটিলতা বা অস্বাভাবিকতা যাই থাক তা সত্বেও তো উভয় দেশ থেকেই  উভয় দিক থেকে সরকার প্রধানের সফর ঘটেছে। কিন্তু কখনই এবারের মত এই সফরে ইস্যু কী – তা উহ্য রাখা হয় নাই। অথচ এবার নুন্যতম ফোকাস ইস্যুটা কী তা কেউ জানে না। সরকার স্পষ্ট করে বলতে পারে নাই – এমনটা হয় নাই।

তাই উপায় না পেয়ে এমনকি প্রো-সরকারি মিডিয়াগুলোও পাবলিককে সন্তুষ্ট করতে যাকে পেয়েছে তাকেই ধরে নিয়ে এসেছে কিছু বলার জন্য। আর তাতেও দেখা গিয়েছে বিশেষত সাংবাদিক, সাবেক কূটনীতিক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপকেরা হিমশিম খেয়েছেন। প্রশ্নের জবাবের চেয়ে আরো নতুন নিরুত্তর প্রশ্নগুলো সামনে এসে হাজির হয়েছে।  আর এতে সব আলোচনাতেই মুখ্য প্রসঙ্গ হয়ে ছেয়ে গেছে যে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটা একপক্ষীয় – বাংলাদেশের দিক থেকে কেবল দিয়ে যাওয়া অথচ বাংলাদেশের প্রতিটা ন্যায্য পাওনার যেখানে হদিস নাই। এক্ষেত্রে অবশ্য আমরা ২০১৮ সালের ৩০ মে হাসিনার নিজের মুখের আক্ষেপের কথা মনে রাখতে পারি যে তিনি বলেছিলেন,  ভারতকে যা দিয়েছি তা তারা সারাজীবন মনে রাখবে” – শেখ হাসিনা

‘ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সমর্থনের’ উপরই নির্ভরশীলঃ
এবার সফরে মূল ইস্যু না জানা থাকাতে দীর্ঘ অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়েই আমাদের সমাজে আলোচনার চেয়ে সমালোচনা হয়েছে বেশি।  তাই শেষে এর একটাই ব্যাখ্যা আপনাতেই  সামনে হাজির গেছে যেন আমাদের সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সমর্থনের উপরই নির্ভরশীল তাই তার পক্ষে বাংলাদেশের পাওনা বা স্বার্থের দিকটা নিয়ে কথা বলার, তুলে ধরার সুযোগ ও সক্ষমতা তার নাই, সে হারিয়েছে।
এছাড়া এমন আপনা হাজির ব্যাখ্যার পক্ষে আরো উস্কানি তোলা আগুন ধরিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য। হাসিনার ভারত সফরের দু-সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামে স্থানীয় হিন্দুদের এক জমায়েতে দেয়া , “বাংলাদেশের সরকারকে টিকানোর জন্য ভারতকে বলেছি” – এই বক্তব্য। মোমেনের বক্তব্যের কারণেই ‘ভারতের সমর্থনের উপরই নির্ভরশীল” আছে এই সরকার এরপক্ষে সরকারি অনুমোদন পোক্ত হয়েছে বলে সমাজ দেখেছে। যদিও ঐদিন সন্ধ্যা হতেই খারাপ প্রতিক্রিয়া টের পেয়ে সাধারণ সম্পাদক কাদেরকে দিয়ে ঐ বক্তব্য “দল বা সরকারের নয়” বলে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু দলনেত্রীর হুকুমছাড়া  – মোমেন, কাদের বা পরবর্তিতে আব্দুর রহমান এর মত নেতারা কেউ কথা বলেছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন!!
আর এথেকেই আগামি বছর নির্বাচনের কথা খেয়াল রেখে সাধারণ মানুষের অনুমান যে আসলেই আগামি নির্বাচনেও সরকার ভারতের সক্রিয় সমর্থন কামনা করছে। যেন ভারতের অবস্থান  হাসিনা সরকারের পক্ষেই থাকে, অন্যদলের দিকে না যায় – এটা নিশ্চয় এবারের হাসিনার ভারত সফরের মূল উদ্দেশ্য!!

তিস্তা নদীর পানি ইস্যু অমীমাংসিত সকল ইস্যুর চেয়ে আলাদা, কেনঃ
তিস্তা নদীর পানি ইস্যু ভারতের সাথে অমীমাংসিত সকল ইস্যুর চেয়ে আলাদা। অথচ এবার সরকার না চাইতেও তিস্তা নদীর না-পাওয়া পানি ইস্যু এই সফরকে কেন্দ্র করে ভারতের গায়ের জোরের নীতি-পলিসি  আরো উন্মোচিত হয়েছে।  তাই, সাংবাদিক, সাবেক কূটনীতিক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপকেরা এনিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অস্বস্তিতে পরেছে।  আর তিস্তা নদীর পানি ইস্যু ভারতের সাথে অমীমাংসিত সকল ইস্যুর চেয়ে আলাদা। কেন?
গত ২০০৯ থেকে চলে আসা টানা ১৪ বছরের সরকার মূলত ভারতের নর্থ-ইস্ট বা আসামের সব চাহিদার ইস্যু বা দুঃখ ঘুচিয়ে দিবে যেন এই প্রতিজ্ঞা করে ক্ষমতায় এসেছিল। এককথায় বললে, সারা নর্থ-ইস্ট বা আসাম, ত্রিপুরা ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে সব ধরণের অবাধ করিডোর সুবিধা নিবে এর বিনিময়েই যেন তখন সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। মনে হয়েছে যেন আমরা এখনও “অখন্ড বৃটিশ-ইন্ডিয়ায় ১৯৪৭ সালের আগেই আছি”। এই অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে তাই ভারতের একক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অবাধে বাংলাদেশের ভুখন্ডের উপর দিয়ে সব করিডোর সুবিধা নেওয়া হয়েছে। আর তা যোগানোই যেন আমাদের সরকারের কর্তব্য!!

এখন ২০০৭ সালের পরিকল্পনা মতে,  ভারত এভাবে একপক্ষীয় ভাবে সকল সুবিধা নিবে এটা দেখতে খারাপ লাগে তাই, ভারতের দিক থেকে দুইটা অমীমাংসিত ইস্যু তারা বাংলাদেশকে সমাধান করে দিবে বা ছাড় দিবে – এমন একটা ধারণা আমরা কার্যকর থাকতে দেখেছিলাম। এর একটা হল “ছিটমহল বিনিময়” যা সেই শেখ মুজিবের আমল থেকে চুক্তি করেও ফেলে রাখা ছিল।  যেটা সেই আমল থেকে আমরা আমাদের ভুমি ভারতকে ছেড়ে বসে আছি কিন্তু ভারতের খবর নাই – অবস্থায় ছিল; এই ছিটমহল প্রশ্নের সমাপ্তি টানবে। আর দ্বিতীয়টা ছিল, তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন। এই কারণে বলা যায়, তিস্তা ইস্যু হল স্পেশাল যা ভারতের দিক থেকে নয়া হাসিনা সরকারকে আপোষে দেয়া প্রতিশ্রুতি।
অথচ আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদি সশস্ত্র আন্দোলন সমস্যা মিটিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে আসামের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, আকাশ-স্থল-পানি ইত্যাদি সব মাধ্যমে করিডোর যোগাযোগ সুবিধা কী নয় – এমন সবকিছু ভারতকে দেওয়ার পরও আমাদের সরকারের হাত শুন্য – আশ্বাস ছাড়া সেখানে কিছুই নাই!!
আর এখন এসব সত্বেও আমাদের বেচারা সাংবাদিক, কূটনীতিক বা অধ্যাপকেরা তবু আশার বাণী শুনাচ্ছেন যে এই সফরে তিস্তা ইস্যু নাকি আলোচনার বিষয় হবে – অথচ এনিয়ে কোথায় কোন আলাপ নাই।
এমনকি কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে মোদি সরকার তো পানি দিতেই চায় কিন্তু মমতা চায় না তাইতেই  নাকি সব সমস্যা হয়েছে। আচ্ছা যদি সমস্যাটা তাই হয় এসব বক্তারা কী একবার ভেবে দেখেছেন এর অর্থ কী? এর অর্থ হল, তাদের মোদি-জী আসলে একটা খামোখা!!! মুরোদ নাই, অক্ষম; তাই তিনি কেউ নন। তাহলে ভারতের সরকার কাঠামো অনুসারে এখানে  মোদি সরকারের যদি মুখ্যমন্ত্রীর উপরে মুরোদ নাই হয়ে থাকেন মানে পানি দেওয়ার ক্ষমতা যদি মোদির না মমতার হাতে থাকে তাহলে আমরা মোদির সাথে কেন ডিল করতে বা চুক্তি করতে চাচ্ছি বা গিয়েছি কেন??? মোদি তাহলে কে আমাদের কাছে??? জয়শঙ্করের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আমরা কথা বলছি বা বলব কেন??? কোন মুরোধীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের যাওয়ার দরকারই বা কী??

একারণেই বাংলাদেশে একথার প্রতি বিশ্বাস বাড়ছে যে আমাদের সরকার ভাবছে তার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের সমর্থন জরুরি আর একারণেই বলাই বাহুল্য ভারত তাই যেচে আমাদের কোন ন্যায্য পাওনা দিতে মনোযোগ দিবে কেন?

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলা ছেড়ে, প্রসঙ্গে আসতে হবে – কেন ভারত সফরঃ
উপরে এতক্ষণ ঘুরায় ফিরায় আমরা অনেক কথায় গেলাম। কিন্তু মূল বিষয় যে ভারত সফরের উদ্দেশ্য কী তা জানা হল না। এককথায় বাংলাদেশে বা দেশের বাইরের মিডিয়ায় যাকিছু প্রকাশিত আলোচনা তারা কেউই সফরের উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্ট জানাতে পারে নাই। শেষে অনেকে হাল ছেড়ে দিয়ে লিখেছে এই সফরের উদ্দেশ্য নাকি “রাজনৈতিক”। ‘রাজনৈতিক’ মানে?? সেটা আবার কী??  আসলে সেটা হল  মানুষ যখন বুঝে যায় তার কথার কোন মানে হচ্ছে না তখন কিছু অর্থহীন অবুঝ শব্দে (vague) মানে আন্দাজে অস্পষ্ট শব্দ নিয়ে আসে। এখানে ‘রাজনৈতিক’ শব্দের অর্থ তাই। ঠিক যেমন অনেকে নিজ বুদ্ধিতে না কলিয়ে দুনিয়ার নানান ফেনোমেনো ব্যাখ্যা না করতে পারলে বলে – এটা ‘ভূরাজনীতি’ বা ‘ভূরাজনৈতিক প্রভাব’। এই “রাজনৈতিক” শব্দের আমদানিও সেরকম। অর্থাৎ যেটা নিজেই বুঝে নাই, সেটা অন্যকে বুঝাতে লজ্জা ঢাকতে গিয়ে যে শব্দ তুলে আনা হয়।

তাহলে আবার পুরানা প্রশ্ন, এই ভারত সফরের উদ্দেশ্য কী? এবার আর রহস্য না করে বললে সোজা জবাবটা হল – ভারত সফরের উদ্দেশ্য ‘চীন’! সেটা আবার কী? যেখানে সফরে যাচ্ছে ভারতে তাহলে সেখানে উদ্দেশ্য চীন – একথার মানে কী?

মানে হল, গত দুমাস ধরে বাংলাদেশের মিডিয়ায় লাগাতর যে প্রধান খবরে ডুবে ছিল ও আছে তা হল, রিজার্ভ সংকট। মানে সরকারের কোষাগারে দেশচালানোর মত  যথেষ্ট ডলার নাই। গড়ে প্রতি মাসে আমদানি আয় ও রপ্তানিতে ব্যয়ের ঘাটতিতে একে রেমিটেন্স ও ইত্যাদি আয় দিয়ে পূরণ করার পরও ব্যালেন্সে ঘাটতি গড়ে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। আর সামাজিক বাস্তবতার দিক দিয়ে যদি ব্যাপারটাকে বর্ণনা করি তা হল,  আমাদের নিয়মিত কমপক্ষে দুঘন্টা লোডশেডিং হয় আর সারা দেশের মানুষের সরকারি-বেসরকারি  ওয়ার্কিং আওয়ার  ৩ ঘন্টা কমানো হয়েছে, মূলত বিদ্যুতের চাহিদা কম রাখার জন্য। আর এদুটা হল আমাদের ডলার সঙ্কট কত তীব্র তা বুঝবার জন্য বাইরের মাত্র দুটা প্রকাশিত চিহ্ন। এছাড়া চারিদিকে মুদ্রাস্ফীতি যা মূলত উদ্ভুত হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে দেড়্গুণ বাড়িয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে। এতে বাজারে ডলার কেনাবেচার রেট ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এসবই হল মারাত্মক গভীর সব সংকটের বাইরের দুচারটা লক্ষণ। আবার সেই থেকে আইএমএফের কাছে বিশেষ ঋণের আবেদন করা হয়েছে, সে খবরের উদ্ভব। তবে আপাতত দেখা যাচ্ছে ডলার সংকট নিয়ে উদাম খবরগুলো আর বাইরে আসছে না। নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিছু লাগামও টানা হয়েছে। কিন্তু সংকট যে আগের মতই আছে সেটাও পরিস্কার!
এসবের সারকথা হল, আমরা গভীরভাবে ডলার বা রিজার্ভের সংকটে আছি।

আমাদের দেখা উদাহরণ বলছে, এমন ডলার সংকটে আইএমএফ সংকটের সুরাহা দেয় কিন্তু  তা প্রথমত, অন্তত ৪-৫ মাস লেগে যায় তাতে। আর, তবে এর আগেই বাছবিচারহীনভাবে খামোখা সব ভর্তুকি তুলে নেওয়ার দাবি করে আইএমএফ মুদ্রাস্ফীতি চরমে তুলে দেয়। (তবে আমাদের সরকার কেউ না বলতে আগাম নিজেই তেলের দাম দেড়্গুণ বাড়িয়ে সমস্যাকে ঘোলাটে করেছে।) দ্বিতীয়তঃ  সব চেয়ে বড় কথা আইএমএফ এক্ষেত্রে চলতি সরকারের সাথে চুক্তিই করে না। যদিও হবু নয়া ঋণচুক্তি নিয়ে আলোচনা ও শর্তাবলি কী হবে তা নিয়ে আলোচনার সবই করে। কিন্তু শেষে চুক্তি করার আগে বলে থাকে চলতি সরকারের সাথে না, পরবর্তি সরকারের সাথে সে চুক্তি করবে। এর মানে যে যা বুঝার বুঝে নিতে পারেন। আর শ্রীলঙ্কায় ঠিক এই জিনিষটাই সম্প্রতি ঘটেছে।

তাহলে এর থেকে সরকারের নুন্যতম বিকল্প বা পরিত্রাণ কি?  তা হল, চীনের মত দেশ থেকে বড় নগদ ঋণ নেয়া। চীনের নাম নেয়া এজন্য যে বাকি যারা দেশ তাদের সামর্থের প্রশ্ন আছে আর এরচেয়েও বড় হল, কোন ‘ক্যাম্পের’ তারা ইত্যাদি এসবের প্রশ্ন আছে। তবে আইডিয়ালি বললে, আইএমএফের লোন পাওয়া নিশ্চিতের বা পাওয়ার পরেও একই সাথে সাথে চীনা ঋণও পাওয়ার দরকার থাকে। আমাদেরও আছে। মূল কারণ, আইএমএফ লোনের পরিমাণ কম হলেও এর উদ্দেশ্য বা আমাদের লাভ ও দরকার হল দেশি-বিদেশি পুঁজি বাজার ও ব্যাংক ব্যাবসাকে আশ্বস্ত করা যে আইএমএফ (সে বাজারের চোখে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ) নিজে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা চেক করেছে। আর চীনের ঋণ দরকার রিজার্ভের ঘাটতি পূরণে। তবে আলোচ্য ক্ষেত্রে সম্ভবত সরকার বেছে নেয়া লাইনটা হল, আইএমএফের  ঋণ পাওয়া যা হবে হোক, আগে চীনা লোন নিশ্চিত করা যাক!

কিন্তু তাতে আবার সমস্যা কীঃ
তাতে সমস্যা কী? নয়া চীনা লোন নিলেই তো হয়। আর এর সাথে আবার হাসিনার ভারত সফরে যাওয়ার কী সম্পর্ক?

বিরাট সম্পর্ক। আর সেটা দশহাত শাড়ি পড়ার মত, যে ডানদিকটা ভালমত ঢাকলে তাতে বাদিকটা উদাম হয়ে যায়। সেটা আবার কী? এখন চীনেরও সদ্য পুরান  কিছু ক্ষোভ আছে। আর চীনের স্বভাব হল ক্ষুব্ধ হলে সে ঐ দেশ ছেড়ে চলে যায় না। বরং বিপদে পড়া দেশটাকে আরও সাহায্য করে ঠিকই কিন্তু এবার আরো কড়া সব শর্ত আরোপ করে।

এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি গত ২০২১ সালে আমাদের করোনা টিকা পাওয়ার কাহিনী। আজ বাংলাদেশে দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার মধ্যে সবার চেয়ে আগিয়ে ৭৩.৭% সফল তিন ডোজ টিকাদান করা দেশ। কিন্তু এই মিরাকল কেমনে সম্ভব হল কেউ খবর নেই নাই। ভারত আমাদের সাথে শর্তভঙ্গ করে আমাদেরকে টিকা না দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে পাপনের প্রকাশ্যে ভারতকে গালাগালি করা আমরা দেখেছি। এরপরও, এখন এই অর্জন সম্ভব করা গিয়েছে। কারণ, এখন আমাদের টিকা পাওয়ার মূল চালান চীনের দেয়া আর সেটা প্রায় বিনা পয়সায়। ঢাকা শহরের মধ্যে বিতরণ করা  (জাতিসংঘের হু এর দানে দেয়া কিছু টিকা) বাদে এর বাইরের সব টিকাই চীনা টিকা। কিন্তু কিসের বিনিময়ে সরকারকে এই টিকা পেতে হয়েছে আমরা সাধারণ্যে খবর নেই নাই।

খুব সম্ভবত আজকের ডলার সংকটের ক্ষেত্রেও ক্ষুব্ধ চীনের শর্ত মেনে আমাদের লোন পেতে হবে। গত ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট এর ঢাকা সফরের পর থেকে আমরা প্রথম চীনা অবকাঠামো ঋণ পেতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই ছয়বছরে নিতে চাওয়া বহু অবকাঠামো প্রকল্প শেষে আমরা নিতে পারি নাই। কারণ, চলতি ১৪ বছরের টানা সরকারকে ভারতের সমর্থনের (ভারতের সমর্থনে সরকার বিষয়ক মন্তব্য করে মোমেন যেকারণে নিন্দিত) ব্যাপারটাকে সবার উপরে সবসময় আমল ও মনোযোগ দিতে হয়েছে। খুব সম্ভবত এবার চীনা নগদ ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের আপত্তিতে আগে যেসব চীনা-প্রকল্প বাদ দিতে হয়েছে এর সিঙ্ঘভাগে এবার ফিরে গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে রাজি হতে হবে।

আর এতে ভারতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া অনুমান করে আগেই ভারতের সাথে কথা বলে অন্তত যথাসম্ভব তা জানিয়েই কাজ করতে মনস্থ করেছে সরকার। অতএব সেখান থেকেই এই ভারত সফর। এনিয়ে একমাত্র সমকাল পত্রিকায় সঠিকভাবে সম্প্রতি কিছু রিপোর্ট এসেছে। স্বভাবতই খবরের সোর্সের নাম আড়াল করে ছাপানো  “তাসনিম মহসিন” এর লেখা সমকালের কিছু রিপোর্টে তা এসেছে। এর মধ্যে গত ৯ সেপ্টেম্বর   ‘ঢাকার মধ্যপন্থায় আশ্বস্ত দিল্লি’ শিরোনামে লেখাটা সবচেয়ে (তবে যতটা সম্ভব ইঙ্গিতে বলা) বিস্তারিত।  যদিও আসলেই কী ভারত এতে আশ্বস্ত হবে? এর জবাবটা ঘুরিয়ে দিতে হবে! বলতে হবে, কেউ আশ্বস্ত হবে কিনা সেটাই তো ওর নিজ যোগ্যতার উপর নির্ভর করে! তাই না!!

যেমন ধরেন টিকা প্রসঙ্গে মানে, দিব বলে চুক্তি করে না দেওয়া এটা ভারতের ছেঁচরামো – এর পরিণতি কী হয়েছে? পরিণতি হল কক্সবাজারের কিছু স্থাপনা বাংলাদেশ চীনকে করতে দিয়েছে। মানে যেমন বিমানবন্দর-রানওয়ে ও ‘ইত্যাদি’ নির্মাণের কাজ দেয়া। এখন এতে ভারত অস্বস্তিবোধ করে তো লাভ নাই। এটাই তো টিকা না দেওয়ার  কাফফারা!! নয় কি? ভারতের নাই মুরোদ বা যোগ্যতা তবু তাকে চীন-বাংলাদেশ প্রথম টিকা-চুক্তিতে বা-হাত ঢুকাতেই হবে। চীনা টিকার  গবেষণায় থার্ড ফেজে বাংলাদেশ অংশ নেওয়ার বিনিময়ে  চীনা টিকা পাওয়া বন্ধ করে দিতে হবেই!!! এই ছিল অক্ষম মুরোদধীন ভারতের কূটনীতি! এতে পরিণতি কী হয়েছে সেটাই দেখব!

অর্থাৎ সেই ভারত যোগ্য হয় নাই এখনও।  অন্যকে অবকাঠামো ঋণ দেবার মুরোদ হয় নাই। ভারতের অর্থনীতি সে জায়গায় উন্নিত নয়। আর পছন্দের দেশকে ‘অবকাঠামো ঋণ দেবার মুরোদ” যখন হয়, এটাই কোন দেশের গ্লোবাল নেতা হবার বা কার্যত দাবি করার বা উঠে দাড়ানোর মুল লক্ষণ চাবিকাঠি।  এভাবেই  দাপটের সাথে গত পচাত্তর বছর ধরে আমেরিকা এভাবেই মুরোদ দেখিয়ে এসেছে। যেটা এখন শীর্ণ প্রায়, বুড়া সিংহের মত।  এটাই অন্যদেশের উপর প্রভাব বিস্তারের আসল  সক্ষমতা ও যোগ্যতা।  যা এখন আমেরিকার জায়গায় দেখাচ্ছে চীন। আর ভারতের সে মুরোদ হতে এখনো ধারে কাছেও নাই; তবে হয়ত হবে। অথচ এখনই বিরাট হা-করা আশার জিহবা বের করে ভারত বসে গিয়েছে। যেন কুঁজোর চিত হয়ে শোয়ার শখ জেগেছে!!

যেমন উপরে উল্লেখিত সমকালের তাসলিম মোহসিনের ঐ লেখার একটা অংশ হল এরকমঃ “…সাবমেরিন বিষয়ক সামরিক প্রশিক্ষণে বঙ্গোপসাগরে চীনা উপস্থিতির বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় রাডার ব্যবস্থাপনা সরবরাহ নিয়ে করা সমঝোতার দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সমুদ্রে নিরাপত্তা নজরদারি জোরদারের জন্য রাডার সিস্টেম দেবে ভারত।  এ কারণে দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় রাডার ব্যবস্থাপনা সরবরাহ নিয়ে করা সমঝোতার দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হয়েছে”।  এটাই হল, – কুঁজোর চিত হয়ে শোয়ার শখ – এর পারফেক্ট উদাহরণ। ভারত যেন বলতে চাইছে – মাংস খেতে না পারলাম একটু ঝোল তো পেতে পারি।  আসলে যে মাংস পাবার যোগ্য নয়, হয়নি সে ঝোলও কেন পাবে???  আগে নিজের অবকাঠামো নির্মাণের সব প্রয়োজন পুর্ণ কর – এরপরেই না অন্যদেশে অবকাঠামো ঋণ দিতে শুরু করা!  মানে গ্লোবাল প্রভাব তৈরি করতে, ছড়িয়ে দিতে শুরু করা এসব কাজের যোগ্য হওয়া আর এজন্য  ছেঁচরামো শুরু করা কি এককথা?? আর এসব করে শেষে লাভটা কী হয়?

কাজেই এখন ভারতের মুরোদহীন আপত্তি উপেক্ষা করে চীন-বাংলাদেশের পুরানা বাদ-পড়া চীনা প্রকল্পগুলো আবার চালু করতে হাসিনার সামনের ভারতীয় বাধা কাটাতেই, মানে অন্তত মুখরক্ষা করতেই হাসিনার এবারের ভারত সফর ঘটেছে। এটাই মূল কারণ। আর লাভের লাভ যে ভারতীয় কোন আপত্তি যে হাসিনা আমল বা শোনার অবস্থায় নাই সেটা বলে দিয়ে এসে সব বাধা কাটিয়ে আনতে তিনি সফল – এই অর্থে তার সফর সফল বলে সরকার দাবি করছে। আর তা যাওয়ারই কথা। আর এর সাথে পাশাপাশি চীনা  কিছু নগদ ঋণের সংস্থানও হাসিনা করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে অবশ্যই যাতে তাঁর চেপে বসা ডলার সংকটের কিছু সুরাহা হয়।

কিন্তু হাসিনার ভারত সফর সফল “হবারই কথা” বলছি কেন?
বলছি কারণ ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক ঢলে গেছে তা একেবারে ভেঙ্গে না গেলেও। ফলে ভারত যেন হাসিনার জন্য আমেরিকার কাছে কোন সুপারিশ নিয়ে যাক, এমন উদ্দেশ্য হাসিনার এই সফরে ছিল না।  কারণ, এখন আর আমেরিকার কাছে  ভারতের সেই মুল্য বা গুরুত্ব নাই।  একারণেই রাশিয়ান তেল বা জ্বালানি নিয়ে সেসব বকোয়াজি এটা শাহরিয়ার আলমের নিজের কল্পনা। যতদুর জানা যায় এটা আপার ফরমাইস ছিল না।

কিন্তু  এখন কী দাড়ামো? এর মানে কী এই যে সরকারের ডলার সংকট সমাধান হয়ে যাচ্ছে? না, এখনো অনেক সবুর করতে হবে। এছাড়া সবটা  না হলেও সরকার কিছু আলো দেখতে পাবে অবশ্যই। তাও যদি এখন চীনের সাথে নয়া কিছু চুক্তি সম্পন্ন-সহ সেসব কাজকে বাস্তবে করে দেখাতে পারে তা পরিকল্পনা-মত সফল হতে হবে আগে।

পুরা ডলার সংকট সমাধান কী হবেঃ
কিন্তু কেন পুরা ডলার সংকট সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা জাগাতে পারা যাচ্ছে না? মূল কারণ সংকটটা কৃত্রিম। মানে হল, গত ১৪ বছর যে পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারি অর্থ লোপাট হয়েছে এরা সবাই চাচ্ছে তাদের টাকা ডলারে রুপান্তর করে নিতে। এটা বাস্তবত অসম্ভব। কারণ, এই চাহিদা অস্বাভাবিক। এটা বাংলাদেশের স্বাভাবিক অর্থনীতি থেকে উঠে আসা কোন চাহিদা নয়। এটা আলটপকা এবং লুটেরাদের চাহিদা। যা স্বাভাবিক অর্থনীতিক চাহিদার বাইরের ঘটনা আর বাইরের লোকেদের। আমাদের স্বাভাবিক অর্থনীতি কখনও আমাদের অর্থনীতিতে সচল সব স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে ডলারে রুপান্তরিত করার কোনই চাহিদা তৈরি করে না।  কাজেই এখন দেখা দেওয়া সব চুরির টাকার ডলারে রুপান্তরের চাহিদা এটা স্বাভাবিক ও আমাদের অর্থনীতির পক্ষে তাদের চাহিদা মিটানো এবসার্ড! ফলে সোজা কথা,  চোরদের তৈরি করা “ডলার চাহিদার” উপর রাষ্ট্রের একশন লাগবে – সক্ষমতা লাগবে, একে কঠোর দমন করা লাগবে, যদি  সে মুরোদ থাকে!

এই পরিস্থিতিতে জীবন নাভিস্বাসে উঠে যাওয়া মানুষের ক্ষোভ বাড়তেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আর সাথে এখন থেকে অর্থনীতি ক্রমশ স্থবির হতে চাইবে – এমন দশা স্পষ্ট হইয়ে উঠবে। যা ব্যাপক অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করবে। তাই সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভকে ঠিকমত কাজে লাগিয়ে বিরোধী রাজনীতির সামনে চলে আসা, প্রধান ফেনোমেনা হয়ে উঠা  – এটা এক খুবই বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে, যেখানে তাদের আমেরিকান সমর্থনও পাওয়ার কথা।  বাকিটা আগামিতে…।

 

গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s